ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্ম শেখ আদনান ফাহাদের। বাবা শেখ মো. আবু হামেদ ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে গ্রামে ফিরে কলেজ স্থাপন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। মা নূরজাহান বেগম রত্নগর্ভা বলে পরিচিত। ৬ ভাই আর ৩ বোন সবাই উচ্চ শিক্ষিত। ভাই-বোনদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, শিক্ষাবিদ সাংবাদিক, লেখক ও শিক্ষক।
এমনই পরিবেশে শেখ আদনান ফাহাদের শৈশব-কৈশোরে পড়ালেখার জীবন কাটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমের প্রেরণায়। বাবা ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিসহ অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে সমাজ সেবামূলক কাজ করে জীবন পার করেছেন। বেতনভুক্ত কোনো কাজ করেননি তিনি। তাই শেখ আদনান ফাহাদকে অন্যান্য ভাইবোনের মতই জীবনের সাথে যুদ্ধ করে পড়ালেখা করতে হয়েছে। বর্তমানে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন।
শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজের সাথে দীর্ঘ আড্ডায় বেরিয়ে আসে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা ঘটনা।
আজ আপনাদের শুনাবো শেখ আদনান ফাহাদের সে বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প। তাহলে আসুন শুনি তার মুখেই।
বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে বলুন।
জীবনের গল্প বলার আগে আমার বাবাকে নিয়ে কিছু বলতে চাই। তিনি বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন। বলার উদ্দেশ্যটা হলো বাবার মধ্যে যে দেশপ্রেম ছিল তা যেন সবার মধ্যে জাগ্রত হয়। এভাবে যেন সবাই দেশকে ভালবেসে সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করে।
বলুন সে বর্ণাঢ্য জীবনের গল্পটাই।
আমার বাবা শেখ মো. আবু হামেদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকাতে যারা পুরানো মানুষ তাদের কাছে প্রিন্সিপাল শেখ আবু হামেদ নামে পরিচিত। ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ভাষা সৈনিক সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত যাদের নাম আমরা জানি তাদের সাথেই সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার একমাত্র যে ডিগ্রি কলেজ সেটা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সরাইল কলেজ শুধুমাত্র একটা কলেজ না, পুরো সরাইল তথা উত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার লাইফলাইন। সরাইল উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন আব্বা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ তো শুরুতে ছিল মুসলিম লীগ। তারপর হলো আওয়ামী মুসলীম লীগ। তারপর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় নতুন নাম হ্য় আওয়ামী লীগ।
আব্বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিসহ অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করেন। কিন্তু জীবনে কোনো সরকারি চাকুরি করেননি। একবার থানা শিক্ষা অফিসার হিসেবে চাকুরি শুরু করে কিছু দিন পর এলাকায় সরাসরি মানুষের সেবা করবেন বলে সেটাও ছেড়ে দেন। চাকুরি ভাল লাগেনি। পরে সরাইল উপজেলার ডিগ্রি কলেজ, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও বিভিন্ন হাইস্কুলে বিনা বেতনে পড়াতেন। আর বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কাজ করতেন। বার্ধ্যক্যজনিত কারণে ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।
আমার বাবার যে শিক্ষাগত ও রাজনৈতিক অবস্থান ছিল তা কখনও পারিবারিকভাবে কাজে লাগাননি। সম্পূর্ণ জীবন তিনি ব্যয় করেছেন সমাজ সেবায়। মা নূরজাহান বেগম। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। তাকে সবাই রত্নগর্ভা বলেন।
বাবার সমাজ ও দেশ প্রেমের গল্প শোনালেন। এবার মাকে সবাই কেন রত্নগর্ভা বলেন সে গল্পটা শুনতে চাই।
আমরা ৬ ভাই ৩ বোন। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। পরিবারে যে সবচেয়ে কম পড়ালেখা করেছেন তিনি ডিগ্রি পাস। আমাদের পরিবারে প্রাইমারি স্কুলের টিচার থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি টিচার পর্যন্ত সবই আছে। বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার। পরের ভাই সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করেন। এরপরের ভাই বিটিভির বার্তা সম্পাদক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিউট (পিআইবি) এর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এরপরের ভাই ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। পরের ভাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। আর শেষে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। তিন বোনের মধ্যে বড় বোন বেসরকারি চাকুরি করেন। মেঝো বোন সরকারি হাই স্কুলের টিচার। পরের বোন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের টিচার। আমাদের পরিবারে বিপুল আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও আমাদের মনে শান্তি আছে, আছে সম্মানবোধ।
আমরা চার ভাই-বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। আমি ও বড় ভাই শেখ মজলিস ফুয়াদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছি। আরেক ভাই ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে, এক বড় বোন রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। আমাদের পরিবারে ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, টিচার সবই আছেন। অন্যদিকে আমার ভাবিরাও সবাই চাকুরি করেন।
বলেছেন বাবা সমাজ সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাহলে সবাই পড়ালেখা করেছেন কীভাবে?
