দেশে ব্রোকারেজ হাউজের একমাত্র উদ্যোক্তা নারী মালিক খুজিস্তা নূর-ই-নাহরীন মুন্নী। আমাদের দেশে অন্য যে কয়টি ব্রোকারেজ হাউজের নারী মালিক রয়েছেন তাদের ব্যবসাটা পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। ব্যতিক্রম শুধু মুন্নী। শ্রম আর মেধা দিয়ে তিনি তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। প্রমাণ করেছেন চেষ্টা থাকলে নারী-পুরুষ যে কেউ স্ব স্ব ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন।
বর্তমানে একহাতে প্রতিষ্ঠান চালান, একই সঙ্গে স্নেহময়ী মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দুই সন্তানের। যে হাতে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন কিংবা সন্তানের দেখভাল করা হয়, সে হাতে আবার কলম চলে সমান তালে। অবসর পেলেই তিনি লেখালেখি করেন পত্র-পত্রিকায়। সময়ের এই ব্যস্ত নারীর সঙ্গে তার জীবন ও কর্ম নিয়ে কথা হয় বিবার্তার সিনিয়র রিপোর্টার মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদের।
নিজের জন্ম এবং ছেলে বেলার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার জন্ম হয়েছিল মফস্বল শহর জামালপুরে। সাজানো গোছানো একটি ছোট্ট শহর। বাড়িতে ছিল একটি সুন্দর পরিবেশ। লেখাপড়ার পরিবেশও ছিল দারুণ। মা-বাবা সব সময় আমাদের লেখাপড়ার প্রতি খেয়াল রাখতেন। মা যদিও খুব বেশি শিক্ষিতা ছিলেন না; কিন্তু ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল খুব। যেটা কাজেও লাগিয়েছেন তিনি। মায়ের নিয়মগুরো ছিল রুটিন বাঁধা। ভোরে আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়তে হতো, কুরআন পড়তাম। তারপর শরীর চর্চা চলতো কিছু সময়। এরপর পড়তে বসা। পরে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরে খেলাধূলা। আবার পড়তে বসা। এভাবে কেটে যেতো ছেলেবেলার দিনগুলো।
বাড়িতে লেখাপড়ার পরিবেশ থাকায় আমার চাচাতো ভাই, মামাতো ভাইয়েরা আমাদের বাড়িতে এসে থাকতো। মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে আনন্দে দিন কাটতো আমাদের। স্মৃতির জানালা খুলে তাকালে এখনো সেই দিনগুলো দেখতে পাই। সবকিছু হয়ে আছে অমলিন স্মৃতি। এখন সময়ের প্রয়োজনে যে যার মতো করে আছে। সত্যিই মজার ছিল দিনগুলো। পুরুষ প্রধান পরিবারে বেড়ে উঠেছি। ছেলেবেলা কেটে গেছে দেখতে দেখতে। কিচ্ছুই টের পাইনি!
একজন মেয়ের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পারিবারিক অনুশাসন কতোটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আপনার পরিবার থেকে আপনি কেমন অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ?
জবাবে খুজিস্তা নূর-ই-নাহরীন বলেন, সত্যি কথা বলতে কী, একটা ছেলে বা মেয়ের ভবিষ্যত কেমন হবে ছোট বেলায় তার অনেকটা ঠিক হয়ে যায়। সেজন্য পারিবারিক অনুশাসনটা খুব দরকার। সেটা ছেলে-মেয়ে সবার ক্ষেত্রে সমান। আমাদের বাড়িতে ছেলে-মেয়েকে কখনো আলাদা করে ভাবা হতো না। সবার গুরুত্ব থাকতো। আমার বলতে গেলে আরো একটু বেশিই ছিল। আমি তিন ভাইয়ের একটি বোন। তাদের সঙ্গে পড়াশুনা করেছি, খেলাধূলা করেছি। কখনো নিজেকে আলাদা মনে হয়নি। পরিবার থেকে বোঝানো হয়েছে আমাকে বড় হতে হবে। কিছু একটা করে দেখাতে হবে। ছোট বেলা থেকে এটা আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। তাই প্রতিয়োগিতা করতে শিখেছিলাম তখন থেকেই। এটা জীবনে খুব কাজে এসেছে। আমার মনে হয় মেয়েরা যত বেশি কাজের মধ্যে থাকবে, তত বেশি নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে।
খুজিস্তা নূর-ই- নাহরীনের লেখাপড়ার হাতেখড়ি বাড়িতেই। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় জামালপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে। এরপর পড়াশোনা করেন আশেক মাহমুদ মহাবিদ্যালয়ে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখান থেকে রসায়নে অনার্স এবং এমএসসি করেন তিনি। শিক্ষা জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমাদের সময় মেয়েরা খুব একটা সাইন্স পড়তে আগ্রহ দেখাতো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এর সংখ্যা ছিল আরো কম। শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি হবে না। তবে তখনকার বন্ধুরা ছিল খুব হেল্পফুল। খুবই মিস করি ওদের। যে যেখানে আছে খুব ভালো থাকুক।
আমাদের দেশের মেয়েরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বেশিরভাগ সময় বৈষ্যমের শিকার হয়। আপনার ক্ষেত্রে এমনটি কখনো হয়েছে কী?
