বাবা মোটরসাইকেল মেকানিকস। সারাদিন দোকানে মেকানিক্যাল কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়েই কোনোমতে সংসার চলে। এমন টানাপোড়েনের সংসারে বাবা স্বপ্ন দেখেন একমাত্র ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার ও মেয়েকে ডাক্তার বানানোর। ছোটবেলা থেকেই ছেলেকে সেভাবে গড়ে তোলেন তিনি। সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। ছেলে এখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে সেন্টার ফর রিসার্চ ইনফরমেশন (সিআরআই) প্রতিষ্ঠানে অ্যাসিস্টেন্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তন্ময় আহমেদের জন্ম গাইবান্ধা জেলার পলাশ বাড়িতে। বাবা মোহাম্মদ মানিক মিয়া পেশায় একজন মোটরসাইকেল মেকানিকস। মা ফারজানা বেগম গৃহিণী। ছোটবোন পড়ালেখা করছেন ময়মনসিংহ মেডিকেলে দ্বিতীয় বর্ষে।
বাবার কথা বলতে গিয়ে জানালেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করে দুই সন্তানকে পড়ালেখা করিয়ে ছোটবেলা থেকেই নিজের মতো করে গড়ে তোলেন। তিনি যে কষ্ট করছেন, এভাবে যেন সন্তানদের কষ্ট করতে না হয়। সেজন্য তাদেরকে পড়ালেখা করিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিজ্ঞা করেন বাবা মানিক মিয়া। সব সময় সন্তানদের পাশে থেকে বন্ধুসুলভ আচরণ করে একটু একটু করে তাদের তৈরি করেছেন। বাবা-মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সঠিক দিকনির্দেশনায় তিনি আজ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বোন ডাক্তারি পড়ছেন।
তন্ময়ের শৈশব-কৈশোরের স্বর্ণালী দিনগুলো কাটে পলাশবাড়ীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে তখনও আধুনিক সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি। পড়ালেখা করার মতো ভালো পরিবেশ ছিল না। এমনই প্রতিকূল পরিবেশে প্রাইমারি পড়ালেখা করেন ‘আইআর প্রি-ক্যাডেট হাইস্কুলে’। বাবার কষ্টের টাকা যেন বৃথা না যায় সেজন্য প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও মনোযোগ সহকারে পড়ালেখা করেন। প্রতিদিন রুটিন মাফিক পড়ালেখা করে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পান। বাবার স্বপ্ন যায় এক ধাপ এগিয়ে। হাসি ফোটে পরিবারের সবার মুখে।
হাইস্কুল জীবন শুরু হয় ‘এসএম পাইলট হাইস্কুলে’। স্কুলের পরিবেশ ও শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল অনেক উন্নত। হাইস্কুলের শুরুতে অনেক সংগ্রাম করে পড়ালেখা করতে হয়েছে তন্ময়কে। অস্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে সফল হন। পেয়ে যান বৃত্তি। গাইবান্ধা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি। এতে বাবা-মা খুশি হয়ে তাকে পড়ালেখার প্রতি আরো উৎসাহ দেন।
কথা প্রসঙ্গে জানালেন, ছোটবেলা থেকেই ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তন্ময় আহমেদ। চতুর্থ শ্রেণি থেকেই বাবা তাকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্নের কথা বলেন। বাবার প্রেরণাতেই তিনি পড়ালেখা করেন আর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্নকে মনে লালন করেন। ধীরে ধীরে এগিয়ে যান সেই স্বপ্নের পথে। এসএসসিতে প্রথম বিভাগে পাস করেন। অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর অন্যতম সেরা কলেজ নটরডেমে ভর্তি হতে পারেননি। স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই সুযোগ পেয়ে যায়। শেষে তিনি ভর্তি হন রাজধানীর সেন্ট যোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজে।
কলেজ জীবন বিষয়ে জানান, সেন্ট যোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ একটা মিশনারি প্রতিষ্ঠান। কঠোর নিয়মনীতি আর শৃঙ্খলার মধ্যে পরিচালিত হয় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রম। পড়াশুনার পাশাপাশি জীবন গঠনমূলক নানা বিষয় শিক্ষা দেয়া হয়। সারাদিন ল্যাব, লাইব্রেরি আর ক্লাস- এভাবেই কাটে কলেজের দিনগুলো।এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়ে পাস করেন।