আমার জীবনে বাবাকে আমাদের মতো করে টাকার বিনিময়ে কোনো কাজ করতে দেখিনি। পেশাগতভাবে বেতনভুক্ত ছিলেন না কোনো প্রতিষ্ঠানে। সব সময়ই বিনাবেতনে কাজ করেছেন। ফলে আমাদের পরিবারে আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। এরপরে বড় ভাইয়েরা পড়ালেখা করে ছোট ভাইবোনদের পড়ালেখা করতে সাহায্য করেছেন। যেমন-বড় ভাই আর বড় ভাবি চাকুরি করে ছোটদের পড়ালেখার খরচ দিয়েছেন। এভাবে তারাই আমাদের সবাইকে পড়ালেখা করতে সাহায্য করেছেন। এখন যেমন আমরা ভাতিজা-ভাতিজিদের পড়ালেখার জন্য সহায়তা করার চেষ্টা করি। এভাবেই চলে যায় জীবন।
বাবার আদর্শ আপনাদের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?
ছোটবেলা থেকেই আমাদের সকলের প্রতি আব্বার কড়া নির্দেশ ছিল অসততার পথ পরিহার করতে হবে। আব্বা আমাদের মাঝে যেকোনো সুযোগেই দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সমাজ সেবা ইত্যাদি চেতনা জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন। আর আব্বার কর্মকাণ্ড আমাদের সামনে তো ছিলই। এগুলো আমরা ৯ ভাইবোনই অন্তরে লালন করেছি। আব্বার আদর্শের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল। সবার মধ্যেই এ আদর্শগুলো রয়েছে। সবাই যে যার কর্মস্থলে সাধ্যমতো আব্বার আদর্শের প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করছি। আমার ছোট জীবনের অভিজ্ঞতা হলো- জীবনে নীতিগতভাবে যারা সৎ থাকে তারা জীবনে ভাল কিছু করবেই।
পারিবারিকভাবে আমাদের সেকেন্ড জেনারেশন চলছে। সবারই ছেলে-মেয়ে আছে। আমারও একজন ছেলে আছে। সবাই পড়ালেখা করছে। আমরা আব্বার মতো সব ছেড়ে সমাজ সেবা করি না। জীবনের প্রয়োজনে চাকুরি করছি। পাশাপশি সমাজ সেবামূলক কাজ করছি।
এতক্ষণ বললেন আপনার পরিবারের গল্প। এখন আপনার পড়ালেখা জীবনের গল্প শুনতে চাই।
কালিকচ্ছ উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাইমারি স্কুল জীবন শুরু করি। ওখানে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশুনা করি। ফাইভে বৃত্তি পেয়ে কালিকচ্ছ পাঠশালা উচ্চ বিদ্যালয়ে শুরু করি হাইস্কুল জীবন। প্রাইমারি ও স্কুলের জীবনটা ছিল অনেক আনন্দের। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া, পড়াশুনা, খেলাধুলা, আড্ডা এসব নিয়েই পার করেছি স্কুল জীবনটা।
ছোটবেলা থেকেই আমি ফুটবল ও ক্রিকেট প্রেমি ছিলাম। এখনও আছি। এখনও সময় পেলে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলি। তবে শৈশবে খেলাধুলাটা নেশার মতো ছিল। যখন যেখানে ক্রিকেট খেলা হতো সেখানেই খেলতে যেতাম। এভাবেই পড়াশুনা আর খেলাধুলার মধ্যদিয়ে কখন যে স্কুল জীবনটা পার হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। স্কুল জীবনে বেশি পড়ালেখা করতাম না। খেলাধুলাই বেশি করতাম। এসএসসিতে কুমিল্লা বিভাগে ১৮ তম স্থান অর্জন করি। বোর্ডে প্রথম দিকে থাকার কথা আমার। কিন্তু আমার মনে হয় টেস্ট পরীক্ষার পর অতিমাত্রায় ক্রিকেট খেলার জন্য রেজাল্ট ভালো হয়নি।
