ফেরিওয়ালা থেকে অভিনেতা

ফেরিওয়ালা থেকে অভিনেতা
প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫, ১১:২০:২০
ফেরিওয়ালা থেকে অভিনেতা
কৃষ্ণ ভৌমিক
প্রিন্ট অ-অ+
দারিদ্র্যতার কারণে ১৯৯৮ সালে পাবনা থেকে কাজের সন্ধানে ঢাকায় আসেন মোসলেম উদ্দিন। ঢাকায় এসে তিনি সিকিউরিটি গার্ড ও ফেরিওয়ালার পেশা বেছে নেন। কর্মসূত্রে তার সাথে এফডিসির ২-৩ জন কর্মচারির সখ্যতা গড়ে ওঠে। তাদের সহায়তায় এফডিসির কয়েকটি ছবিতে তিনি ছোট খাটো চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। 
 
এভাবে চলার পর এফডিসি থেকে মোসলেম উদ্দিন জানতে পারেন, অডিও ভিশন নামক একটি  প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসাভিত্তিক ‘মাটির ময়না’ ছবি করতে যাচ্ছেন। সেখানে একজন হেড মওলানা পদে অভিনেতা দরকার। তাদের কাছ থেকে ঠিকানা যোগার করে পর দিন মোসলেম উদ্দিন সাহস করে মনিপুরী পাড়ার অফিসে হাজির হন। সেখানে অডিও ভিশনের স্বত্বাধিকারি তারেক মাসুদের সাথে তার পরিচয় হয়। তিনি মাটির ময়নায় হেড মওলানার চরিত্রে অভিনয় করতে চান জানালে তারেক  মাসুদ পর দিন আসতে বলেন। 
 
পরে দেখা করার পর তারেক মাসুদ তাকে নিয়মিত অফিসে আসা যাওয়া করতে বলেন। তারেক মাসুদ তাকে নিয়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় ছাত্রদের আচার আচরণ শেখানোসহ ইসলামী নিয়মনীতি ও স্ক্রীপ্ট মুখস্ত করান। এভাবে দু’মাস প্রশিক্ষণ দিয়ে আমিনবাজার, কেরানীগঞ্জ ও শফিপুরের লোকেশনে বারবার তাকে নিয়ে তারেক মাসুদ ঘুরে বেড়ান। এরইমধ্যে মোসলেম উদ্দিনের সাথে তারেক মাসুদের ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়। তারেক মাসুদ তাকে নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন। বাড়িতে থাকার সুবাদে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদও তাকে ওই বাড়ির একজন সদস্য হিসেবে মনে করেণ। 
 
এরপর তারেক মাসুদ ‘মাটির ময়না’ ছবিতে হেড মওলানা বাকী উল্লার চরিত্রে মোসলেম উদ্দিনকে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। কিন্তু বিগত ৪ দলীয়জোট সরকার মাটির ময়না ছবিটির সেন্সর আটকে দেয়। পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এ ছবিটির সেন্সর সার্টিফিকেট দেয়। মাটির ময়না কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া মাটির ময়না বাংলাদেশের প্রথম বাংলা ছবি যা অস্কার প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়। ভারত, পাকিস্তান, মরক্কোসহ ৪০টি দেশে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। এ ছবির জন্যই তারেক মাসুদ একুশে পদক লাভ করেন। 
 
এরপর তারেক মাসুদ এরপর ‘রানওয়ে’ ছবির কাজে হাত দেন। ২০১০ সালে রানওয়ে মুক্তি পায়। তালেবানভিত্তিক এ ছবিটিতে জঙ্গিবাদের লিডার বাংলা ভাই’র আদলে নাম রাখা হয় উর্দু ভাই। উর্দু ভাই চরিত্রে কোন পেশাদার অভিনেতা পাওয়া যায়নি। তাই তারেক মাসুদ উর্দু ভাই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মোসলেম উদ্দিনকে মনোনীত করেন। উর্দু ভাই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তাকে আরবী, উর্দু ভাষাসহ দোয়া কালাম শিখতে হয়েছিল। সিরাজগঞ্জ যমুনা সেতুর নীচে দীর্ঘদিন জঙ্গীবাদের ট্রেনিং দেয়ার শুটিং করতে হয়েছিল। কেরানীগঞ্জ সিনেমা হল উড়ানোসহ বিভিন্ন মাদ্রাসা মসজিদে আস্তানার শুটিং করতে হয়েছিল। কাজ পাগল তারেক মাসুদের কোন ক্লান্তি ছিল না। রাত ৩টার সময়ও শুটিং করতে বেড় হতেন। 
 
