আমিনুর রহমান হৃদয়। শিশুসাংবাদিকতায় সমাদৃত একটি নাম। হৃদয় এখনো উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোয়নি। পড়াশোনা করছেন পীরগঞ্জ সরকারি কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে মানবিক বিভাগে। এরই মধ্যে তিনি সাপ্তাহিক ‘বাংলার আলো’ পত্রিকা ও ‘মাসিক গ্লামার’পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক ‘আলোর কণ্ঠ’নামের স্থানীয় পত্রিকায় কিশোর প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন।
বর্তমানে হৃদয় পীরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদস্য এবং উপজেলা অনলাইন জার্নালিস্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি বিডিনিউজ২৪ডটকমের হ্যালো এবং প্রিজম বিভাগে কাজ করছেন। এছাড়াও দৈনিক ‘আলোকিত বাংলাদেশ’পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি ও স্থানীয় ‘প্রান্তকথা’পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি স্থানীয় অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘সবার সংবাদ২৪ডটকমে’সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
শিশুসাংবাদিকতাকে আরো বেগবান করতে বিডিনিউজের মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তাকে ল্যাপটপ দিয়েছেন। পেয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের আরো নানা পুরস্কার। স্বল্প সময়েই তিনি করেছেন এতো সব অর্জন। তার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার। আর তাই তো পড়াশুনার ফাঁকে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিভা বিকাশের সংগ্রাম। তার ভাষায়, সাংবাদিকতা একধরনের নেশা। এই নেশা কখনো ছাড়ত পারবো না। সংবাদ করার মধ্য দিয়েই অগণিত পাঠকের ভালোবাসা পেতে চাই। সেই লক্ষেই কাজ করে চলছি, চলবো…।
তরুণ এ সাংবাদিকের জীবনের গল্প জানাচ্ছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
আমিনুর রহমান হৃদয়ের জন্ম ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। শৈশবের দিনগুলো কাটে সেখানেই। বাবা ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের প্রধান সহকারি এবং মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে তার স্থান দ্বিতীয়।
পড়ালেখা জীবন সম্পর্কে হৃদয়ের ভাষ্য, প্রাইমারি স্কুলজীবন তো প্রাইভেট, স্কুল ও বাড়ি - এই তিন জায়গার মধ্যেই বন্দি ছিল। আর হাইস্কুল জীবনের প্রথম ধাপ ৬ষ্ঠ শ্রেণী কেটেছে পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি হই। জেএসসি পরীক্ষায় এই স্কুল থেকেই অংশ নিই। বাড়ি ছেড়ে বেশি দিন থাকতে পারিনি ওই স্কুলে। ৯ম শ্রেণীর শেষ দিকে আবার চলে আসি নিজ উপজেলার পীরগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে অংশ নিয়ে জিপিএ ৪.৭২ পেয়েছি। বর্তমানে আমি পীরগঞ্জ সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ালেখা করছি।
সাংবাদিকতা শুরুর গল্পটা জানতে চাইলে হৃদয় জানালেন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় তার আব্বু কলেজ থেকে বাসায় দুইটা বই নিয়ে এসেছিলেন। বই দুটি লিখেছিলেন তাঁর আব্বুর কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। সেই বই পড়েই তার লেখালেখি করার আগ্রহ তৈরি হয়। বই দুটির একটি কবিতার, অন্যটি উপন্যাস। বই দুটি পড়ে হৃদয়ও লেখালেখি করার কথা ভাবেন। লেখালেখি করলে একদিন তারও বই বের হবে। যেমনি চিন্তা তেমনি কাজ। কয়েকজন বন্ধু মিলে বড়সড় আকারে বের করতে না পারলেও কম্পিউটার কম্পোজ করে বই প্রকাশ করেন। নাম দিলেন রংধনু ফান স্টোরি। ফান স্টোরির পর পর কয়েকটি সংখ্যা বের করেন। অনেকের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করে ছাপাতেন, পাশাপাশি নিজের লেখালেখি চালাতেন।