এরপরে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেই। প্রথমে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাস করি। কলেজটা দেখে পছন্দও হয়েছিল। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ অনেকটা ক্যাডেট কলেজের মতো। পোষাক, নিয়ম-কানুন অনেক ভাল। কিন্তু খরচ অনেক। বাবা তো কলেজের খরচ দিতে পারবেন না। আমাকে পড়তে হবে বড় ভাইদের টাকায়। তারা বললেন ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে ভর্তি না হয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢাকা কলজে ভর্তি পরীক্ষা দেই। মানবিক বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় আমি ৬ষ্ঠ হয়েছিলাম। শুরু হয় কলেজ জীবন। অবশ্য ঢাকা কলেজে ভর্তি না হলে আমি জীবনের অনেক কিছুই পেতাম না। এখন আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে সবচেয়ে বেশি গর্ব বোধ করি।
অন্য পাঁচজন ছাত্র যেভাবে কলেজ জীবনকে যাপন করে সেভাবে আমি করতে পারিনি। ভাইবোন, ভাবিদের, বিশেষ করে বড় ভাবির সহযোগিতায় কিভাবে যে দুটি বছর পার হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। পরিবারের সবাই আমাকে সাহায্য করেছেন। তাই বেশি কষ্ট হয়নি। ইন্টারমিডিয়েটে মানবিক থেকে প্রথম বিভাগে পাস করি।
এরপরে ভর্তি হই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। আমার কলেজের খরচ বড় ভাই-ভাবিরা দিতেন। প্রত্যেক মাস শেষে ভাই-ভাবিদের কাছে টাকা চাইতেও ভাল লাগতো না। তাদেরও ছেলে-মেয়ে আছে। তাই শুরু করি একটা টিউশনি। তখন শামসুন্নাহার হলে পুলিশি অভিযানের প্রেক্ষিতে ছাত্র আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলে একমাস পরে টিউশনিটাও চালিয়ে যেতে পারিনি। আমার পরিবারে বড়রা পড়ালেখা করেছেন নিজে টিউশনি করে, পার্টটাইম জব করে। তাই প্রয়োজনের তাগিদেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি শুরু করি দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকায় চাকরি। আমার সেজো ভাই শেখ মজলিস ফুয়াদ চাকরিটা ম্যানেজ করে দিয়েছিলেন।
একদম নতুন। কি করবো? দায়িত্ব দেয়া হলো সাব-এডিটর হিসেবে আন্তর্জাতিক ডেস্কে। বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া যেমন -বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, সিএনএন থেকে বাংলায় অনুবাদ করে নিউজ আকারে প্রকাশ করা ছিল আমার কাজ। বেতন শুরুতে ছিল ২০০০ টাকা। পরে মালিক-সম্পাদক বেলায়েত হোসেন ভাই আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ১০০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার হিসেবে ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ ইউএনবিতে চেষ্টা করেছিলাম। ইউএনবি ইংরেজি মাধ্যম। ইংরেজিতে নিউজ করতে হয়। ওখানে একটা পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্টও হয়েছিলাম। আমার সাথে আরেকজন যৌথভাবে ফার্স্ট হয়েছিলেন, বিভাগের বড় ভাই দীপঙ্কর দা । তিনি সেখানে ইন্টার্ন সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করছিলেন। ইউএনবির চিফ অব করেসপনডেণ্ট শামীম আহমদ আমাকে বললেন, এক বছর বাইরে কাজ করতে, এক বছর পরে আমার বিভাগের আরেক বড় ভাই সাজু ভাই (বিবিসির ফরিদ ভাই) আমাকে ভোরের ডাকের ল্যান্ড ফোনে ফোন দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি ইউএনবিতে আসতে। সাজু ভাই তখন ইউএনবির সিনিয়র রিপোর্টার। আমি গেলাম। শামীম ভাই আমাকে সুযোগ দিলেন। তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটনে প্রেস মিনিস্টার। তখন আমি মাত্র ৩য় বর্ষের ছাত্র। বেতন ধরা হয়েছিল তিন হাজার টাকা।