এইচএসসিতে গোল্ডেন এপ্লাস পাওয়ায় স্বপ্নের আশি ভাগ পূরণ হয় তার। অধরা স্বপ্ন ধীরে ধীরে আসতে থাকে তার হাতের মুঠোয়। তন্ময় প্রস্তুতি নেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তিযুদ্ধের। বুয়েটে ইলেক্ট্রিক্যাল, কম্পিউটার, মেকানিক্যাল, সিভিল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়েরিং, কেমিক্যাল, মেটার্লজি, আরবান প্ল্যানিং, ন্যাভাল আর্কিটেকচার, আর্কিটেকচার এবং ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং- এই এগারোটি বিষয়ের মধ্যে তিনি সুযোগ পান সিভিলে। শুরু হয় ভার্সিটির জীবন। শুরুতে বাবার কষ্টার্জিত টাকাতেই চলে পড়ালেখা। এক বছর পরে টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার হাতখরচ চালাতে লাগলেন। পড়ালেখা করতে করতে এক সময় ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ২০১১ সালে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পড়ালেখার পাশাপাশি চলতে থাকে ছাত্ররাজনীতির জীবনও।
ছাত্ররাজনীতির জীবনে স্মরণীয় ঘটনা বিষয়ে জানান, ২০১২ সালে বুয়েটে একটা আন্দোলন হয় ভিসির বিরুদ্ধে। জামায়াত অনুসারী ছাত্ররা কিছু সাধারণ ছাত্রকে ভুল বুঝিয়ে এ আন্দোলন করে। ওই আন্দোলনে ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের ছাত্রদের ওপরে বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায়। ওই আন্দোলনের জের ধরেই ২০১৩ সালে আগস্টের ১০ তারিখে নিজের এলাকা পলাশবাড়ীতে শিবিরের হামলায় গুরুতরভাবে আহত হন তন্ময়। ক্ষতবিক্ষত হয় তার সমস্ত শরীর। শরীরে ১৩টা বড় বড় জখম হয়। এতে ১৩২টা সেলাইয়ের মধ্যে শুধু মাথায় ৩৫টা সেলাই দেয়া হয়। দীর্ঘদিন রংপুর মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে নতুন জীবন ফিরে পান তিনি।
কর্মজীবন প্রসঙ্গে জানালেন, ২০১৩ সালের অক্টোবরের ১১ জুন তৎকালীন বিদুৎ প্রতিমন্ত্রী তাকে সিআরআই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ করে দেন। বর্তমানে তিনি অ্যাসিসস্টেন্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে দুটি বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন তন্ময়। প্রথমত জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পরিবারের গবেষণা কাজের মধ্য দিয়ে তার শিক্ষা, মূল্যবোধ ও আদর্শ, তার জীবনকে প্রভাবিত করে। গবেষণা কাজের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন খুজে পান। কীভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবার কল্যাণ কামনা করা যায়। দেশকে কীভাবে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেয়া যায় সেসব চিন্তা-চেতনা।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানান- ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘ইয়ং বাংলা প্লাটফর্ম’ নামে একটা প্রজেক্ট চালু হয় সিআরআই প্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কাজ করার সুযোগ হয় তার। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায়, অজপাড়াগাঁয়ে। যেখানে ২০ জনও শিক্ষিত পাওয়া যাবে না এমন এলাকায় কল্যাণমূলক কাজ করাই এ সংগঠনের মূল কাজ। এসব এলাকায় ৪র্থ শ্রেণির মেয়েকে বিয়ে দেয়া হয়। সমাজে মানুষের মনের এসব সমস্যা, গোড়ামি ও কুসংস্কার দূর করতে এ সংগঠনের সাথে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এখনও তাদের সাথেই কাজ করছেন তিনি।
গবেষণার বিষয়ে জানান, বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে পলিটিক্যাল ইস্যুর সাথে সম্পৃক্ত করা যায়। তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত করে তাদের দিয়ে দেশের কল্যাণমূলক কাজ করানো যায়। মোট কথা ভবিষ্যৎ রাজনীতি নেতৃত্ব তৈরিই গবেষণার প্রধান লক্ষ্য।
গবেষণা কাজের স্বপ্ন বিষয়ে জানালেন, গবেষণার মাধ্যমে তরুণদেরকে দেশের আদর্শ রাজনীতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে রাজনীতি করে গেছেন আজকের তরুণরা যেন সেই রাজনীতির বিষয়ে জানতে পারে। সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মূলধারার রাজনীতি করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। দেশের মেধাবী তরুণদের অনুপ্রাণিত করাই তার গবেষণার মূল লক্ষ্য বলে জানান তন্ময়।
দেশের কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তির বিকৃত মানসিকতার জন্য মূলধারার রাজনীতিকে অনেক তরুণই ভালোভাবে জানে না। রাজনীতির খারাপ দিক নিয়েও গবেষণা করছেন তিনি। একই সাথে গবেষণা করছেন কীভাবে রাজনীতির খারাপ দিকগুলো বর্জন করে ভালো ও আদর্শ রাজনীতিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করে দেশকে সঠিক পথে নেতৃত্ব দেয়া যায়। এমন একটা দেশের স্বপ্ন দেখেন তিনি যে দেশ হবে সত্যিকারের সোনার বাংলা। যেখানে সবাই বাস করবে সুখে ও শান্তিতে।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/মহসিন/কাফী