২০১২ সালে ফেসবুকে পরিচয় হয় শাওন আমিন নামে এক পত্রিকার সম্পাদকের সাথে। তিনিই হৃদয়কে তার ‘মাসিক গ্লামার’ পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দেন। এরপর কাজ করেন তারই সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ‘বাংলার আলো’নামে পত্রিকায়। এভাবেই শুরু হলো তার সাংবাদিকতায় পথ চলা। সাংবাদিকতার শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁর চাচা, আরটিভির স্টাফ রিপোর্টার জয়নাল আবেদীন বাবুল তাকে সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং তাকে সহযোগিতা করে আসছেন।
হৃদয় বলেন, নিজের আগ্রহেই এতদূর আসতে পেরেছি। আমার কোনো সংবাদ যখন পত্রিকায় ছাপানো হয় তখন খুব ভালো লাগে এবং নিজেকে সাংবাদিক সাংবাদিক মনে হয়। তবে প্রথমে পরিবারের কাছ থেকে সাড়া না পেলেও আমার লেখার মান দেখে এখন সবাই উৎসাহ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে। পরিবার থেকেও অনুমতি পেয়েছি।
শৈশবের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ছোটবেলায় অন্য সব শিশুর মতো তারও স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। আবার কখনো ভাবতেন ইঞ্জিনিয়ার হবেন। হৃদয় কোন বিষয়ে বেশি পারদর্শী সেটা আবিষ্কার করেন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পর। সাংবাদিকতা পেশায় যে তিনি ভালো কিছু করতে পারবেন এমন আত্মবিশ্বাস তার কয়েক বছরে কাজ করার পরই তৈরি হয়েছে।
ভবিষ্যতের পেশার বিষয়ে হৃদয়ের ভাষ্য, সবার দ্বারা কিন্তু সবকিছু সম্ভব না। সবাই সবকিছুতে ভালো করবে এমনটাও না। আমাদের সকলের উচিৎ নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করা। তাছাড়া পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা তো অন্য পাঁচটি পেশার তুলনায় যথেষ্ট ভালো। কারণ এখানে, সম্মান, সম্মানী, যশ-খ্যাতি সবই মেলে। নিজের প্রতিভা, যোগ্যতা, দক্ষতা প্রমাণ করার অনেক জায়গা রয়েছে এই পেশায়। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক।
সাংবাদিকতাকে আরেকটু শাণিত করতে বাংলাদেশ প্রেস ইনিস্টিটিউট(পিআইবি) থেকে তিনদিনের সাংবাদিক বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, মানবকল্যাণ পরিষদের গণমাধ্যম, স্থানীয় সরকার ও জেন্ডার শীর্ষক দুইদিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা করেছেন শিশু সাংবাদিক হৃদয়।
তিন বছর ধরে বিডিনিউজ২৪ডটকমের হ্যালোতে সাংবাদিকতা করছেন এই উদীয়মান সাংবাদিক। এই সময়ে সংবাদের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে নানান অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। বিডিনিউজের হ্যালোতে কাজ করতে গিয়ে নানান দিক নির্দেশনা পেয়েছেন বিডিনিউজের মহুয়া আপু, নাহার আপু ও প্লেটো দাদার কাছ থেকে। সরেজমিনে গিয়ে কীভাবে সংবাদ তৈরি করতে হয় এসব কলাকৌশল শিখিয়েছেন তারা। সরেজমিনে বা নিজে তথ্য যাচাই না করে কখনো সংবাদ তৈরি করেন না হৃদয়।
তিনি বলেন, ‘দিনে স্কুল খোলা থাকে তিন ঘণ্টা’, ‘ঘুষ দিয়ে নিয়মবহির্ভূত পার্কিং’‘শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তক কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ’, এরকম বেশ কয়েকটি সংবাদ বিডিনিউজের হ্যালোতে প্রকাশিত হওয়ার পর এলাকায় পরিচিতি বেড়েছে তার। এছাড়াও সুবিধাবঞ্চিত এক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হয় না মাদ্রাসায় - এই সংবাদটি করার পর মাদ্রাসার শিক্ষকরা এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শ্রেণিতে আলোচনা করেন। এসব ঘটনা তাকে কাজের ব্যাপারে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে বলে জানান হৃদয়।
