শাহ্ পরানের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

শাহ্ পরানের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:৩৪:৩৪
শাহ্ পরানের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ থানার ভুশ্ছি গ্রামে জন্ম শাহ্‌ পরানের। মা গৃহিনী-বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী।  নব্বইয়ের শুরুর দিকে ব্যবসায়িক ক্ষতি সামলে উঠতে না পেরে বিদেশে পাড়ি জমান তার বাবা। ব্যবসায়ী পরিবারে চার ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয় এবং একমাত্র ছেলে শাহ্‌ পরান। স্কুল জীবন থেকেই বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন। যদিও কী করবেন তা জানতেন না।
 
এসএসসি পাস করে কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চেয়েছিলেন বিদেশে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। পরে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি শুরু করেন চাকুরি জীবন। এরপর বন্ধুর সাথে ব্যবসায় শুরু করে প্রথমে বেশ লোকসান দেন।  
 
ঝুঁকি জেনেও একদম আনকোড়া আরেকটি উদ্যোগ নিয়ে একাই শুরু করেন বাংলাদেশের সর্বপ্রথম ওয়েব ও মোবাইলভিত্তিক মেইনটেনেন্স সেবা প্রদানকারী প্ল্যাটফর্ম- হ্যান্ডিমামা ডট কো (http://www.handymama.co)।  এখানে  ঘরে বসেই প্রযুক্তির মাধ্যমে করিয়ে নেয়া যায় বাসাবাড়ির বিভিন্ন ধরনের মেইনটেনেন্স কাজ। যেমন- পেশাদার ক্লিনিং, ইলেকট্রিক্যাল, স্যানিটারি, পেইন্টিং, এসি-ফ্রিজ রিপেয়ার, কাঠমিস্ত্রী’র কাজসহ রকমারি গৃহস্থালি কাজগুলো। বর্তমানে রাজধানীর উত্তরা থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত ১১টি এলাকায় সফলভাবে এ সেবা দিচ্ছে হ্যান্ডিমামা।
 
শনিবার বিকেলে রাজধনীর গুলশান-২ ‘হ্যান্ডিমামা’র প্রধান কার্যালয়ে গেলে তিনি কথা বলেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদকের সাথে।খোলামেলাভাবে বলেন ব্যবসা জীবনের শুরু থেকে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বিষয়ে। অদম্য সেই উদ্যোক্তার গল্প শোনাচ্ছেন  বিবার্তার নিজস্ব প্রতিবেদক- উজ্জ্বল এ গমেজ।
 
শাহ্ পরানের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
ছোটবেলা চাকুরি জীবনের কথা কখনো ভাবতেই পারতেন না শাহ্‌ পরান। তার ইচ্ছে ছিল এমন একটা ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করবেন যা মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলে। যে কাজ অর্থপূর্ণ হবে।  জীবনের প্রয়োজনের তাগিদে তার পেশাগত জীবনের শুরুটা করেন শিক্ষকতা দিয়ে। একটি বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়াতেন প্রোগ্রামিং। এরপরে মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপিং প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি। একই সাথে চাকুরি ও পড়শুনা ভাল লাগেনি তার।
 
চাকুরি ছেড়ে দিয়ে একসময় ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করেন।  মাসে অনেক ভালো আয় হলেও সবসময় মনে একটা অতৃপ্তি ও সৃষ্টিশীল কোনো কাজ করার তাড়না অনুভব করতেন। শাহ্‌ পরান ছিলেন অনেকটা ‘সেলফ-টট বা স্বশিক্ষিত’ প্রকৃতির। তিনি নিজে নিজেই শিখতে ভালবাসেন। ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে যতটা কাজে সময় দিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় দিয়েছেন নতুন নতুন স্কিল শিখতে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে তিনি পেশাদার রাইটিং, স্টার্ট-আপ, ব্যবসায়, ব্যক্তিগত উন্নয়ন, স্পিড রিডিং, ডিজাইন, ব্লগিং, ইন্টারনেট মার্কেটিং, অ্যাফিলিয়েট বিজনেস ইত্যাদিসহ শিখেছেন আরও অনেক কাজ।  শুধু দক্ষতা অর্জনই নয়, সেই দক্ষতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে বেশ আয়ও করেছেন।
 