আমার বস শামীম আহমেদ। আমি খুবই ভাগ্যবান মনে করলাম নিজেকে। কারণ সহকর্মী হিসেবে যাঁদেরকে পেয়েছিলাম, তারা বেশিদিন আর ইউএনবি তে ছিলেন না। সাজু ভাই, জাহিদ নেওয়াজ খান জুয়েল ভাই, রাশেদ চৌধুরী ভাই, মিতুল ভাই। আমার জীবনে শামীম ভাই এর অবদান অসীম। তিনি আমাকে ঢাকা শহরে হাতে কলমে গড়ে তুলেছেন। তিনি আমাকে রিপোর্ট করা শিখিয়েছেন। পরিশ্রমি হতে শিখিয়েছেন। কিভাবে শত প্রলোভনের ভেতর সৎ থাকতে হয়, তার তালিম দিয়েছেন। শামিম ভাইকে আমি আমার সাংবাদিক জীবনের গুরু মানি।
কিছু দিন কাজ করার পর দেখি ইউএনবি থেকে ৮-১০জন সহকর্মী চলে যাচ্ছেন। কোথায় যাচ্ছেন তারা? পরে দেখি ওই দলটিই শুরু করেন বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর.কম অনলাইন নিউজপোর্টাল। তারাই হলেন বিডিনিউজের প্রতিষ্ঠাকালীন সাংবাদিক। তখন ইউএনবি খালি হয়ে যায়। শামিম ভাই এর মন খারাপ। আমি বললাম শামিম ভাই, চিন্তা করবেন না। আমি যতটুকু পারি বাড়তি কাজ করবো। বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্ট করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ বিটের কাজ করা শুরু করলাম। বয়স কম হলেও আমি বড় বড় এসাইনমেন্ট করা শুরু করলাম। কখনও সুধা সদন, কখনও পার্টি অফিস, কখনও মুক্তাঙ্গন, কখনও প্রেসক্লাব ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গিয়ে রিপোর্টিং করতাম। ওই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। সকালে প্রস্তুত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। ক্লাস করে দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে কোনো রকম খেয়ে ছুটতাম বিভিন্ন জায়গায় নিউজ করতে। এভাবে ব্যস্ততায় কাটল ২০০৫-৬ সাল।
২০০৭ সালে দেশ চলে গেল ড. ইয়াজ উদ্দিন আহমদের কেয়ারটেকার সরকারের হাতে। ওই সময় অনেক প্রেসার ছিল। দিনরাত কাজ করেও সময় পেতাম না। এর পরে ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ওই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে নির্বাচন প্রচারণায় রিপোর্টার হিসেবে পুরো দেশ ঘুরেছি। উনি যেখানে যেতেন সেখানেই আমি গেছি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকারের দায়িত্ব নিল তখন সাংবাদিক হিসেবে আমার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি মিডিয়া টিমের সদস্য হয়ে গেলাম। সেখানে বাসস ও বাংলাদেশ টেলিভিশন, রেডিও’র সাথে একমাত্র বেসরকারি নিউজ এজেন্সি ইউএনবির পক্ষ থেকে আমাকে সুযোগ দেয়া হলো। প্রধানমন্ত্রী যেখানে যাবেন সেখানেই এ টিমের সদস্যরা সাথে যাবে। আমার জীবনের প্যাটার্নটাই বদলে গেল। ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌদি আরবে হজ করতে যাই। এরপরে ২০০৯-১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা বিশ্বের প্রায় ২০টার বেশি শহরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। আমি প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ, ডেপুটি প্রেস সচিব মাহবুবুল হক শাকিল, নজরুল ইসলামের সান্নিধ্যে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। দেশে, দেশের বাইরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে খুব কাছ থেকে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। অনেক কিছু শিখেছি আর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধে কার্যকরভাবে শামিল হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
ছাত্র জীবনেই হয়ে গেলেন পেশাধারী সাংবাদিক। তো শিক্ষকতা পেশাটাকে বেছে নিলেন কেন?