সাংবাদিকতা জীবনের প্রাপ্তি বিষয়ে জানালেন, জাতীয় শিশু-কিশোর পত্রিকা হাতেখড়ি’র ২০১৬ সালের বর্ষ সেরা প্রতিনিধির সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এছাড়া কিছুদিন আগে হাতে-পায়ে শিকড়ের মতো রোগে ভোগা এক শিশুকে নিয়ে তার সংবাদ প্রকাশ হলে ওই শিশু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারিভাবে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ পায়। বৃক্ষবালক হিসেবে এখন সারা বাংলাদেশে ওই শিশু পরিচিত। এখনও শিশুটির চিকিৎসা চলছে। এছাড়া আমার লেখা সংবাদ পড়ে অনেকই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকেই এখন ফোনে এবং ফেসবুকে মেসেজে বলে, ভাইয়া আপনার সংবাদটা খুব ভালো হয়েছে। এমন ছোট ছোট মেসেজগুলো আমাকে এই পেশায় কাজ করতে আরো উৎসাহ জোগায়।
পড়াশুনার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছেন। দুটোকে চালিয়ে যেতে কেমন লাগছে জানতে চাইলে তরুণ সাংবাদিক বলেন, দুটাকেই বেশ উপভোগ করছি। তবে অনেক ব্যস্ততায় সময় কাটে। আমার ঢাকার বন্ধু সাদিক ইভান, আরিয়ান, নানজীবা খান, বড় ভাই সজিবুল হাসান,ছোট ভাই সাকিরসহ অনেকেই আমরা বিডিনিউজ২৪ডটকমে একসাথে কাজ করছি। সাংবাদিকতা আর পড়াশুনায় দিন কেটে যায়। বন্ধুদের সাথে তেমন আর আগের মতো আড্ডাও দিতে পারি না।
হৃদয় বলেন, অনেক বাধা উপেক্ষা করে সাংবাদিকতার পথ পাড়ি দিচ্ছি। তবে সাংবাদিকতার সুবাদে সরকারি-বেসরকারি অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথেই পরিচয় হয়েছে ও আন্তরিক সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। শুরুতে কথা বলতে ভয় পেতাম। এখন তো অনেক অনুষ্ঠানে বক্তব্যও দিতে হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও কোনো শিশুদের প্রোগ্রাম হলেই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
জীবনে এমন কোনো নিউজ করেছেন যার জন্য আপনাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে হৃদয় বলেন, ‘দিনে স্কুল খোলা থাকে ৩ঘন্টা’ এই শিরোনামে সংবাদ করার পর আমাকে এক শিক্ষক নেতা মারপিট করার হুমকিও দিয়েছিল। আমি অবশ্য আগে থেকেই জানতাম এইরকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এজন্য মানসিকভাবে নিজেকে সেভাবেই তৈরি করে রেখেছিলাম। আরেকটা সংবাদ ‘ঘুষ দিয়ে নিয়ম বহির্ভূত পার্কিং’। এক ট্রাফিক পুলিশের রিকুয়েস্ট উপেক্ষা করে সংবাদটি করেছিলাম। সংবাদ করার ক্ষেত্রে কারো সাথে কোনো আপস করিনি।
সাংবাদিকতা জীবনের মজার স্মৃতি বিষয়ে জানালেন, সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হন। মজার বিষয় হলো তার লেখা অনেকেই পড়ে কিন্তু তাকে কখনো দেখেনি। ভুলবশত তাকে মনে করে তার সামনেই আরেকজনকে বলে ভাই আপনি কি সাংবাদিক আমিনুর রহমান হৃদয়? ওই ব্যক্তি তখন তাকে দেখিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে এক স্কুলে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সেখানে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলছিলেন হৃদয়। এমন সময় একজন বলে উঠলো- ভাইয়া আপনি কি সাংবাদিক? তিনি বললেন হ্যাঁ ভাইয়া। আপনার নাম কি? তিনি তার নাম বললেন। তারপর ওই শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে অনেকেই বলে উঠলো, ভাইয়া আপনার নামই তাহলে আমিনুর রহমান হৃদয়। আপনার লেখা পড়েছি তো পত্রিকায়। আজই দেখার সৌভাগ্য হলো।
হৃদয় বলেন, প্রত্যেক মানুষের কিছু না কিছু বিশেষ প্রতিভা আছে যেটাতে সময় দিলে সে নিশ্চয়ই ভালো করবে। আর এই প্রতিভা নিজেকেই আবিষ্কার করতে হবে। আমি আমার প্রতিভা আবিষ্কার করেছি। আমার বিশ্বাস, আমি সাংবাদিকতায় ভালো কিছু করবো। দেশের উন্নয়নে তথা সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবো।
সাংবাদিকতা নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা করার ইচ্ছে আছে। আর পড়াশুনা শেষ করে সারাদেশ ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করবো। আর সাংবাদিকতার বাইরে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করবো।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী