গুলশাহানা ঊর্মির স্বপ্ন পূরণের গল্প

গুলশাহানা ঊর্মির স্বপ্ন পূরণের গল্প
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০১৬, ২০:৫৫:১৯
গুলশাহানা ঊর্মির স্বপ্ন পূরণের গল্প
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+
শৈশবে শাবানা ও আলমগীর অভিনীত ‘জজ ব্যারিস্টার’ সিনেমা দেখে নায়িকা শাবানার মতো জজ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সময়ের সাথে স্বপ্নের প্লট বদলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন জাগে। আবার কখনও কখনও বাবার মতো আমলা হওয়ারও ইচ্ছে হতো।
 
অন্যদিকে কণ্ঠের বলিষ্ঠতার জন্য পরিচিতজনরা ল’ইয়ার হওয়ার পরামর্শও দিতো। ল’ইয়ার হওয়ার টার্গেট নিয়ে ঢাবিতে চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু হলো না। তারপরে মাথায় আসে রাজনীতি। সেই স্বপ্ন পূরণে জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে নানা ঘটনা।
 
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নিজ বাসায় দীর্ঘ আড্ডায় বেরিয়ে আসে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা ঘটনা। 
 
বাবার চাকরির সুবাদে গুলশাহানা ঊর্মির জন্ম চট্টগ্রাম শহরে। গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার চরপাড়ায়। দুই ভাই-দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
গুলশাহানা ঊর্মির স্বপ্ন পূরণের গল্প
বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। তাঁর নীতি-আদর্শকে বুকের গভীরে লালন করেন। আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়ার অপরাধে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। বর্তমানে ব্যবসা করছেন। মা গৃহিনী।
 
গুলশাহানা ঊর্মির শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো কাটে দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় তাকে যেতে হয়েছে। ফলে কোথাও একটানা বেশি দিন পড়াশুনা করার সুযোগ হয়নি। কোথাও এক বছর। কোথাও পাঁচ মাস। আবার কোথাও পড়াশুনা শুরুও করেননি। এভাবেই কাটে প্রাইমারি জীবন। 
 
প্র্থম স্কুলজীবনের স্মৃতি বিষয়ে ঊর্মি বলেন, প্রথম স্কুলের কথা খুব বেশি মনে নেই। কারণ তখনও আমার স্কুলে যাবার বয়স হয়নি। আমার বয়স তখন তিন কি সাড়ে তিন বছর। বাবার পোস্টিং ছিল মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায়। গজারিয়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার (টিএনও) তখন। গজারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নার্সারিতে ভর্তি হই। স্কুলে যেতে একটা ছোট নদী ছিল। মনে আছে নদীর ওপর কাঠের ব্রিজ ছিল। শুকনা মওসুমে নদীতে পানি এতোটাই কম থাকতো যে পায়ে হেঁটে পার হওয়া যেত। স্কুলের পাশেই ছিল কলাই ক্ষেত। ক্লাসে যাওয়ার চেয়ে সেই কলাই ক্ষেতে আমি আর আমার ছোট ভাই খেলাধুলা করতেই বেশি পছন্দ করতাম।
 
আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা শুরুর বিষয়ে গুলশাহানা ঊর্মি বলেন, নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার ‘কালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ শুরু হয় আমার অনুষ্ঠানিক পড়ালেখা। বাবার তখন কালিয়ায় পোস্টিং ছিল। সেখানে আমি নার্সারিতে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি হই। সেই দিনগুলোর কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। ওখানকার প্রিন্সিপ্যাল স্যার, সহপাঠীদের কথা মনে আছে।
গুলশাহানা ঊর্মির স্বপ্ন পূরণের গল্প
আমার ক্লাসে একজন অন্ধ মেয়ে পড়তো। সে ছিল খুবই মেধাবী। আমি নার্সারিতে প্রথম হয়েছিলাম। মেয়েটি হয়েছিল দ্বিতীয়। এরপরে ১৯৯১ সালে বিএনপি'র ক্ষমতায় আসা এবং বাবা চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ায় আমরা চলে আসি জামালপুরে। পোগলদীঘা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাটে প্রাইমারি স্কুলজীবন। পড়ালেখায় সব সময় ক্লাসে ফার্স্ট হতাম।
 
