আমি জহুরুল ইসলাম। নামটি দেখে মনে করার কোনো কারণ নেই যে বাংলাদেশের এক সময়ের শ্রেষ্ঠ ধনী সেই জহুরুল ইসলাম। সবাই সাংবাদিক জহুরুল ইসলাম বলে জানে। চারপাশে চলতে গিয়ে কখন যে ২৫ বছরে পা দিয়েছি জানতে পারিনি। আমার জীবনের ২৫টি বছর কিভাবে কেটে গেল আজ তা বলতে চাই। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি আকৃষ্ট। ইচ্ছে তাড়া করে ফিরে বড় কিছু হওয়ার। কিন্ত বাধা হয় অর্থ। দারিদ্রতার কারণে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ হয়ে উঠেনি। ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান থেকে হাটিহাটি পা পা করে গ্রাজুয়েশন শেষ করি। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোও আমার কাছে প্রিয় ছিল। কিন্তু ছোটবেলা থেকে আমার মনের মধ্যে একটি বড় রকম ইচ্ছা ছিল। কোনোদিন কী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবো না?
সময় নিজের মতো চলে যায়। সে সুযোগ হয়ে উঠেনি কোনোদিন। আমি হাল ছাড়িনি। একদিন না একদিন বড় প্রতিষ্ঠানে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে আল্লাহ আমাকে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেবেন। বড় ভাইদের মুখে শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লে ছাত্র জীবনের অর্ধেক বাকি থাকে। সে সত্য কথা। শৈশবের কিছু বলতে হয় আমাকে আজ। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অতিকষ্টে পড়াশোনা করতে হয়েছে। সেই সময় বাবা-মার কাছে টাকা না থাকায় মাত্র দুটি প্যান্ট দিয়ে ৫টি বছর পার করি। ৫টি বছরের মধ্যে যে কদিন স্কুল ছুটি পেয়েছি, কাজ করার মাধ্যমে সময় পার করতাম। প্রথম কাজ করা শুরু করি জমিতে পাট কাটার মাধ্যমে।
যা প্রতিদিন সেখান থেকে পেতাম মাত্র দশ টাকা। আমি কখনো কখনো রাজমিস্ত্রির কাজও করেছি। এই করতে করতে এসএসসি পাশ করলাম ২০০৬ সালে। এসএসসি পরীক্ষার পর অনেক সময় ফাঁকা থাকে সে সময় বসে না থেকে বিয়ে বাড়িতে ভিডিও চালানোর কাজ শুরু করলাম। সেখান থেকে মনে ইচ্ছা হলো সাংবাদিক হওয়ার। সে জগতের সাথে কম্পিউটারের সম্পর্ক আছে। ব্যাস একটি কম্পিউটারের দোকানে কাজ শুরু করলাম। এর মধ্যে আমি এইচএসসি পাশ করলাম ২০০৮ সালে। কম্পিউটারের দোকানে কাজ করতে করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কমিউনিটি রেডিও, ‘রেডিও মহানন্দা’ চালু হলো এবং বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো কিছু সাংবাদিক নেবে। তাদের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং অল্প অল্প লেখা শুরু হয়ে গেল আমার।
রেডিওতে কাজ করতেই একটি এনজিও (সিএমইএস)’র মাধ্যমে ইউনিসেফের সহযোগীতায় ও দৃক পাঠশালার শিক্ষক দ্বারা ৬ মাস ব্যাপী ফটোগ্রাফির ওপর একটি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। ভিডিওগ্রাফি ও ফটোগ্রাফি যেন আরো সাংবাদিকতায় কাছে টানা আরম্ভ করলো। গ্রাজুয়েশন করার জন্য স্থানীয় ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়ে পড়ি। পড়াশোনা চলছে। শুরু করলাম ছবি তোলা ও লেখালেখির কাজটিও। ঢাকার এক বড় ভাই যার নাম আমিনুজ্জামান আমিন ভাই হঠাৎ ফোন দিয়ে বলেন, তুমি না আমাকে বলেছিলে তুমি সাংবাদিকতা করতে চাও করবা কি? আমি সামনে-পেছন না ভেবেই একবাক্যে বলে ফেললাম আমি করবো। তিনি বলেন, আমি ফোন দিলে তুমি ঢাকায় চলে আসবে।
বেশ কিছুদিন পর ফোন দিয়ে বলেন, আগামী ৩ তারিখ ঢাকা চলে আসো। সেদিনের তারিখটি ছিল ৩ মার্চ ২০১২ সালে। সেদিনই প্রথম ঢাকা যাওয়া আমার। একটি মজার বিষয় সেখানে গিয়ে দেখি যে প্রতিষ্ঠান থেকে ফটোগ্রাফির ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম সে প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ। প্রতিষ্ঠানটির নাম দৃক নিউজ। আমিনুজ্জামান আমিন ভাই’র হাত ধরে ভালভাবে সাংবাদিকতা শুরু করি। পর্যায়ক্রমে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পাই। আঞ্চলিক পত্রিকা দৈনিক চাঁপাইচিত্র'র প্রধান আলোকচিত্রী, এশিয়ান টিভি, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমস২৪ডটকম, ফোকাস বাংলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি।
ফোকাস বাংলার মাধ্যমে দেশের বেশকিছু স্বনামধন্য জাতীয় পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হয়েছে। দৃক নিউজের মাধ্যমে জার্মানির একটি অনলাইন ভিত্তিক টিভি ডয়চে ভেলে’তে বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আমার। এই প্রতিষ্ঠানটি আমাকে সম্মান, মর্যাদা, ভালবাসা এবং অর্থ পাইয়ে দিয়েছে। আর অনেক সিনিয়র ভাইদের ভালবাসা পেয়ে আজ এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছি। ২০১১ সালে মাস্টার্স এ রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই। সাংবাদিকতা ও পড়াশোনা চলছে। কিন্তু সেই বড় স্বপ্নটা মাথার মধ্যে রয়ে যায়। সাংবাদিকতা করতে করতে হঠাৎ একদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক ছাত্র আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (সিনিয়র বড় ভাই) আমাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবেন। আমি এক বাক্যে বললাম আমি যাবো। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনলে দুর্বল হয়ে পাড়ি।
১৮ জানুয়ারি ২০১৫ইং তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল বিভাগের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সেখানে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ আসেন। সেখানে যাবার সুযোগ পাই ভাইয়ের মাধ্যমে। আর সেখানে গিয়ে দেখি শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে আন্তরিকতা। সে থেকে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা শুরু করলাম ভালভাবে আল্লাহ আমাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিনের জন্য হলেও পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিও। তার বেশ কিছুদিন পর শুনলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ইএমএসএস কোর্স চালু করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের সময় টিভির জেলা প্রতিনিধি এমএ মাহবুব ওই কোর্সে ভর্তি হন। তিনি আমাকে বার বার ভর্তি হওয়ার কথা বলতেন। আগের সেই কথাটি আবারো মনে পড়ে যায় দরিদ্র পরিবারে জন্ম আর দারিদ্রতা যেন দরজায় টোকা মারছে।
একদিন এমএ মাহবুব আমাকে তার বিভাগে নিয়ে যায় ভর্তির বিষয়ে জানার জন্য। জানতে পারলাম ৪ সেমিস্টারের এই কোর্সে ভর্তি হতে লাগবে মোট এক লাখ টাকা। আবারো অর্থ যেন পিছনে ঠেলে দিচ্ছে। একদিকে বড় প্রতিষ্ঠান অন্যদিকে মনের ইচ্ছা। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্যারদের ব্যবহার আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এক পর্যায়ে ওই বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. প্রদীপ কুমার পান্ডে স্যার এর কাছে নিয়ে যায় এবং তার অতি কাছাকাছি বসার সুযোগ আর এক সাথে চা খাওয়াটা আমার অত্যন্ত ভাল লাগে। চায়ের ফাঁকে সে অতি সুন্দর মানুষটি বলে ফেললেন, আপনি ভর্তি হয়ে যান। বাকিটা ওপর ওয়ালার ইচ্ছা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি চলে এলাম। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমাকে যেকোনোভাবেই এই কোর্সে ভর্তি হতে হবে। টাকা জমানো শুরু করলাম। কিন্তু দৃক নিউজে কাজ করা সত্ত্বেও ওই সময়ে টাকা না পেয়ে আমার কাছে সাড়ে সাত হাজার টাকা আর আমার এক বন্ধুর কাছে সাড়ে সাত হাজার টাকা ধার করে উদ্ভোধনী ক্লাসের এক সপ্তাহ পরে ভর্তি হই প্রথম সেমিস্টারের অর্ধেক টাকা পনের হাজার জমা দিয়ে। সবকিছুর মূলে হচ্ছে সাংবাদিকতা।
অবশেষে জীবনের ইচ্ছাটা পূরণ হচ্ছে হাটিহাটি পা পা করে। এদিকে রাজশাহী কলেজে চলছে মাস্টার্স ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ইএমএসএস কোর্সে মাস্টার্স। আর দৃক নিউজ-এ যে সম্মানি দিয়ে থাকে সেখান থেকে চলছে আমার এই দুই প্রতিষ্ঠানের খরচ। আমাকে এই প্রতিষ্ঠান অনেক কিছু পাইয়ে দিয়েছে। আর জীবনের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসে আনন্দে চোখে পানি চলে আসল। আমি আনন্দে আটখানা। শেষ বয়সে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু আমার।
আবার ওই ব্যক্তির নাম (আমিনুজ্জামান আমিন) স্মরণ না করে পারলাম না, যার হাত ধরে সাংবাদিকতার জগতে আসা এবং এ পর্যন্ত পৌছে যাওয়া। অবশেষে বড় ভাইদের সে কথাটি আমিও বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বারের জন্য হলেও পড়ালেখার সুযোগ করে নিবেন। আপনার সুযোগ না হলে আপনার ছেলে-মেয়ে পড়াশোনার করার সুযোগ দিবেন। সেখানে শিক্ষার ভান্ডার রয়েছে। আর আমার জন্য সকলেই দোয়া করবেন যাতে আমি আরো উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করতে পারি। (সংগ্রহে : শাহনেওয়াজ সুমন, স্টাফ রিপোর্টার, বিবার্তা২৪.নেট)
লেখক : ইএমএসএস চতুর্থ ব্যাচ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল-০১৭৪০৮৬৩৮৬৪
বিবার্তা/সুমন/মহসিন