‘স্বীকৃতি থেকেই প্রেরণার জন্ম’

‘স্বীকৃতি থেকেই প্রেরণার জন্ম’
প্রকাশ : ১০ মে ২০১৬, ১৮:১৪:০৪
‘স্বীকৃতি থেকেই প্রেরণার জন্ম’
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+
একসঙ্গে অনেক কিছুই করেন তিনি। লিখছেন উপন্যাস, নাটক, গল্প। এর বাইরে ছড়াকার হিসেবেও রয়েছে তার ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা। তিনি আমাদের সাহিত্য ও শিল্পাঙ্গনের অতি পরিচিত মুখ পলাশ মাহবুব। 
 
বর্তমানে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবেও তৈরি হয়েছে তার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা। তার নির্মিত অনুষ্ঠানের সংখ্যা ইতোমধ্যে পনের শ’ ছাড়িয়ে গেছে। নির্মাণ করেছেন বেশকিছু উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। 
 
পলাশ মাহবুব পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। পেশা হিসেবে কিছুকাল সাংবাদিকতা করেছেন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে। বর্তমানে তিনি বেসরকারি চ্যানেল বৈশাখী টৈলিভিশনে সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত।
‘স্বীকৃতি থেকেই প্রেরণার জন্ম’
গত বুধবার রাজধানীর মহাখালীর বৈশাখী টেলিভিশন কার্যালয়ে বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদকের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন তিনি। একান্ত আলাপে বেরিয়ে আসে তার বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক। লেখক ও অনুষ্ঠান নির্মাতা পলাশ মাহবুবের সেই বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প জানাচ্ছেন- উজ্জ্বল এ গমেজ।
 
পলাশ মাহবুবের জন্ম বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। শৈশব এবং কৈশোরের স্বর্ণালী দিনগুলো কেটেছে চট্টগ্রামের সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেঁষে। বাবা-মা আর একমাত্র বোন। এই তাদের ছোট্ট পরিবার। বাবা ব্যবসায়ী। মা গৃহিনী। বোন এমবিএ শেষ করার পথে। 
 
শৈশবের স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে জানালেন, ছোটবেলায় প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুদের সাথে চলে যেতেন সমুদ্রের তীরে। সেখানেই চলত খেলাধুলা। তারপর সমুদ্রেই গোসল। ‘মানুষ পুকুরে গোসল করে আর আমাদের কাছে সমুদ্রই ছিল পুকুরের মতো।’ হাসতে হাসতে বলেন পলাশ মাহবুব। 
 
পলাশ মাহবুব এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন চট্টগ্রামেই। বরাবরই ছিলেন মেধাবীদের দলে। তবে কোনো কালেই খুব একটা মনযোগী ছিলেন না। ক্লাসের বাইরের বইয়ের প্রতিই সবসময় আগ্রহ বেশি ছিল। বাসার পরিবেশও ছিল তেমনই। পড়ার অভ্যাসটা পেয়েছেন বাবার কাছ থেকে। বাসায় বইপত্র আর পত্র-পত্রিকার অভাব ছিল না। অল্প বয়সেই তাই পড়া হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই।
‘স্বীকৃতি থেকেই প্রেরণার জন্ম’
পলাশ মাহবুবের কলেজজীবন কাটে খুলনায়। প্রথমে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেও এক বছর পর বিভাগ বদলান তিনি। কারণ ততদিনে মাথায় ঢুকে বসেছে লেখালেখির পোকা। বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন বিষয় লেখালেখির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একবছর পরে তাই তিনি বায়না ধরেন মানবিকে পড়বেন। বাবা-মায়ের মাথায় হাত- বলে কী! কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। 
 
অনেকটা জোর করেই একবছর পরে বিভাগ বদলে চলে গেলেন মানবিকে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে দুই বছরের পড়া এক বছরে শেষ করে সাফল্যের সঙ্গে পাস করেন এইচএসসি। পলাশ মাহবুব খুলনার যে কলেজে পড়াশোনা করেছেন সেই কলেজে এরকম আজব ঘটনা আগে-পরে আর ঘটেনি।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নিয়ে জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে তিনি ভর্তি হন। অন্য অনেক বিষয় নেয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি সাংবাদিকতা বিষয়কেই বেছে নেন। তখন স্বপ্ন দেখতেন সাংবাদিক হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর আগেই সাংবাদিকতা শুরু করেন পলাশ মাহবুব। তার প্রথম বইও যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি প্রথম বর্ষের ছাত্র।
 
