ক্লাস ফাঁকি দিয়ে খেলার মাঠে কখন যাবেন সেই চিন্তায় থাকতেন আব্দুল্লাহ আল মুনীম। বাবার বকা খেয়ে পালিয়ে বেড়ানো। মায়ের আঁচলে ঠাঁই পাওয়া। এসব ছিল মুনীমের নিত্যদিনের ঘটনা। দূরন্ত কৈশর আর শৈশবে কখনোই স্কুলের পুরো ক্লাস করেননি। কি প্রাইমারী আর কি হাই স্কুল। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে মাঠে না গেলে পেটের ভাত হজমই হতো না। সেই আব্দুল্লাহ আল মুনীম এখন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।কিভাবে সম্ভব হলো? আজ শুনবো মুনীমের সেই গল্প।
মুনীম এসেছিলেন বিবার্তা২৪.নেট অফিসে। গল্প করেছেন দীর্ঘ সময়। বার্তা সম্পাদক মো. মহসিন হোসেনের সঙ্গে।
কখনো কী ভেবেছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষক হবেন? না এমনটি কখনো ভাবিনি। তবে পরিবারের সদস্যদের একটিই চাওয়া ছিল, আমি যেন ঢাবিতে পড়ালেখা করি। আমি চেয়েছিলাম সিএ পড়তে। কিন্তু পরিবারের সকলের চাপের মুখেই ঢাবিতে পড়তে এসেছিলাম। তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত কখনোই ভাবিনি আমি এখানে শিক্ষকতা করবো। তবে চতুর্থ বর্ষের রেজাল্ট ভাল হওয়ার পর অবশ্য বিষয়টা মাথায় এসেছিল।
আসুন এবার মুনীমের কৈশর আর শৈশবের গল্প শুনি। শুনবো তার মুখেই…
ব্যবসায়ী পিতা মোশাররফ হোসেন ও গৃহিনী মা আঞ্জুয়ারা বেগমের ছোট ছেলে আমি। বোন আশরাফুন্নাহার মুনমুন ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন দুজনই আমার বড়।পরিবারের ছোট হওয়ায় একটু আদরের ছিলাম। স্বাভাবিক কারণেই দুরন্তপনাও একটু বেশি করতাম।
আমার গ্রামের বাড়ি উত্তর বুরুজ বাগান। এটি যশোর জেলার শার্শা থানার নাভারণে। এখানেই আমার বেড়েওঠা। লেখাপড়ার শুরু মাটিকুমরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখান থেকে ৫ম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিলাম। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম বেনাপোল হাই স্কুলে। পরে ৮ম শ্রেণিতে ভর্তি হই নাভারনের শেখ আকিজ উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ে। এর মাঝে বেনাপোল রেসিডেনসিয়াল ইনস্টিটিউটেও লেখাপড়া করেছি।
শেখ আকিজ উচ্চ বিদ্যালয় হতে অষ্টম শ্রেণিতেও বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই বছর বাবার অসুস্থতার কারণে ফলাফল ভাল হয়নি। আমার অনেক ইচ্ছা ছিল ক্যাডেট কলেজে লেখাপড়া করার। কিন্তু যে বছর আমি ৭ম শ্রেণিতে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ওই বছর বাবা স্ট্রোক করেন। ফলে আর ক্যাডেটে ভর্তি হওয়া হলো না। শেখ আকিজ উদ্দীন স্কুল থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিলাম।
প্রাইমারী ও হাই স্কুলে পড়ার সময় আমি আসলে কখনোই ঠিক মতো ক্লাস করতাম না। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট ও কেরাম খেলতাম। এজন্য বাবা অনেক শাসন করেছেন। কিন্তু মায়ের কারণে বেঁচে যেতাম। আমার বাবা ছিলেন খুব কঠিন মানুষ কিন্তু তার বিপরিতে মা ছিলেন খু্বই নরম মনের। এতে আমরা বড় ধরণের অন্যায় করলেও মায়ের কারণে পার পেয়ে যেতাম।
স্কুলে পড়ার সময় কোন কোন স্যার আপনাকে বেশি ভালবাসতেন বা সহায়তা করতেন?