একপর্যায়ে এ নিয়ে ঝগড়ার জেরে শুটিং থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন মোসলেম উদ্দিন। তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের হস্তক্ষেপে আবার সব কিছু মিটমাট হয়। তারেক মাসুদ প্রফেশনাল অভিনেতা দিয়ে ছবি করতেন না। রাস্তার লোক ধরে এনে ছবিতে কাজ করাতেন। মাটির ময়নায় লঞ্চের মধ্যে যে ভিক্ষুক ভিক্ষা করেন তিনিও ছিলেন বাস্তবে একজন ভিক্ষুক। রানওয়েতে আরো অভিনয় করেছেন মোহম্মদপুরের টোকাই ক্লাবের সদস্য ও সিরাজগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। রংপুর থেকে সাধারণ একজন মহিলাকে নিয়ে এসে তিনি অভিনয় করান। মাটির ময়নায় যে শিশু শিল্পী অভিনয়ের জন্য পুরষ্কার পায় সে ছিল বাস্তবে লেগুনার হেলপার ও পকেটমার। তার পিতা ছিলেন চা দোকানি। আদম শুরত, মুক্তির কথা, নরসুন্দর চলচ্চিত্রেও তিনি পেশাদার অভিনেতা দিয়ে অভিনয় করাননি। 
 
এভাবেই তারেক মাসুদের সাথে মোসলেম উদ্দিনের সম্পর্ক গভীরে পৌছে যায়। এমনকি তিনি পারিবারিক, আর্থিক বিষয় নিয়েও তার সাথে শেয়ার করতেন। পরামর্শ দিতেন ও নিতেন। কিছু কিছু বিষয়ে দু’জনের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকলেও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি বাণিজ্যিক ছবি করতেন না। কিন্তু রানওয়ে ছবি করতে গিয়ে তারেক মাসুদ বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ করেন। ঋণের টাকা দিয়ে ছবি করা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তারেক মাসুদ বলেছিলেন, আমার কিছু থাক আর না থাক- জাল ফেলেছি টেকনাফে মাছ তুলবো তেতুলিয়ায়। 
 
তারেক মাসুদ ছবিতে পেশাদারি অভিনেতা না নিলেও বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণে বিদেশী টেকনিশিয়ান কাজে লাগাতেন। মাটির ময়না ছবিতে টেকনিশিয়ান ছিলেন ভারতীয় নিয়োগী ও বরকত, ফ্রান্সের  সিলভা ও গেতাং। 
 
সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদের অকালে চলে যাওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মোসলেম উদ্দিনে। তিনি জানান, অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী দেশপ্রেমে উজ্জীবিত মানুষ ছিলেন তারেক মাসুদ। মাটির ময়নার কাহিনী ও গান তার নিজেরই লেখা। তারেক মাসুদের কথা যখন মনে পড়ে তখন ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তার কবরে চলে যান। ওর কবর স্থানে পাবনা থেকে ওষুধী গাছের চারা নিয়ে লাগিয়েছি। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মোসলেম উদ্দিন অত্যন্ত সাধাসিধে বাউল মনের মানুষ। তিনি নিজ হাতে ইট শুরকি দিয়ে তার কবর তৈরী করে রেখেছেন পাবনা শহরের অদুরবর্তী মালিগাছা ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামে। 
 
তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর মোসলেম উদ্দিন সংসার জীবনের প্রতি উদাসিন হয়ে পরেন। তিনি বর্তমানে ঝিনাইদহ, সাতক্ষিরার ছয়ঘরিয়া, নাটরের মহানন্দাগাছা, পাবনার সিড গোডাউন, ঢাকার বিভিন্ন আস্তানায় ভাবসঙ্গিত ও লালনগীতি গেয়ে সময় কাটাচ্ছেন।
 
বিবার্তা/কৃষ্ণ ভৌমিক/যুথি
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com