সন্ধ্যা হলেই বালিশ নিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘোরাঘুরি। রাতে একদিনও নিজ বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। বাবা রাজনীতি করেন। সেজন্য ছেলের এ অবস্থা। বাবাও যে বাড়িতে ঘুমাতে পারতেন, বিষয়টা তা নয়! বাবা এক বাড়িতে, তো ছেলে অন্য বাড়িতে। একদিন দুদিন নয়। পুরো বিএনপির আমল। সেটা ২০০১ থেকে ২০০৬।
যার কথা বলছিলাম, তার নাম মো. মহিউদ্দিন মাহী। গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলায়। চাঁদখালী ইউনিয়নের ধামরাইল গ্রামে। মা মাজুদা খাতুন গৃহিনী। বড় ভাই মো. মশিউর রহমান কলেজের প্রভাষক। একমাত্র বোন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা।
বাবা মোশারেফ হোসেন মোড়ল। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। এজন্যই রাতে বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি দীর্ঘ ৫ বছর। আর চাঁদার দাবিতে চিঠি। সেতো প্রায়ই আসতো। এখন দল ক্ষমতায়। তবুও পুরোনো সেই গল্প করতে করতে মাহীর চোখে পানিই এসে গিয়েছিল। আসুন আজ শুনি মাহীর সেই দুর্দিনের গল্প।
ক্ষোভের সঙ্গে শুরু করলেন মাহী। বললেন, আমাদের পরিবারটি এলাকায় বেশ সভ্রান্ত ছিল। বাবার প্রায় শত বিঘা ফসলী জমি ছিল। এটাই কাল হয়েছিল। ছাত্রদল-শিবির প্রায়ই চিঠি দিয়ে চাঁদা নিতে আসতো। আমি ২০০১ সালে চাঁদখালী বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে এসএসসি পাস করলাম। ভর্তি হলাম পাইকগাছা কলেছে। তখনই বিএনপি ক্ষমতায় এলো। আর আমাদের এলাকাটা বিএনপি-জামায়াতের এলাকা হিসেবে পরিচিত।
আমাদের পরিবার আওয়ামী লীগ পরিবার। বাবা দেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমাদের এলাকাতে বাবাই আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক। সেজন্য বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাবার ওপর বেশ চাপ আসতে থাকে। পুলিশের কাছে গেলে বলতো বিএনপিতে যোগ দেন। আমাদের কিছু করার নেই। আওয়ামীলীগের জেলা, উপজেলা পর্যায়ের নেতারা সব নির্যাতনের শিকার, বিভিন্ন ধরনের মামলার আসামী।
ওরা (বিএনপি-শিবির)চাঁদাতো নিতোই আবার মাঝে মাঝে জমির ধানও কেটে নিয়ে যেত। রাতে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুমাতে হতো। শেষে আমাকে পাইকগাছা উপজেলা সদরে পাঠিয়ে দিলেন বাবা। খালাম্মার বাসায় থাকতাম। এই সময়টাতে লেখা-পড়ার দিকে নজর দিলাম। কিন্তু ঝামেলা তখনও পিছু ছাড়েনি। কলেজেও অনেক সমস্যা করতো। তখনকার দিনে ওই কলেজে ছাত্রলীগের নাম মুখেই আনা যেত না। তারমধ্যেই আমরা কয়েকজন ছাত্রলীগের সমর্থক ছিলাম কিন্তু কিছুই করার ছিল না।
আমাদের পুরো পরিবারটিকে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। পালিয়ে থেকে কোনো মতে এইচএসসি পাস করলাম। ২০০৩ সালের জুন মাসে ঢাকায় এলাম। কয়েকজন বন্ধু মিলে আনসার কাম্প, মীরপুর-১ এ একটি বাসা নিয়ে ৭ মাস কোচিং করলাম। ওই সময় তরুণ বাছাড়, পৃতিস, অনিমেষ আর আমি থাকতাম এক বাসায়। কোচিং করতাম ইউসিসিতে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। দুটাতেই চাঞ্চ পেয়েছিলাম। পরে ঢাবিতে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ভর্তি হলাম। উঠলাম মহসিন হলের ৬৫০, ৪৬৫ ও ২৫২ নম্বর রূমে।
শুরু হলো সেই একই সমস্যা। হলে থাকলে ছাত্রদলের মিছিলে যেতে হবে। মিছিল না করলে হলে থাকা যাবে না। আমি বলতাম ভাই আমি পড়াশুনা করতে এসেছি। মিছিলে যাওয়া সম্ভব না। কে শোনে কার কথা। হলে থাকবি। মিছিলে যাবি না। তা হবে না।
একদিনতো বলেই ফেললাম। আমি আওয়ামী পরিবারের সন্তান। তোমাদের মিছিলে আমি যাব না। তখন আমার ওপর কালো মেঘ এসে নামে। একমাত্র পাশে ছিলেন রিপনভাই, মাইদুল ভাই ও মাস রিক ভাই। আমার সাথের কয়েকজনকে ছাত্রলীগ উপাধি দিয়ে হল থেকে বের করে দিয়েছিল। আমি কোনো মতে থেকে পাস করে আসি।
হলের রাজনীতি কি এখনো তেমনি আছে? যেমন ছিল বিএনপি আমলে? জবাবে মাহী বলেন, না ছাত্রদলের চেয়ে ছাত্রলীগ অনেক ভাল। ওরাতো লেখাপড়াই করে না। ছাত্রদলের মধ্যে যারা আছে তারা ছাত্র নয়। ক্যাম্পাসে আসবে কি করে?