আমার স্কুলের তিন জন স্যার ও একজন ম্যাডামের কথা না বললেই নয়। নজরুল ইসলাম স্যার, মুজিবুর রহমান স্যার, লিটন স্যার ও শীলা ম্যাডাম আমাকে বেশি ভালবাসতেন। পড়াশুনার ব্যাপারে সব সময় নজরদারি করতেন। তাদের পরামর্শেই আমি মূলত ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়াশুনা করেছিলাম।
২০০৫ সালে এ প্লাস পেয়ে এসএসসি পাস করলাম। তারপর যশোর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজে ভর্তি হলাম। এইচএসসিতেও ওই কলেজ থেকে এ প্লাস পেয়েছিলাম।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিলাম। এর ফাঁকে অবশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলাম।
ঢাবিতে ভর্তির ব্যাপারে আমার এক কাজিন হাবিবুর রহমান আমাকে সহায়তা করেছেন। যশোর থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে বড় ভাই এর বাসায় উঠেছিলাম। পরে মীরপুর-১০ নম্বরে বন্ধুদের মেচে চলে যাই। ওখানে থেকে ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেই। তখন আমার বড় ভাই শেখ বোরহানউদ্দীন কলেজে পড়তেন।
ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষার আগে যশোরে একবার বড় ধরনের দুর্ঘটনায় পতিত হই। আমি নিজেই মোটর সাইকেল চালানোর সময় এই দুর্ঘটনা ঘটে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম।
এজন্য ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় ভাল প্রস্তুতি ছাড়াই অংশ নিতে হয়। অবশ্য সি-ইউনিটে চান্স পেয়ে যাই। ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ভর্তি হই। যদিও ইচ্ছা ছিল সিএ পড়ার। কিন্তু বাবা-মা, ভাই-বোনের ইচ্ছা আমি ঢাবিতে পড়ি। তাদের কারণেই এখানে ভর্তি হওয়া।
আপনি বলেছেন, ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষার আগে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার কারণে ভালভাবে প্রস্তুতি নিতে পারেননি। ঢাবির ভর্তি পরীক্ষাটা কী কঠিন মনে হয়েছিল?
না ভর্তি পরীক্ষা ততটা কঠিন মনে হয়নি। কলেজে যেসব বিষয়ে পড়াশুনা করেছিলাম, সেখান থেকেই প্রশ্ন এসেছিল। তবে বাংলায় একটু সমস্যা হয়েছিল। কিন্তু চান্স পেয়েছিলাম একবারেই।
আপনি যখন ঢাবিতে ভর্তি হলেন তার আগে বা পরে কখনো কী ভেবেছেন যে আপনি এখানে শিক্ষকতা করবেন?
না এমনটা কখনোই ভাবিনি। আমি যে ঢাবির শিক্ষক হবো সেটা মাথায় ছিল না। তবে চতুর্থ বর্ষের রেজাল্টের পর এটা নিয়ে ভাবা শুরু করি। তারপর চিন্তা করলাম রেজাল্ট আরো ভাল করতে হবে। অবশ্য অনার্স শেষ হওয়ার পর হোটেল ওয়েস্টিনে ইন্টার্নশিপে জয়েন করেছিলাম। ওয়েস্টিনে জয়েন করার পর এই প্রফেশনটাই ভাল লাগলো। ভাবলাম ট্যুরিজমেই ক্যারিয়ার গড়বো। এই লক্ষ্যে কাজ করতে থাকলাম।
অনার্সে ভাল করার পর পড়াশুনা একটু বেশি করতে লাগলাম। শেষে মাস্টার্স-এ যুগ্মভাবে আমরা দু’জন ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম।
২০১৪ সালে স্টারউড হোটেল এন্ড রিসোর্টের প্রতিষ্ঠান ফোর পয়েন্টস বাই শেরাটন ঢাকায় জয়েন করি। সেখানে জিএসএ পদে জয়েন করে পরবর্তীতে প্রমোশন পেয়ে ফ্রন্ট অফিসে টিম লিডার হয়েছিলাম। ১৫ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সেখানে কাজ করেছিলাম।
১৫ সালের মার্চে ঢাবিতে সার্কুলার হয়। মাস্টার্সের রেজাল্ট যেহেতু ভাল ছিল তাই আবেদন করলাম। অবশেষে ২ আগস্ট ঢাবিতে জয়েন করি। বর্তমানে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা করছি।
দীর্ঘ গল্প তো শোনালেন। এবার বলেন, ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না অথবা এখন জড়িত আছেন কি না?
আসলে আমি কখনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হইনি। না ছাত্র জীবনে না কর্ম জীবনে। তবে আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুণে বরাবরই তার প্রতি দুর্বলতা ছিল। আমার বাবাও রাজনীতি করেন না। পেছনে একটা বড় কারণও আছে। আমার মেঝ চাচা শহীদ মোস্তফা খান মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। আজ পর্যন্ত তার লাশটিও পাওয়া যায়নি। আমার দাদী মৃর্ত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ছেলে ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন।
চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এ খবর জানতে পেরে পাক আর্মিরা আমার দাদীকে মারধর করেছিল। আমার বড় চাচা গোলাম মোর্শেদ খানও একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
বড় হয়ে যখন মেঝ চাচা ও বড় চাচার গল্প শুনলাম তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতি চরম ঘৃনা জমে। সেই থেকেই ভাবতাম যারা আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, স্বাধীনতায় বিরোধীতা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, কখনোই তাদের সমর্থন করবো না। কেউ ওদের পক্ষে থাকতে পারে না।
বিবার্তা/এমহোসেন