এ কথা ঠিক যে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মেয়েই পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে বৈষ্যমের শিকার হয়। আর এটার শুরু হয় ছোটবেলা থেকে পারিবারিকভাবে। ফলে কোমলমতি মেয়েটির মন ভেঙে যায় তখনই। ফলে সে সাহসী না হয়ে ভীতু হতে শেখে। তবে আমার জীবনে কখনো আমি বৈষ্যমের শিকার হয়েছি বলে মনে পড়ে না। পারিবারিক পরিবেশ থেকে আজ পর্যন্ত কোথাও না।
সামাজিকভাবেও মেয়েরা বৈষ্যমের শিকার হয়। তবে সব সময় যে এর জন্য সমাজ একা দায়ী তা নয়। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু নারী রয়েছে যারা নিজেরাই নিজেদের নারী ভাবতে ভালোবাসে। আমার মনে হয় তারাই সুযোগটি তৈরি করে দেয়। এর জন্য পরিবার আর সমাজকে যেমন বদলাতে হবে, তেমনি বদলাতে হতে আমাদেরও।
আমি ১৯৯৯ সাল থেকে পুঁজিবাজারের সঙ্গে রয়েছি। আমার হাউজে অনেক নারী বিনিয়োগকারী রয়েছেন। কই কখনো তো কাউকে এখানে বৈষ্যমের শিকার হতে হয়নি। তবে হ্যাঁ আমাদের সমাজে অনেক স্বার্থবাদি মানুষ রয়েছেন। তারা নিজের স্বার্থছাড়া কিছু বোঝেন না। সেটা ছেলে-মেয়ে যে কেউ হতে পারে।
আমার স্বামীর অনেক বড় ব্যবসা ছিল। যার মধ্যে তিনি তার কিছু বন্ধকে ইনভলব করেছিলেন। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর তার বন্ধুরা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। মানুষ হিসেবে এটা কেউই আশা করে না। তবে এসব মানুষ সমাজে ছিল, আছে, থাকবে। এর মধ্যে দিয়েই নারী-পুরুষ সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন তো থেমে যাওয়ার নয়। জীবন থাকলে ছন্দপতন ঘটতেই পারে। এতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই।
আপনি একটা ব্রোকারেজ হাউজের মালিক। কীভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন?
আমি বরাবরই স্বাধীনচেতা মানুষ। পড়াশুনা শেষ করে আমার একটা চাকরি হয়। যখন আমি মা হই, সেই সময় সন্তানের কথা ভেবে আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। পুরোপুরি হাউজ ওয়াইফ হয়ে যাই। কিন্তু আমার এটা ভালো লাগতো না। মনে হলো একটা কিছু করি। ফলে শেয়ার ব্যবসায় নেমে পড়ি। পরে জানতে পারলাম ব্রোকারেজ হাউজ সেল হবে। তখন আমি ব্যবসায় বেশ লাভ করেছি। হাতে টাকা ছিল। হাউজটা কিনে নিই। এরপর প্রতিষ্ঠান চালানোর দায়িত্বও নিই। শিখতে হয় অনেক কিছু। সাইন্সের ছাত্রী হওয়ার কারণে আমাকে কমার্স বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। হাউজে হাউজে ঘুরে এই কাজগুলো শিখে নিয়েছি। একটা সময় সিডিবিএলের কাজগুলো শিখে নিই। এভাবেই শুরু।
মাঝে মধ্যে পত্রপত্রিকায় আপনার লেখা দেখতে পাওয়া যায়। লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন কীভাবে?
ওই যে বললাম, আমাদের বাড়িতে পড়াশুনার দারুণ একটা পরিবেশ ছিল। সেজন্য ছোটবেলা থেকেই অ্যাকাডেমিক পড়ার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতাসহ বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করি। মূলত সেখান থেকেই লেখালেখির প্রেরণা পাই। আমি কেমন লিখি তা বলতে পারবো না। তবে আমি একজন ভালো পাঠক সে দাবি করতেই পারি।
জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়েছেন তিনি। যার কারণে বন্ধুরা তাকে বলতেন ‘বইপোকা’। ভালোবাসতেন গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, গোয়েন্দা কাহিনী সবই। তাঁর সেরা তালিকায় রয়েছে, সুনীল গঙ্গোপ্যাধায়, শীর্ষেন্দু, সমরেশ মজুমদার, সমরেশ বসুসহ আরো অনেকে। এক সময় অখণ্ড অবসর ছিল তার। প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। এখন আর তেমন সময় পান না। পেলে বই পড়েন, গান শোনেন। বাকিটা সময় বরাদ্দ থাকে ছেলে-মেয়েদের জন্য। তিনি জানালেন তার ভূবন এখন ছেলে-মেয়েদের ঘিরে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা তেমন কিছু নেই খুজিস্তা নূর-ই-নাহরীনের। তার মতে কখন কী করতে হবে, তা সময়ই বলে দেবে। কেউই ভবিষ্যত বলতে পারে না। তবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা থাকা দরকার সবারই।
বিবার্তা/নাহিদ/মহসিন/কাফী