যেখানে থাকা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। কোনো অভিভাবক নেই। সেখানে আবার লেখাপড়া। সে কি করে সম্ভব? সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছেন সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত গ্রামের মেধাবী ছাত্র হাবিবুল্লাহ। ছোট বেলায় মা- মারা যান। আশ্রয় নেন বোনের বাড়িতে। কয়েক বছর না যেতেই বোনেরও বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। হাবিবুল্লাহ পড়ে যান মহাবিপদে। কিন্তু হাল ছাড়েননি তার বোন। একমাত্র ছোট ভাইকে উৎসাহ দেন তিনি। অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছোট ভাইকে লেখাপড়ার খরচ দেন। সেই হাবিবুল্লাহ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আজ শুনবো হাবিবুল্লাহর ঢাবিতে ভর্তির সেই গল্প।
১৯৯৮ সালে জন্ম হাবিবুল্লাহর। পিতা রশিদ হাওলাদার। মাতা মরিয়ম বেগম। গ্রাম: ভায়রা, উপজেলা: তালা, জেলা: সাতক্ষীরা। জন্মের ২ বছর পর মা মারা যান। পিতা আবার বিবাহ করেন। সংসারে কদর কমে যায় হাবিবুল্লাহ আর একমাত্র বোন তাসলিমা বেগমের।
প্রেম করে এক ধনির দুলালের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাসলিমা। আলাদা বাসা নিয়ে থাকতেন তারা। হাবিবুল্লাহও থাকতেন বোনের বাসায়। লেখা-পড়াও চলছিল। কিন্তু বিধিবাম। দুলাভাইর পরিবার তাদের এ বিয়ে মেনে নেয়নি। কয়েক বছর পর বোনকে ছেড়ে দেয় দুলাভাই মামুন। এবার দুই-ভাই বোনের আর কোনো আশ্রয় নেই।
বোন তাসলিমা, ভাই হাবিবুল্লাহকে বললো, তুই লেখাপড়া কর। অন্তত এসএসসি পাসটা করতে পারলেও কম কিসে। আমি কাজ করবো মানুষের বাড়িতে। যেভাবে হোক, তুই পড়ালেখা ছাড়বি না। দুই ভাই বোন মিলে একটি বাসা নিয়ে থাকা শুরু।
শুনি হাবিবুল্লাহর মুখে। আমি সাহাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। সেখান থেকে ৫ শ্রেণিত এ-প্লাস পেলাম। এর আগে ওই স্কুল থেকে আর কোনো ছাত্র এ-প্লাস পায়নি। আমি এ-প্লাস পাওয়ার পর সবাই আমার দিকে নজর দেন। এরপর সাহাপুর সিরাজউদ্দীন গাজী স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ওই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক আজিজুর রহমান স্যার আমাকে সহায়তা করেন। তিনি আমাকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করে দেন।
ওখান থেকে এসএসসি পাস করি। স্কুলের সব স্যারই আমাকে ভাল বাসতেন। বেতনতো লাগতোই না, বরং বই, খাতা, কলমও স্যাররা কিনে দিতেন। এসএসসির পরে আরো লেখাপড়া করবো তা বুঝতে পারিনি। কিন্তু স্যারদের অনুপ্রেরণায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজে ভর্তি হই।
কলেজের অধ্যক্ষ এনামুল ইসলাম স্যার আমাকে সাহস দিলেন। কলেজে পড়া ফ্রি করে দিলেন। একটা জাপানি বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন। প্রতি মাসে ১২ ডলার পেতাম। কলেজে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন মশিউর রহমান স্যার। তিনিই আমার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন।
তিনি সব সময় আমাকে উৎসাহ দিতেন। বলতেন তুমি ভাল ছাত্র। লেখাপড়া ভালভাবে করো। জীবনে অনেক বড় হতে হবে। তার কথামতো সারাক্ষণ লেখাপড়াই করতাম।
মশিউর স্যার শফিকুর রহমান নামের একজনকে ঠিক করে দিলেন। যিনি প্রতিমাসে আমাকে ১হাজার টাকা দিতেন। কলেজে পড়ার জন্য যত বই খাতা কলম লাগতো সব কিনে দিতেন।
শফিকুর রহমান কে? জানতে চাইলে হাবিবুল্লাহ বলেন, আমি তাকে চিনি না। তিনি ঢাকায় থাকেন। স্যারের পরিচিত।
হাবিুল্লাহ আবার বলতে শুরু করলেন। ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। এ প্লাস পেয়ে পাস করলাম। মশিউর স্যার বললেন, তোমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু আমারতো সেরকম কোনো সামর্থ নেই। স্যার আমাকে ঢাকায় পাঠালেন। শফিকুর রহমান সাহেব ৫ হাজার টাকা দিলেন। সেই টাকা নিয়ে ঢাকায় এলাম। বিএম সেলিম হোসেন নামে আমাদের এলাকার এক ভাই এফ রহমান হলে থাকেন। তার রূমে উঠলাম। সেখানে থেকেই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম।
ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার জন্যতো অনেকে কোচিং করে। তো আপনি সেরকম কিছু করলেন না?
