হাফেজ আহম্মদ। পিতা আব্দুল হান্নান কামালী আর মাতা মেহেরুন্নেসা। দুই ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছোট। পিতা গাজীপুর রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত উর্ধতন কর্মকর্তা। মাতা গৃহিনী। বগুড়া জেলার সাড়িয়াকান্দি উপজেলার রোহাদহ গ্রামে তাদের বসবাস।
পিতার চাকরি সূত্রেই হাফেজ আহম্মদের জন্ম গাজীপুরে। ৬ মাস বয়সে মায়ের অসুস্থতার কারণে বগুড়ায় বড় খালার কাছে থাকতে হয় দেড় বছর। পরে আবার পিতা-মাতার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হয় বগুড়ায় ফুপুর কাছে। সেখানে ৬ বছর কাটানোর পরে চলে যান পিতা-মাতার ভালোবাসার আশ্রয়ে। দীর্ঘ ৬ বছর পরে দেখা হয় পিতা-মাতার সঙ্গে। এরপর রয়েছে তার জীবনের অনেক ঘটনা। বিবার্তা২৪.নেটের পাঠকদের হাফেজ আহম্মদের জীবনের সে ঘটনা শোনাবো আজ।
গতকাল (মঙ্গলবার) সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম বাংলাদেশের অন্যতম সেরা মার্কেট অনলাইন নিউজপোর্টাল আইটি টেকনোলজি ইনস্টিটিউট অরেঞ্জবিডির অফিসে। কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির আইটি ডিরেক্টর হাফেজ আহম্মদের সঙ্গে। অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাদামাটা জীবনযাপনকারী হাফেজ আহম্মদ অনেকক্ষণ জীবনের গল্প বলেন বিবার্তা২৪.নেটের প্রতিবেদক উজ্জ্বল গমেজের সঙ্গে। আইটি ইঞ্জিনিয়ার হাফেজ একান্ত আলাপে বলেন তার জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রামের কথা।
আপনি তো অরেঞ্জবিডির আইটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। আপনার আজকের এই সাফল্যের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন?
আমার জীবনের যা কিছু অর্জন, আমি আজ যা হয়েছি সবই আমার আব্বার জন্য হতে পেরেছি। তিনিই আমার সব। ছোটবেলায় আমার আব্বার স্বপ্ন ছিল আমি যেন বড় হয়ে সাইন্স নিয়ে পড়ালেখা করি। ভালো কিছু করে সুন্দরভাবে জীবন গড়তে পারি। তারই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করি সফলভাবে। এরপর ভর্তি হই ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি চট্টগ্রামে। সেখান থেকে কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করি।
আপনার কলেজ ও ক্যাম্পাস জীবন কোথায় কাটালেন?
আমি থাকতাম গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কলোনিতে। সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে কলেজের গাড়িতে করে যেতাম। আবার কলেজ শেষে গাজীপুরে ফিরতাম। ভার্সিটির জীবনটা অনেক মজার ছিল। বন্ধু-বান্ধব অনেক ভালো ও আন্তরিক ছিল। সবাই অনেক আপন করে নিয়েছিল আমাকে।
একনাগাড়ে হাফেজ বলে চললেন তিনি তার ক্যাম্পাস জীবনের রঙিন দিনগুলোর কথা।
আমি ভার্সিটিতে কম্পিউটার বিষয়ে অনেক আগ্রহী ছিলাম। বিশেষ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামের ভাষাগুলো আমাকে ভীষণ টানতো। চুম্বকের মতো আমাকে আকর্ষণ করতো বিষয়টি। আগে আমার কাছে পড়াশুনা বিরক্ত মনে হতো। ভালো লাগতো না। এখন সারাদিন ক্লাস করার পরেও রাতে আমার ক্লাস এসাইনমেন্ট করে আবার বন্ধুদের অ্যাসাইনমেন্ট করে দিতাম। আমার কোনো ক্লান্তি লাগতো না। আমার মনে শুধু কম্পিউটার প্রোগ্রাম জানার তৃষ্ণা কাজ করতো। সেই নেশায় খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে শুধু কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকতাম। সেই থেকেই আমার মাথায় প্ল্যান ছিল পড়ালেখা শেষ করে একটা বিজনেস শুরু করব।
আপনার শৈশব-বাল্যকালে কলোনিতে বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা বলুন। একথা শুনে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখে হঠাৎই ফুটে ওঠে কষ্টের রেখা। মলিন মুখে বলে চললেন তার জীবনের কষ্টের কথা।
আমার আব্বার চাকরির সুবাদে জন্ম গাজীপুরে। আমার বয়স যখন ৬ মাস তখন আমার আম্মার শরীর আগুনে পুড়ে যায়। আম্মার অসুস্থতার কারণে আমাকে লালন-পালনের জন্য দেয়া হয় আমার বড় খালার কাছে। এরপর দেড় বছর বয়সে তার কাছ থেকে আবার রাখা হয় ফুপুর কাছে। সেখানে ৬ বছর কাটানোর পরে আমাকে নিয়ে আসা হয় জন্মস্থান গাজীপুরে পিতা-মাতার আশ্রয়ে।
তিনি বলেন, গাজীপুরে কলোনিতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করি। পড়ালেখার প্রতি কোনোদিনই আমার আকর্ষণ ছিল না। ভালো লাগত না। আমি ছেলে হিসেবে অস্থির মনের ছিলাম। যখন যা মনে আসতো তাই করতাম। অনেকটা আবেগেরবশে চলতাম। তাই পড়াশুনার রেজাল্ট বেশি ভালো করতে পারিনি। তবে কলোনির জীবনটা অনেক মিস করি এখন। আমি ভীষণ ক্রিকেট পাগল ছিলাম। কোনো রকম স্কুল থেকে এসে নামমাত্র পড়াশুনা করে চলে যেতাম কলোনিতে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতে।
খেলাধুলা আমাকে অনেক টানতো। আব্বা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পারিবারিক তেমন কোনো কঠোর নিয়ম-কানুন ছিল না। আম্মা আমাকে শাসন করতেন। পড়ালেখা করতাম না বলে প্রায়ই মারতেন। তবে আব্বা আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। কখন কী লাগবে সব কিছু চাওয়ার আগেই আমাকে এনে দিতেন।
আপনার এই আইটি ক্যারিয়ার শুরু করলেন কীভাবে?
কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ২০০৫ সালে নিজেই একটা আইটি ফার্ম শুরু করি। কিন্তু সেটিতে সফল হতে না পেরে ২০০৬ সালে প্রথম আমি অরেঞ্জবিডিতে কাজ শুরু করি। প্রথমে জুনিয়র প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ শুরু করি। তখন অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে। কাজগুলো আয়ত্ত করে তারপর ধীরে ধীরে কাজ করতে শুরু করি। তখন এটা একদম ছোট প্রতিষ্ঠান ছিল। মাত্র তিনজন প্রোগ্রামার ছিল। সেখান থেকে আস্তে আস্তে আশরাফুল কবির জুয়েল স্যারের তত্ত্বাবধানে আজ আমার এ পর্যন্ত আসা।
জুয়েল স্যার ব্যক্তি হিসেবে অনেক ভালো মনের মানুষ। তার উৎসাহ অনুপ্রেরণায় ও সহযোগিতায় আমি কাজ শুরু করি। একদিন তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কী করতে চাই? আমি বলি বিজনেস করতে চাই। তখন তারা আমাকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন কিভাবে কাজ করানো যায়। সেই শুরু আমার ব্যস্ত জীবনের।
অরেঞ্জবিডির প্রথম কাজটি কী ছিল? এবার অনেকটা উৎসাহ নিয়ে তিনি বলেন, অলবিডিএডস ছিল অরেঞ্জবিডির প্রথম কাজ। এটাই বাংলাদেশে প্রথম অনলাইন অ্যাডভার্টাইজমেন্ট পোর্টাল অ্যান্ড জবস পোর্টাল। অরেঞ্জবিডি আজ নিজস্ব সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। একটা সুনাম আছে। কিন্তু শুরুতে তারা এই ফোকাসে আগায়নি। শুরুতে তারা অলবিডিএডসকে অনলালাইন মার্কেটপ্লেস হিসেবে ব্যবহার করেছে। এখন বিক্রয়.কম যেভাবে মার্কেটে পরিচিত পেয়েছে সেভাবে অলবিডিএডস পরিচিত হয়নি।
এখন আমাদের দেশে গাড়ি বিক্রির যে অনলাইন সাইটগুলো আছে এগুলো আমরা অরেঞ্জবিডি থেকেই তৈরি করেছি। শুধু প্রচারের অভাবে এগোতে পারিনি। তখন মাসের পর মাস আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো আয় হতো না। শুধু ভর্তুকি দিয়েই যাচ্ছিলাম। টাকার অভাবে আমাদের প্রোডাক্টগুলো চালাতে পারছিলাম না। বাজারে ছাড়তেও পারছিলাম না। খুবই খারাপ অবস্থা যাচ্ছিল। তখন আমি চিন্তা করতে থাকি কিভাবে আয় করা যায়। আর সেই চিন্তা থেকে আমি কয়েকটি সাইটের সঙ্গে কথা বলি। একদিন একটা বড় সাইট তৈরির কন্ট্রাক্ট পাই। কাজটি বাংলাদেশের অন্যতম ওয়েবপোর্টাল ‘লজ অব বাংলাদেশ’। কাজটি পাই কানাডার CIDA এর অধীনে। এই কাজটি ছিল অরেঞ্জবিডির টার্নিং পয়েন্ট।
তিনি বলেন, সাইটটির কাজ যখন পাই অরেঞ্জবিডিতে তখন প্রোগ্রামার আমি একাই ছিলাম। তবে আমার সঙ্গে একজন সহকারী ছিলেন। এই কাজটি আমার জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ ল’জ অব বাংলাদেশ সাইটটি অন্যতম বড় একটা সাইট। ১৮৩৬ সাল থেকে বাংলাদেশে যত আইন আছে সবগুলোই এই ওয়েবসাইটে আপডেটসহ সব পাওয়া যায়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ড. ফখরুদ্দিন এই সাইটটির উদ্বোধন করেন।