পড়ালেখার পাশাপাশি শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক জগতে শুরু হয় তার পথচলা। কালিয়ায় থাকার সময় চার বছর বয়সেই শিশু ছড়াগানের মধ্য দিয়ে হয় গানে হাতেখড়ি। গান শেখার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি এত ছোট ছিলাম যে, হারমোনিয়াম নিজে টানতেও পারতাম না। আমি বাজাতাম আর পেছন থেকে একজন ঠেলতো। এরপরে থ্রি-ফোরে পড়ার সময় নিজ এলাকায় শাপলা শালুক সাংস্কৃতিক একাডেমিতে কবিতা ও দেশের গানের চর্চা করতাম।সেখানে ক্লাস টেন পর্যন্ত গানের চর্চা করি।
 
গুলশাহানা ঊর্মির হাইস্কুল জীবন শুরু হয় পোগলদীঘা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিজ্ঞান গ্রুপ থেকে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। পরে কলেজে ভর্তি হন যমুনা সার কারখানা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই কলেজে যারা সার কারখানার চাকরি করেন শুধু তাদের ছেলে-মেয়েদেরই পড়ালেখার সুযোগ ছিল। তবে বাইরের কিছু মেধাবী ছাত্রীদেরও পড়ালেখা করার সুযোগ দেয়া হতো। পোগলদীঘা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ওখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়েছিল তার।
 
২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে। ইচ্ছে ছিল ‘ল’তে পড়ার। কিন্তু সুযোগ না হওয়ায় শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষে রেজাল্ট ভালোই ছিল। পরে বিভিন্ন কারণে শিক্ষক হওয়ার মতো রেজাল্ট করতে পারেননি।
 
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে জানালেন, ঢাবিতে প্রথম বর্ষ থেকেই তিনি ছাত্ররাজনীতির সাথে সক্রিয় হন। কারণ ছোটবেলা থেকেই তার রাজনীতির প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। ছাত্ররাজনীতির প্রতি এতো বেশি ঝোঁক ছিল যে, রাজনীতি করার জন্য হলে সিট হওয়ার দুইতিন দিন পরই হলের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিকে খুঁজে বের করেন। তাদের কাছে গিয়ে সরাসরি বলেন, আমি ছাত্রলীগ করতে চাই। সাথে সাথেই তাকে দলে বরণ করে নেয়া হলো। পরের দিন থেকেই শুরু হয় মধুর ক্যান্টিনে যাওয়া এবং মিছিল মিটিংয়ে অংশ নেয়া।
 
ছাত্ররাজনীতি জীবনের স্মরণীয় ঘটনার বিষয়ে গুলশাহানা ঊর্মি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তার একটা শখ ছিল-জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করা। স্বপ্ন দেখতেন ঢাকায় গিয়ে একদিন জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করবেন। ঢাবিতে ভর্তি হয়ে রাজনীতি করার সুবাদে সেই সুযোগ এসে যায়।
গুলশাহানা ঊর্মির স্বপ্ন পূরণের গল্প
এক অনুষ্ঠানে জীবনে প্রথমবারের মতো শেখ হাসিনাকে কাছে থেকে দেখা ও পায়ের ধুলা নেয়ার সুযোগ হয়। সেই দিনের আনন্দের স্মৃতি ডায়রির তিন পাতা জুড়ে স্থান করে নেয়। অনার্স ও মাস্টার্স পাস করার পরও রাজনীতিতে অ্যাকটিভ ছিলেন। ২০০৯ সালের শেষের দিকে বিসিএস’র ভাইভা দেয়ার পর (সিনিয়রদের পরামর্শ মতো) আর কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি। এভাবেই শেষ হয় তার দীর্ঘ ৭ বছরের ছাত্ররাজনীতির জীবন।
 