২০১৪ সালের শুরুর দিকে কাছের এক বন্ধুর সাথে মিলে যৌথভাবে গড়ে তোলেন ‘ওয়েবেসিস মিডিয়া’ নামক একটি অনলাইন বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান।  বড় বড় বিদেশি ক্লায়েন্টদের সেবা দেওয়ার পাশাপাশি করতেন নিজেদের অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় উন্নয়নের কাজও। প্রতিমাসে বেশ ভালো আয় হতে থাকলেও বেশ কিছু ব্যবসায়িক ভুল সিদ্ধান্ত ও পার্টনারশীপ জটিলতার কারণে মাত্র সাত মাসের মাথায়ই বন্ধ করে দিতে হয় ওই প্রতিষ্ঠানটি।
 
বন্ধুর সাথে প্রথম যৌথ উদ্যোগে বেশ মোটা টাকা বিনিয়োগ করে ধরা খেয়েছিলেন। তবে থেমে থাকেননি তরুণ এ উদ্যোক্তা।  এ ব্যর্থতাই যেন মোড় ঘুরিয়ে দেয় তরুণ এ উদ্যোক্তার। আগের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করেন দেশীয় বাজার পর্যালোচনা। অনলাইনভিত্তিক কিছু করতে নতুন সব ধারণা নিয়ে আলোচনা করেন অনেকের সঙ্গে। তবে সেভাবে কেউ তাকে উৎসাহিত করেনি। বেশিরভাগই বলেছেন, বাংলাদেশে এটা সম্ভব নয়। শেষে তিন মাস বন্ধ রাখার পর আর্থিক লোকসানের অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করেছেন নতুন করে। অনেক গবেষণা ও যাচাই-বাছাই শেষে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশুনা করা এ তরুণ গড়ে তোলেন হ্যান্ডিমামা।
 
এ চ্যালেঞ্জটাই নিলেন তিনি। বিরামহীনভাবে এর পেছনে লেগে থাকার ফল পেলেন স্বল্প সময়েই। একদম ভিন্ন ধরনের এ অনলাইন উদ্যোগ স্বল্প সময়েই বেশ সাড়া ফেলেছে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শাহ্‌ পরান সম্প্রতি সিলিকনভ্যালিভিত্তিক ফাউন্ডার ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ শেষে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিও পেয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ফেনক্স বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের বিনিয়োগও পেয়েছেন।
 
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা (ক্লিনিং, ইলেক্ট্রিক্যাল ও প্লাম্বিং) নিয়ে শাহ্‌ পরান ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে হ্যান্ডিমামা’র পাইলট প্রকল্প শুরু করেন। শুরুর দিকেই কিছু পেয়িং কাস্টমার পেয়ে যান যার ফলে পুরো উদ্যমে কাজ শুরু করেন। হ্যান্ডিমামা কীভাবে কাজ করে সে বিষয়ে বলতে গিয়ে শাহ্‌ পরান বলেন, হ্যান্ডিমামা’র সেবা পেতে আপনি www.handymama.co এই ঠিকানায় গিয়ে অনলাইনে অর্ডার করতে পারেন বা ০১৯ ২৮ ২৯ ২৯ ২৯ এই নম্বরে কল করেও সেবার কথা আমাদের জানাতে পারেন। সেবা ভেদে অর্ডার পাওয়ার ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘন্টার মধ্যে আমরা সেবাটি সরবরাহ করে থাকি। কাজ শেষে আপনি নগদ টাকায় বিল পে করতে পারবেন।
 
হ্যান্ডিমামা এখন ঢাকায়  গুলশান, বনানী, বারিধারা ডিওএইচএস, বসুন্ধরা, মহাখালী ডিওএইচএস, নিকেতন, নিকুঞ্জ, উত্তরা,  মোহাম্মাদপুর এবং ধানমন্ডিসহ ১১টা এলাকায় সেবা দিচ্ছে।  চলতি বছরে সারা ঢাকা সিটিতে সেবা চালু করা হবে বলে জানান পরান। আর সেবার মূল্য বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, একটা ফ্যান ঠিক করতে বাইরের ইলেকট্রিশিয়ান যে মূল্য নিবে হ্যান্ডিমামার কর্মীরা তার থেকে ১০-২০ ভাগ কম মূল্য নেয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে কাজটা করে দেয়। আর হ্যান্ডিমামায় আপনি শতভাগ নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য সেবার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন যা সাধারণত অন্য কেউ দেয় না।
 