সরকার পরিবর্তন হয়। নেতা পরিবর্তন হয়। কিন্তু কর্মী যারা ছিল তারাই থেকে যায়। কিছু সুবিধাবাদী মানুষ চরিত্র পরিবর্তন করে পদ দখল করেন। এসব গল্প করে লাভ নেই। সুবিধাবাদিরা সব সময়ই সুবিধা নিয়ে চলে।
আপনার দুর্দিনে কারা আপনাকে বেশি সহায়তা করেছিলেন? হ্যাঁ এমন বেশ কয়েকজন আছেন। তাদের মধ্যে আআমস আরেফিন স্যার (ঢাবি ভিসি), জগন্নাথের বর্তমান ভিসি ড. মিজানুর রহমান স্যার, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারী, বদিউজ্জামান সোহাগ, মাস রিক হাসান মেহেদী, নাজমা শাহীন, হলের প্রোভোস্ট আলী আক্কাস স্যার।
পাস করার পর কি করলেন? বাবা মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি ডাক্তার হই। কিন্তু আমি সব সময় ভাবতাম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবো। সেজন্য আমি পাস করার পর জগন্নাথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি। অবশেষে ২০১৩ সালের ১৩ মে জনগন্নাথে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে যোগদান করি।
বিয়ে-শাদীতো নিশ্চয়ই করেছেন? হ্যাঁ, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বিবাহ করি। আমার স্ত্রীর নাম সামশাদ নওরীণ। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক। বাড়ী ঢাকার মধ্য বাড্ডায়।
আপনিতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তো জগন্নাথ নিয়ে কিছু বলবেন কি?
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বিবেচনায় এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত কোনো সুযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১০ হাজার শিক্ষার্থী। অথচ ক্যাম্পাস জগন্নাথের তুলনায় অনেক বড়। আর জগন্নাথে ২২ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য একটি হলতো দূরের কথা। যে ক্যাম্পাসটি আছে সেটিকে আসলে ক্যাম্পাস বলা যায় না। মাননীয় উপাচার্যের ও মেধাবী শিক্ষকদের চেষ্টায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জবির শিক্ষা কার্যক্রম ঈর্ষনিও পর্যায়ে পৌছাচ্ছে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫০ জন শিক্ষক আছেন। তাদের জন্যও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত তেমন কোনো সুযোগ সুবিধা নেই। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়। তাই যেখানে এটি আছে সেখান থেকে পুরোপুরি না সরিয়ে, এটাকে প্রশাসনিক কাজের জন্য রেখে, নদীর ওপারে কেরাণীগঞ্জের কোথাও একটি একাডেমিক ক্যাম্পাস করা যেতে পারে। সেখানে বড় জায়গা নিয়ে ছাত্রদের থাকার হোস্টেলও করা যাবে।
কিছু দিন পূর্বে জগন্নাথের হল উদ্ধারের তোরজোর হয়েছিল। এটা থেমে গেল কেন?যা সব জায়গায় হয়। এখানেও তাই হয়েছে। প্রভাবশালীরা দখল করে আছেন। তাই সে আন্দোলন সফল হয়নি।
জগন্নাথের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলবেন? হ্যাঁ গত বছর ২০১৩-২০১৪ সেশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ জন শিক্ষক বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এটা ভাল দিক। একই সঙ্গে গবেষণার জন্য জগন্নাথে আরো বরাদ্দ দরকার। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখছে। সে বিবেচনায় জগন্নাথের গবেষণা কাজের দিকে নজর দেয়া দরকার।
বিবার্তা/মহসিন