নাচের মুদ্রায় উদ্ভাসিত শিপ্রা প্যারিশ

নাচের মুদ্রায় উদ্ভাসিত শিপ্রা প্যারিশ
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০১৬, ২০:২২:৩০
নাচের মুদ্রায় উদ্ভাসিত শিপ্রা প্যারিশ
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+
বিয়ের পর স্বামী প্রথমে ভাবতো আমি পাগল হয়ে গেছি। কারণ রাতে ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ উঠে বসে নাচের মুদ্রা করছি। সারা ঘরে হাঁটছি, নাচের কসরৎ করছি। গাড়িতে বসেও গুণগুণিয়ে গান করছি আর নাচের মুদ্রা করছি। এসব দেখে স্বামী আমাকে বলে শিপু এসব কী? মানুষ কী ভাববে? তখন আমি বলি মাথায় একটা নাচের মুদ্রা এসেছে।
 
স্বামীর ভাষায় আমার অন্তরে, ভেতরে, বাইরে সব জায়গায়ই নাচের মুদ্রা। আমি কাউকে অনুসরণ করি না। নিজের নৃত্যশৈলীর প্রতিভা দিয়ে নাচের মুদ্রা তৈরি করি। আমার অন্তর থেকে সেটা সৃষ্টি হয়। রক্তের সাথে মিশে আছে নাচ। তাই কেউ আমাকে পাগল বললে ভুল হবে না। আর সে নাচের জন্য পাগল।
 
বলছিলাম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নৃত্যশিল্পী শিপ্রা প্যারিশের কথা। তিনি শুধু একজন নৃত্যশিল্পীই নন, নৃত্যপরিচালক, নৃত্য সংগঠক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে জ্যোতি ছড়িয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও। আজীবন নৃত্যের প্রতি ভীষণ অনুরাগী। নৃত্যাঙ্গণে তৈরি করেছেন শক্ত আসন। পাশাপাশি অর্জন করেছেন আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা। নৃত্যাঙ্গনে তিনি আপন আলোয় উদ্ভাসিত।
 
জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সব কয়টি স্যাটেলাইট চ্যানেল, নৃত্য অ্যাকাডেমি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে রয়েছে তার সরব উপস্থিতি।
নাচের মুদ্রায় উদ্ভাসিত শিপ্রা প্যারিশ
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নিজ বাসায় দীর্ঘ আড্ডায় বেরিয়ে আসে তাঁর নৃত্যশিল্পী জীবনের বর্ণাঢ্য নানা ঘটনা। নৃত্যশিল্পী শিপ্রা প্যারিশের সেই বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প জানাচ্ছেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
 
গাজীপুর জেলার মাউছাইদ মিশনের হারবাইদ গ্রামে জন্ম শিপ্রা প্যারিশের। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। বাবা ড্যানিয়েল প্যারিশ প্রবাসী ও মা আগ্নেস ক্রুশ গৃহিনী। নাচের শুরুটা কীভাবে হলো জানতে চাইলে শিপ্রা বলেন, খুব ছোটবেলা থেকেই আমার নাচের শুরু। 
 
আমার বড় বোন মনিকা নাচ করত। তাকে বেশি করে দেখতাম। তার নাচ আমাকে খুব বেশি টানতো। তখনও বুঝতে শিখিনি। নাচের প্রতি আগ্রহ দেখে বড় বোন আমাকে নাচের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে। তার ও মায়ের উৎসাহে শুরু হয় আমার নাচের প্রাথমিক পথচলা। বলতে গেলে নাচ কী তা বুঝতে শেখার আগে থেকেই নাচ আমার মধ্যে ছিল। এখন আমার রক্তে মিশে আছে। এখন সমস্ত সত্তাজুড়ে শুধুই নাচ। অন্য কিছু এখন আর ভাবতে পারি না।
 
শৈশবের নাচের স্মৃতি বিষয়ে বলেন, তখন হারবাইদ মিশনের প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ি। গাজীপুর নিজ জেলায় সরকারি স্কুলে আমাকে নাচের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অনুষ্ঠানে নেচে আমি চ্যাম্পিয়ন হই। পরের দিন আমাকে ক্লাস টু থেকে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করা হয়। কারণ আমাকে জেলা থেকে টিএনও নাকি দেখতে আসবে। সেই থেকে অবিরাম পথচলা। গ্রাম, মিশন, জেলা, নিজের দেশ ছাড়িয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের ১৮টি দেশে ঘোরার সুযোগ হয়েছে।
 
ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একজন নৃত্যশিল্পী হওয়ার। পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা গাজীপুর জেলার অঞ্চলভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একজন শিশুশিল্পী হিসেবে বিটিভিতে প্রথম সুযোগ পান শিপ্রা প্যারিশ।
 
এরপরে নিজেকে আরো শাণিত করার স্বপ্ন নিয়ে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) থেকে ১৯৯৯ সালে নৃত্যে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে বিটিভির নৃত্যশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপরই শুরু হয় তার অবিরাম পথ চলা। আর সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলা।
নাচের মুদ্রায় উদ্ভাসিত শিপ্রা প্যারিশ
সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার পাশাপাশি পড়াশুনায়ও মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। পড়াশুনা বিষয়ে জানালেন, মিশনারি স্কুল ও হারবাইদ সরকারি প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা, গাজীপুরের হারবাইদ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রাজধানীর লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি প্রথম বিভাগে পাস করে কৃতিত্বের সাথে অনার্স পাস করেন। বর্তমানে নর্দার্ন ইউনির্ভাসিটিতে অাইন বিষয়ে  অধ্যয়ন করছেন।
 
আপনি সাধারণত কী ধরনের অনুষ্ঠান করেন- এম প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, একেক অনুষ্ঠান একেক রকম। ঈদ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে, বিশেষ দিবসে-যেমন পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে নাচ করি। দলীয় নৃত্য,দ্বৈত নৃত্য। বেশিরভাগ দ্বৈত নৃত্য করি। তবে টেলিভিশনে ও মঞ্চে দলীয় নৃত্য বেশি করা হয়।
 
শিপ্রা মনে করেন, নৃত্য সাধনা ও অনুশীলনের বিষয়। শুধু শারীরিক অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমেই নৃত্যকলার পরিস্ফূটন সম্ভবনা। কেবলমাত্র নৃত্যকে যারা মন-প্রাণে ধারণ করতে পারে তারাই প্রকৃত নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠতে পারে।
 
তিনি একজন সংগঠক ও নৃত্যপ্রশিক্ষক হিসেবেও সাফল্যের সাক্ষর রেখেছেন। দীপ্ত নৃত্যকলা একাডেমির কর্ণধার নৃত্যপ্রশিক্ষক হিসেবে দক্ষতা প্রমাণের পাশাপাশি সুনামও কুড়িয়েছেন। বর্তমানে তার একাডেমিতে ১৮০০ ছাত্রছাত্রী নৃত্যের উপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
 
শিপ্রা বর্ণাঢ্য নৃত্যজীবনে অনেক জ্ঞানী-গুণী এবং প্রতিষ্ঠিতজনদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাদের সাথে একান্ত ভাব বিনিময় করেছেন। তাদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ। এসব গুণীজনদের তালিকায় আছেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
নাচের মুদ্রায় উদ্ভাসিত শিপ্রা প্যারিশ
এ প্রসঙ্গে শিপ্রা প্যারিশ উচ্ছ্বসিতভাবে বলেন, আমি নিজেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান মনে করি এই কারণে যে, আমি এই অল্প বয়সে অনেক গুণীজনদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। আর মজার ব্যাপার হলো সবাই আমাকে অনেক সহযোগিতা ও আশীর্বাদ করেছেন।
 
আমেরিকা, চীন, ভারত, নেপাল, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, দুবাই, কাতার, বার্মা, সিঙ্গাপুরসহ পৃথিবীর ১৮টিদেশে তিনি সফর গিয়ে নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। নৃত্য পরিচালক হিসেবেও দেশের বাইরে কাজ করেছেন। এসব দেশের নৃত্যশিল্পীদের সাথে সেতুবন্ধন রচনা করে সৃষ্টি করেছেন আন্তর্জাতিক নৃত্যবলয়। 
 