ঢাকায় বাস করছে ১৫ মিলিয়ন মানুষ। আবাসিকভাবে বাস করছে ১০মিলিয়ন মানুষ। এ মানুষদের প্রতিদিনকার জীবনের নানা সেবার দরকার হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। শহরের মানুষের জীবনে বাড়িতে  ওয়্যারিং, টিভি, ফ্রিজ, এসি, ফ্যান মেরামত, কাপড় ও বাড়িঘর ক্লিনিং এর মতো সমস্যাগুলো সমাধান করতেই হ্যান্ডিমামা ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত বলেন জানান পরান।
 
ইন্টারনেট সহজলভ্য না হওয়ায় অনলাইন উদ্যোগ বা ই-কমার্সের প্রধান বাধা বলে মনে করেন তরুণ এ উদ্যোক্তা। তবে স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধিতে আশাবাদী তিনি। একদম নতুন এক খাত বলে পরিচিতি পেতে সময়ও বেশি লাগছে বলে মনে করেন তিনি। এসব কাজে নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই হ্যান্ডিমামা খুব সচেতনভাবে এটি নিশ্চিত করে থাকে। পরান বলেন, কোনো কাজের অফার আসলে ক্লায়েন্টদের কাছে আগেই কর্মীর নাম ও একটি আইডি কার্ড নম্বর পাঠিয়ে দেয়া হয় যাতে গ্রাহকরা সজাগ থাকেন। তবে নিরাপত্তা ও অপ্রত্যাশিত ক্ষতির সম্মুখীন হলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণের পলিসি নিয়ে হ্যান্ডিমামা এখন কাজ করছে।
শাহ্ পরানের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
হ্যান্ডিমামা তে এখন প্রায় ৪০০ কর্মী আছেন যারা বিভিন্নভাবে পরীক্ষিত।  এছাড়া চার জন ডেভেলপারসহ নয় জনের একটি সার্বক্ষণিক দল কাজ করছে। নতুন নতুন জোনে সেবা কার্যক্রম শুরু হলে কর্মী সংখ্যা আরও বাড়বে বলে তিনি জানান। হান্ডিমামার প্রচারণা এখনও বাণিজ্যিক রূপ নেয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন জোনে বিভিন্ন সামাজিক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মানুষকে হ্যান্ডিমামা সম্পর্কে জানানো হচ্ছে। তবে সর্বোচ্চ মানের সেবা প্রদানই সবচেয়ে বড় প্রচারণা বলে জানান পরান।
 
হ্যান্ডিমামাকে সারা দেশে নিয়ে যেতে চান তরুণ এ উদ্যোক্তা। এখানেই থেমে না থেকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। এ প্রতিষ্ঠানকে বৈশ্বিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার স্বপ্ন তার। এ ছাড়া হ্যান্ডিমামার আওতায় একটি ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে চান তরুণ এ উদ্যোক্তা। আগামী ৫ বছরে ১০ হাজার দক্ষ কর্মীর কাজের সুযোগ তৈরিতে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন বলে তিনি জানান।
 
আমাদের দেশে বা শহরে অনেক সমস্যা আছে। খাবারে, পানিতে, ওষুধে, শিক্ষা ব্যবস্থায়, চিকিৎসাসহ নানা ধরণের সমস্যা আছে। নতুনদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যারা উদ্যোক্তা হতে চান তারা এরকম যে কোনো একটা সমস্যা খুঁজে বের করে প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর সহজ সমাধানের জন্য পথ খুঁজে বের করুক।  যা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ তাদের সমস্যার সমাধান করতে পারে। শাহ্‌ পরান আরও বলেন, আপনি যখন অনেক বড় একটি সমস্যার সহজ সমাধান বের করবেন, মানুষ কিন্তু সেটার জন্য অবশ্যই আপনাকে পে করবে।
 
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পরান বলেন, আমি যখন কাজ শুরু করি তখন দীর্ঘদিন মার্কেট রিসার্চ করেছি। শুধু লাভের জন্য ব্যবসা শুরু-এ লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করলে ভুল করবেন। নতুনদের তাই বাজার কাস্টমারদের চাহিদা ও ক্রয় ক্ষমতা, সমস্যার ধরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার, ইত্যাদি বুঝে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করার পরামর্শ দেন তরুণ এই উদ্যোক্তা।
 
বিবার্তা/উজ্জ্বল/মহসিন
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com