না আমি কোনো কোচিং করিনি। কলেজের বইতে ৩ বছর যা পড়েছি, সবই ভর্তি পরীক্ষায় এসেছে। আমার কাছে ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা খুব একটা কঠিন মনে হয়নি। ‘গ’ ইউনিটে পরীক্ষা দিয়ে ২ শ নম্বরের মধ্যে ১৬৩.৭৬ নম্বর পাই। মেধা তালিকায় আমার সিরিয়াল ছিল ৫১৬।
ভর্তি পরীক্ষায় পাস করার পর আবার সমস্যায় পড়লাম। ভর্তিতেতো কিছু টাকা লাগবে। তাতো আমার নেই। তখন ঢাকাস্থ তালা উপজেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মারুফ-উল-ইসলাম ভাই এগিয়ে আসনে। তিনি আমাকে বলেন, তোমার ভর্তিতে যে টাকা লাগবে তা আমরা ম্যানেজ করে দেব।
কথা অনুযায়ী তালা উপজেলা ছাত্র কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে আমাকে ১৬ হাজার টাকা দেয়া হয়। সমিতির সাংগঠনিক উপদেষ্টা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের প্রভাষক শেখ আলমগীর হোসেন আমার হাতে এই টাকা দেন। এটার জন্য আমি ওই সংগঠনের সভাপতি শেখ ইকবাল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক এম এম মারুফ -উল-ইসলাম ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ।
হাবিবুল্লাহ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এর পরে আরো গল্প আছে।
শুনবো সেটাও। হাবিবুল্লাহর এই ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি বিবার্তা২৪.নেট এর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান একটি প্রতিবেদন পাঠান বিবার্তায়। এটি গত ১৬ নভেম্বর প্রকাশ হয়। তখন বিষয়টি বিবার্তার চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মজিব উদ্দিন আহমেদ এর নজরে আসে। তিনি হাবিবুল্লাকে নিজ কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান।
হাবিবুল্লাহ দেখা করেন ড. মজিব উদ্দিনের সঙ্গে। তার সাথে ছিলেন ঢাকাস্থ তালা উপজেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এম মারুফ -উল-ইসলাম।
ড. মজিব উদ্দিন হাবিবুল্লাহর পড়াশুনার দায়িত্ব নেন। তিনি হাবিবুল্লাহকে বলেন, তোমার লেখাপড়ার খরচ বাবদ যা লাগবে আমি দেব। টাকা পয়সার চিন্তা করতে হবে না, পড়াশুনাই হবে তোমার একমাত্র কাজ। পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হও, এটাই আমি চাই।
হাবিবুল্লাহ বললেন, আমি সাতক্ষীরায় যেমন মশিউর স্যারের ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছিলাম। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিব স্যারের আশ্রয় পেয়েছি। এজন্য বিবার্তার সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ও তালা উপজেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মারুফের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
গল্প এখানেই শেষ নয়। আজ হয়তো শেষ। কিন্তু আবারো শুরু হবে। সেদিন এই হাবিবুল্লাহ এরকম থাকবেন না। হবে অনেক পরিবর্তন। আমরা অপেক্ষায় রইলাম। হাবিবুল্লাহর সুদিনের সেই গল্প শোনার। পাঠক আপনারাও অপেক্ষায় থাকুন।
বিবার্তা/মহসিন