তাদের সাথে ভাবের আদান-প্রদান তার নৃত্যশিল্পকে করেছে সমৃদ্ধ। শিপ্রা শুধু ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগেই নয়। সরকারি সফরেও একাধিকবার গিয়েছেন দেশের বাইরে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পারফর্ম করে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। দেশে ও দেশের বাইরে তিনি অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়ে দেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান।
 
জীবনে কতগুলো পুরস্কার পেয়েছেন জানতে চাইলে মিষ্টি হেসে শিপ্রা বলেন, একদম শৈশব থেকে পুরস্কারের হিসেব করলে তো অনেক। আপনিই তো দেখেছেন। এগুলো বর্তমানের। আমার গ্রামের বাড়িতেও আছে অসংখ্য। গুনলে হাজারেরও বেশি হবে।
 
শিপ্রার নৃত্য পরিচালায় ‘আমার সখা’, ‘ছোট্ট একটু ভালবাসা’, ‘নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি‘হাজার বছর ধরে’ ও  ‘ওগো বিদেশিনী’ চলচ্চিত্রগুলো নৃত্যের জন্য ব্যাপক প্রশংসিত হয়। লাভ ২০১৬ চলচ্চিত্রটি মুক্তির অপেক্ষায়।
নাচের মুদ্রায় উদ্ভাসিত শিপ্রা প্যারিশ
এ প্রসঙ্গে শিপ্রা বলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সব স্যাটেলাইট চ্যানেলেই ‘দীপ্ত নৃত্যকলা একাডেমি’র নৃত্যশিল্পীরা অংশগ্রহণ করে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ‘দীপ্ত নৃত্যকলা একাডেমি’ দেশের অন্যতম সেরা নৃত্য একাডেমি হিসেবেপুরস্কার লাভ করে।
 
সেদিনের তিনজন ছাত্রী নিয়ে গড়ে ওঠা ‘দীপ্ত নৃত্যকলা একাডেমি’ আজ হাজারো নৃত্যশিল্পী নিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটি থেকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার লাভ করেছে। একাডেমির পরিচালিকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেরা নৃত্যশিল্পীর পুরস্কার লাভ করেন। 
 
বাংলাদেশ টেলিভিশন দর্শক ফোরাম ২০০২-২০০৩, একুশে পুরস্কার-২০০৩, বেগম রোকেয়া কামাল সম্মাননা-২০০৫, কাগজ কলম ইনডেক্স পুরস্কার-২০০৮-২০০৯, বিনোদনধারা পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড-২০০৮-২০০৯, বাবিসাস অ্যাওয়ার্ড-২০১০-২০১৫।
 
এছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে চীনের বেইজিংয়ে ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল ২০০৯ স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ভারতের কলকাতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পুরস্কার-২০১০, এপার বাংলা-উপার বাংলা মৈত্রী সম্মননা-২০১৫ ও নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ ড্যান্স ফেস্টিভ্যাল পুরস্কার লাভ করেন। সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকার  ফ্লোরিডা থেকে রবীন্দ্র সম্মেলনে বারাক ওবামার প্রধান উপদেষ্টার হাত থেকে নৃত্যশিল্পী পুরষ্কার লাভ করেন।
 
নৃত্যশিল্পী শিপ্রা তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একনিষ্ঠ সাধনার মাধ্যমে আজ এই পর্যায়ে এসেছেন। আগামীতেও নিষ্ঠা ও একাগ্রতা কাজে লাগিয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান। তিনি চান ‘দীপ্ত নৃত্যকলা একাডেমি’তে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নৃত্যশিল্পী তৈরি করতে। আর এভাবেই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে একাডেমির মান আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।
 
ব্যক্তিগত জীবন বিষয়ে জানালেন, স্বামী  উইলিয়াম হিল্লোল প্যারিশ। পেশায় প্রাইভেট সার্ভিস হোল্ডার। একমাত্র মেয়ে শ্রেষ্ঠা হিয়া প্যারিশ। বয়স ৭ বছর। ক্লাস থ্রিতে পড়ছে। তাদের নিয়েই তার সুখি পরিবার। বর্তমানে বাবা-মা, স্বামী, একাডেমীর সব সন্তানদের নিয়ে খুব সুখি জীবনযাপন করছেন শিপ্রা প্যারিশ। 
 
বিবার্তা/উজ্জ্বল/কাফী
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com