রাজনীতি করে কী পেয়েছেন জানতে চাইলে ঊর্মি বলেন, আমি জাতির পিতার আদর্শের সৈনিক, এটাই আমার বড় পাওয়া। এরপরও যদি কিছু জানতে চান তাহলে বলবো- রাজনীতি করার কারণেই পেয়েছি অসংখ্য সিনিয়র-জুনিয়র ভাই ও বোন। বিশেষ করে বলবো আমার দিদি হাসি আপু, বিউটি আপু'র মতো আপনজনদের। এমনি রাজনীতি করার কারণেই সৈকতেরর সাথে আমার পরিচয়। এরপর প্রণয় এবং বিয়ে।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে এসে টিএসসির সাংস্কৃতিক একাডেমি ‘দৃষ্টি’র সদস্য হন। ২০০৩ থেকে দৃষ্টি সংগঠনের মাধ্যমে কবিতা আবৃত্তি, দেশের গান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গান করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে আয়োজিত মুক্তমঞ্চে যে প্রোগ্রাম হতো এগুলোতে অংশ নিতেন তিনি। এসব অনুষ্ঠানে শ্রুতিনাট্য, গান, কবিতা আবৃত্তি অনুষ্ঠান করা হতো। দৃষ্টি সংগঠনের হয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টানা ৭-৮ বছর পারফরমেন্স করেন।
গুলশাহানা ঊর্মির স্বপ্ন পূরণের গল্প
ঢাবিতে পড়ালেখার রেজাল্ট বিষয়ে জানালেন, বিভিন্ন কারণে অনার্সের রেজাল্ট ভালো হয়নি। ফার্স্টক্লাস না পাওয়ায় শিক্ষকতা করার স্বপ্নটা শেষ হয়ে যায়। অনার্স শেষ হওয়ার সাথে সাথে বিসিএস’র সার্কুলার দিলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান) হিসেবে বাংলাদেশ বেতারে যোগদান করেন।
 
কথা প্রসঙ্গে গুলশাহানা ঊর্মি বলেন, ছোটবেলায় শাবানা-আলমগীর অভিনীত ‘জজ ব্যারিস্টার’  ছায়াছবি দেখেছিলাম। শাবানা সেখানে জজের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তখন মনে হতো শাবানার মতো জজ হবো। যখন ক্লাসএইট-নাইনে উঠলাম তখন বাবা-মা বলতো ডাক্তার হও। আমার ল’ইয়ার (আইনজীবী) হওয়ারও ইচ্ছে ছিল।
 
সবাই বলতো তুমি ল’ইয়ার হলে ভালো করবে। আর এই টার্গেট নিয়েই ঢাবিতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু হলো না। তারপরে মাথায় আসলো বিয়েশাদি করবো না। পুলিশ অফিসার হবো। বা রাজনীতি করব। আরেকটা শখের জায়গা ছিল সৃজনশীল কাজ করার। যেখানে নিজের সৃজনশীলতাকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা যায়। বেতারে চাকরি সুবাদে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়।
 
বেতারে চাকরির অভিজ্ঞতার বিষয়ে বলেন, আমার অনেক কলিগকে দেখেছি জব নিয়ে হতাশায় ভুগছেন। আমার মধ্যে এ ধরনের হতাশা কাজ করেনি। আমি এই জব পাওয়ার পরে আর বিসিএস দিইনি। শিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগতো। এর জন্য চাকরি নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। আমি পাঁচ বছর তিন মাস বেতারে কাজ করার পর সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগদান করেছি।
 
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেস উইয়িংয়ের মনিটরিং সেলে মনিটরিং অফিসার হিসেবে চলতি বছরের ১৬ মার্চ যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি থাকতে পারা, কাজ করতে পারার একটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় তিনি এখন অনেক খুশি।
 
আলাপ প্রসঙ্গে জানা গেল, বিসিএস দিয়ে বাংলাদেশ বেতারে চাকরি হয়। তখন নতুন জীবনের প্রস্তাব পান। বিয়ে হয়। স্বামী এন আই আহমেদ সৈকত পেশায় ব্যবসায়ী।অ্যারন ফ্যাশন ওয়ারের সত্ত্বাধিকারী। চার বছরের ছেলে শায়াননুর ও আট মাস বয়সের মেয়ে সৈমী নুরকে নিয়েই তার সুখী পরিবার। এখন জব, স্বামী সংসার নিয়ে খুব সুখী জীবনযাপন করছেন গুলশাহানা ঊর্মি।
 
বিবার্তা/উজ্জ্বল/কাফী
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com