একসময় চিন্তা করলাম পেশা পরিবর্তন করবো কিনা। ছাত্র হিসেবেও ভাল ছিলাম। গবেষণার প্রতিও ঝোঁক আছে। ভাবলাম, লেখালেখি, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে ভাল লাগে, তাহলে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে নিলে মন্দ হয় না। ২০১১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সার্কুলার দেয়। তখন আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটা সফরে অস্ট্রেলিয়া ছিলাম। আমি আবেদন করি। পরীক্ষা দেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান মাননীয় উপাচার্য আমার সরাসরি শিক্ষক প্রফেসর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যার এবং তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর শরীফ এনামুল কবির স্যার আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পেশাগত উৎসাহ দিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর আমি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে প্রভাষক হিসেবে জয়েন করি। শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জীবন। তবে আমার শিক্ষকতা জীবনে ও গবেষণা কাজে পৃথিবী দেখার অভিজ্ঞতাগুলো অনেক সাহায্য করছে।
আপনি কোন কোন বিষয়ে শিক্ষা দেন?
সাংবাদিকতার ধারণা, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাস, গ্লোবাল মিডিয়া সিমেস্টমস, মিডিয়া, সমাজ সংস্কৃতি, থিউরিটিক্যাল এপ্রোচেস টু মিডিয়া স্টাডিজ, রিসার্চ মেথডোলজি ইত্যাদি বিষয়ে পড়াই।
পিএইচডি করার ইচ্ছে আছে কি? কোন বিষয়ে?
পেশাগত প্রয়োজনে পিএইচডি তো করতেই হবে। পড়ানোর পাশাপাশি গবেষণা কাজ করে যাচ্ছি। ভাবছি কোন বিষয়টা নিয়ে পিএইচডি করব। আমি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ছাড়াও সহকারি প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেছি গত দুই বছর ধরে। এখন আর সেটা করি না। হলের দায়িত্বে আছি। সেটাও এখন ছেড়ে দেব। পড়ালেখা আর গবেষণায় মনোযোগ দেয়ার জন্য। এটা অগেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দিয়ে সহায়তা করতে চেয়েছি। কিন্তু বিভাগে শিক্ষক সংখ্যা অনেক কম। আমরা সবাই খুব চাপে থাকি। এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি পিএইচডিটা করবই।
বলছিলেন গবেষণা করছেন। কী বিষয়ে। একটু জানতে চাই।
বিশ্বের নানা জায়গা ঘুরে আমার গবেষণার আগ্রহের বিষয়টি হলো বাংলাদেশকে নিয়ে। আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশকে বিশ্বের মানুষ ঠিকভাবে চেনে না। আমাদের ভাবমূর্তি নেতিবাচক। যতটা আমাদের জন্য তার চেয়ে বেশি পশ্চিমা কিছু গণমাধ্যমের নেতিবাচক সংবাদ প্রচারের জন্য। বিদেশিরা বাংলাদেশের কথা শুনলেই ভাবে এটি গরিব,অভাবী, মঙ্গাপীড়িত দেশ। আমরা যে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত নেতার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছি; ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার মত দেশ থেকে বিভিন্ন মানব উন্নয়ন সুচকে যে এগিয়ে গেছে, বাংলাদেশের যে ক্রিকেটের বিজয়, শিশু মৃত্যুর হার কমে গেছে এগুলো বিশ্বের মানুষের চোখে পড়ে না। শুধু নেতিবাচক দিকটাই দেখে। বিশ্ব মিডিয়ায় ইতিবাচক দিক নিয়ে নিউজ করে না। স্থান পায় শুধু নেতিবাচক বিষয়গুলা। বিশ্ব ঘুরে আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয় না। তখন আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে গ্লোবাল মিডিয়া সিস্টেম আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।
একজন সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক। পড়াচ্ছেন মিডিয়া বিষয়ে। বই লিখেছেন কী?