এটি তৈরি করতে দীর্ঘ তিন মাস লেগেছিল। এই সাইটটি সেসময় সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। কারণ যেদিন সাইটটি উদ্বোধন করা হয় তখন ‘ল’ এর বই আকারে যে বিডি কোড আছে সেটা ওয়েব ভার্সন করে দেয়া হয়। একটা আইনও করে দেয়া হয় যে, এই সাইটে দেশের সমস্ত আইনের আপডেট থাকবে। আর যে কেউ নিজের প্রয়োজনে আইন রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন। এই ‘লজ অব বাংলাদেশ’ ওয়েবসাইটের বদৌলতে সবাই অরেঞ্জবিডিকে জানতে পারে। এর পরে আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কথা যেন থামতেই চায় না। একনাগাড়ে তিনি বলেই চললেন, ২০০৭ সালে অনলাইন নিউজপোর্টালের প্রথম যে কাজটা করি সেটা হলো ‘ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস’। এর মধ্য দিয়ে প্রথম নিউজপোর্টালের কাজ শুরু করে অরেঞ্জবিডি। তখনও আমি একাই ছিলাম। প্রথম থেকেই এটি ভালো সাড়া ফেলতে শুরু করে।
এভাবেই শুরু হয় আমাদের অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোর কাজ। ২০০৮ সালে ধারাবাহিকভাবে কাজ করি সমকাল, কালেরকণ্ঠ, ইত্তেফাক, যুগান্তর, সংবাদ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, শীর্ষ নিউজ, বার্তা২৪.নেট, নতুনবার্তা, আলোকিত বাংলাদেশসহ ৫০টির মতো নিউজপোর্টালের। সব শেষে কাজ করি বড় নিউজপোর্টাল এনটিভি নিউজের। ৫ মাস আগে বিবার্তা২৪.নেট এর নিউজপোর্টালটি আমরা বানাই। এই পোর্টালটির সব কাজ আমরাই করছি। এছাড়াও বেশ কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের কাজ আমাদের হাতে রয়েছে।
শুরুতে এতগুলো নিউজপোর্টাল একসঙ্গে আপনারা কীভাবে দেখভাল করতেন? প্রথমদিকে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এতগুলো নিউজপোর্টালের পাঠক ম্যানেজমেন্ট করার মতো লোকবল না থাকা। দেখা যেত সমস্ত অনলাইনে পাঠক একবারে প্রবেশ করলে সব অনলাইন বন্ধ হয়ে যেত। সার্ভারের সমস্যা দেখা দিত। কোনোভাবেই পাঠকদের ম্যানেজ করা যাচ্ছিল না। তখন আমরা পাঠক ম্যানেজমেন্ট করার একটা টেকনোলজি বের করি। তখন সবাই ২৪ ঘণ্টা পাঠক ম্যানেজ সহজে করতে পেরেছেন। এই জায়গাগুলোর সমস্যা সমাধানে আমরা যখন সফল হই তখন একটা টিম তৈরি করি। আর এই টিম নিয়েই আমরা কাজ করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি। আমাদের সফলতার জন্য এখন আমরা অনলাইন নিউজপোর্টাল এক্সপার্ট হিসেবেই মার্কেটে সবার কাছে পরিচিত।
জীবনে কোনো কিছুর জন্য কি আফসোস হয়? আফসোস বলব না। বলব এটা আমার ছিল অবহেলা। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ভার্সিটি জীবনে যদি রোবোটিকস নিয়ে পড়ালেখা করতাম তাহলে অনেক ভালো করতে পারতাম। ওই বিষয়টা আমাকে অনেক পীড়া দেয় আজও। রোবোটিকস এর প্রতি আমার দুর্বলতা ছিল অনেক। তাছাড়া আমার ভালো প্রোগ্রামার হওয়ার অনেক সুযোগ ছিল। চেষ্টা করলে আরো ভালো প্রোগ্রামার হওয়া যেত। প্রোগ্রামিং নিয়ে আরো ভালো করতে পারতাম। কিন্তু বেশি গুরুত্ব দেইনি। আমার এই প্রোগ্রামিংয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ নেই। কিন্তু গেম বা অন্যান্য কাজে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।
আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কথা জানতে চাই। আমার ৭ বছরের একটা মেয়ে আছে। নাম ফাইজা ফারহা সোহা। আব্বা বেঁচে আছেন। আমার আম্মা নেই। বলেই তার গলাটা ভারি হয়ে ওঠে। আর কথা বলতে পারছিলেন না।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/এমহোসেন