‘সংবাদের পূর্ব ও পশ্চিম’ শিরোনামে একটা বই লিখেছি। ২০১৫ সালের একুশে বই মেলায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে। শ্রাবণ প্রকাশনীর রবিন আহসান ভাইকে ধন্যবাদ। বইটিতে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি বিশ্ব মিডিয়ায় প্রতিনিধিত্বকারী সংবাদ মাধ্যম যেমন-রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন, এএফপি কীভাবে নেতিবাচক সংবাদ দিয়ে বিশ্বকে প্রভাবিত করছে। প্রতিদিন বাংলাদেশে কত নিউজ প্রকাশ হয়। কিন্তু বিশ্ব মিডিয়ায় যায় শুধু নেতিবাচক নিউজটা। তারা আমার নিউজটা আমার মত না, তাদের মত করে পৃথিবীকে দিবে। এটা নিয়েই আমার আগ্রহটা বেশি।
এখন কী বিষয় নিয়ে লিখছেন?
আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতিতে কীভাবে বিদেশি, বিশেষ করে ভারতীয় বিজ্ঞাপন, নাচ, গান, নাটক প্রভাব বিস্তার করছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে একটা গবেষণা ভিত্তিক পাণ্ডুলিপি লিখে শেষ করেছি। এটাকে আরো সম্পাদনা করতে হবে। আমাদের দেশের সংবাদপত্রে ভারতের নাচ,গান, ক্রিকেট খেলা, নাটক, চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক নিউজ করা হয়। কিন্তু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম কি আমাদেরকে তেমন কাভারেজ দেয়? তাই এ বিষয় নিয়ে আরেকটি লিখেছি ভারতের সংবাদপত্রে বাংলাদেশকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বাবার কোন গুণটা আপনি পেয়েছেন?
আব্বার সাথে আমার কোনো ধরনের তুলনা হতে পারে না। আমিও সমাজের ৮/১০ টা মানুষের মত লোভী, ভীষণ ভোগবাদী। আমিও গাড়ি, বাড়ি করতে চাই, তবে একটা কথা বলতে পারি, যা চাই সৎ পথে চাই। আমার বাবাতো সারাজীবন মানুষের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। তবে সন্তান হিসেবে কিছু প্রভাব আছে অবশ্যই। যেমন অন্য মানুষের সমস্যা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা। সীমিত সামর্থ্য দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে তাঁদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। কখনো পারি, কখনো পারি না। বিশেষ করে ঘরের বাইরে থাকার প্রবণতা আমার মাঝে খুব বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে পরিবারকে সময় দেয়ার কথা। কিন্তু আমি বাইরে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাই। প্রতিদিন নানা রকম মানুষের সাথে কথা বলতে আমার ভাল লাগে। কোনো কারণ ছাড়াই, পার্টি অফিসে যাই; নেতারা খেয়াল করেন না, কিন্তু আমি তাদের খেয়াল করি। জানা থাকলে কালচারাল প্রোগ্রাম বা সেমিনারে চলে যাই। এছাড়া সময় পেলে সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে লেখালেখি করার মাধ্যমে সমাজ-দেশের মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ভেতর দেশ প্রেম জাগ্রত করার চেষ্টা করি।
এবার স্বপ্ন নিয়ে কিছু বলুন।
আমার ব্যক্তিগত বড় কোনো স্বপ্ন নেই। তবে ভাবনা আছে। যেমন আমার স্ত্রী নুসরাত জাহান ইভা পেশায় ডাক্তার। ওর কাজের এবং পড়াশুনার অনেক চাপ। আমার ছেলে নাফিম, আসছে পহেলা বৈশাখে ২ বছর হবে। এদেরকে আমার উদাসীনতার ভেতরেও যতটুকু পারি সহযোগিতা করতে চাই। রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আমার কিছু স্বপ্ন আছে। আমি নিজেকে একজন শুধু টিচার মনে করি না। বাংলাদেশের যে ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রবাহ রয়েছে তাতে নিজেকে একজন কর্মী মনে করি। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মনেপ্রাণে লালন করি। আমি স্বপ্ন দেখি এমন একটা দেশের যেখানে এতো বৈষম্য থাকবে না। সবাই ভাল থাকবে। যার যার কর্মস্থলে ভাল থাকবে। আমার যত লেখালেখি, গবেষণা সব কিছুর উদ্দেশ্য হলো দেশের সবাই যেন ভাল থাকতে পারি। একটা আদর্শ ও শান্তির রাষ্ট্র যেন গড়ে ওঠে বাংলাদেশে। মানুষ যেন সেখানে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে।
আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য বিবার্তার পক্ষ থেকে অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকে ও বিবার্তার সব পাঠকদের আন্তরিক ধন্যবাদ।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/মহসিন