শৈশবে কী স্বপ্ন দেখতেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে পলাশ বলেন, মানুষ যেমন বলে ছোটবেলা থেকে এটা হতে চেয়েছি, বড় হয়ে এটা হবো ওটা হবো। আমার বেলায় তেমনটা ছিল না। ছোটবেলা থেকে আমার তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট স্বপ্ন ছিল না। আমার স্বপ্নগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে, বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভিন্ন বাস্তবতায় বারবার প্রভাবিত হয়েছে।
‘স্বীকৃতি থেকেই প্রেরণার জন্ম’
পলাশ বলেন, আমাদের ছোটবেলায় ফুটবলার ম্যারাডোনা ছিল বিশাল ক্রেজ। ম্যারাডোনাও আমার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। তখন মনে হতো ম্যারাডোনার মতো ফুটবলারই হতে হবে। আবার ভালো একটা মুভি দেখলে মনে হতো যে কোনো মূল্যে চলচ্চিত্র পরিচালক হতে হবে। আবার একটি ভালো বই পড়লে বুঁদ হয়ে থাকতাম লেখক হওয়ার স্বপ্নে। যদিও ভালো লেখক হওয়ার স্বপ্ন আমি সবসময়-ই ধারণ করি।
 
লেখালেখির স্বীকৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পলাশ মাহবুব বলেন, অনেকে বলে থাকেন কাজের ক্ষেত্রে পুরস্কার কোনো  ব্যাপার নয়। তারা পুরস্কারের জন্য কাজও করেন না। আমি বলবো, আমি পুরস্কারের জন্যও কাজ করি। আমি চাই মানুষ আমার কাজের স্বীকৃতি দিক। কাজ করলাম এটা ভালো বা মন্দ হয়েছে পাঠকরা তার একটা মূল্যায়ন করুক। 
 
মন্দ হলে সেটাও বলুক। মন্দটাও একটা প্রতিক্রিয়া। কেউ কিছু না বললে এতসব লেখালেখি তো অর্থহীন। আমি মনে করি সব ব্যাপারে উৎসাহটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। উৎসাহ থেকে প্রেরণা তৈরি হয়। আমার লেখা নিয়ে কেউ যদি কোনো কথা নাই-ই বলে, মন্তব্য না করে তাহলে বুঝতে হবে আমার লেখা কেউ পড়ছে না। আমার লেখা মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে না। আমার লেখার উদ্দেশ্য হলো মানুষকে কিছু মেসেজ দেয়া, আনন্দ দেয়া আর কিছু তথ্য দেয়া। আমি এসব স্বীকৃতির জন্য লেখালেখি করি।
‘স্বীকৃতি থেকেই প্রেরণার জন্ম’
লেখালেখির শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, লেখালেখির শুরুটা চট্টগ্রাম হাইস্কুলে পড়ার সময়। স্কুল থেকে সাহিত্য সাময়িকী বের হবে। ক্লাস ক্যাপ্টেনের পদাধিকারের বলে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। সবার লেখা সংগ্রহ করছি। সবাই লেখা দিচ্ছে। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আমারও তো একটিা লেখা দেয়া দরকার। দিলাম একটা লেখা। লেখালেখির শুরুর কথা যদি বলতে হয় তাহলে এভাবেই আমার লেখালেখির শুরু। এরপর আস্তে আস্তে স্থানীয় কাগজ হয়ে দেশের মূল ধারার পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির সূত্রপাত।
 
আলাপ প্রসঙ্গে জানা গেল পলাশ মাহবুবের লেখালেখির ক্ষেত্র বেশ বড়। শুরুতে ছড়া লিখেছেন দাপটের সঙ্গে। এরপর গল্প, ছোট-বড় সবার জন্য। উপন্যাস লেখার শুরু তার কিছু পর থেকে। ‘টো টো কোম্পানি’তার জনপ্রিয় কিশোর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের সিরিজ। 
 
ইতোমধ্যে এই সিরিজের ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। টো টো কোম্পানি, টো টো কোম্পানি লিমিটেড, টো টো কোম্পানি আনলিমিটেড, টো টো কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, টো টো কোম্পানি পাবলিক লিমিটেড, টো টো কোম্পানি ও সার্কাসের ঘোড়া। 
 
এছাড়াও পলাশ মাহবুবের উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে আছে হঠাৎ খলিল, আবু ওসমানের নিজস্ব ভুল, মা করেছে বারণ, সুস্মিতার নিজস্ব সংবাদ, বলতে এলাম ভালোবাসি, আবু ইদরিস যখন লেখক হতে চাইলেন, আয়রে আমার ছেলেবেলা, ভালোবাসতে বাসতে ফতুর হওয়ার আগে, প্যান্ট ও পাজামার গল্প, উস্তম ফুস্তম, পিটি রতন সিটি খোকন, দুইদল দূরন্ত, আয়রে আমার ছেলেবেলা, প্রেমাণুকাব্য প্রভৃতি।
 
বর্তমানে দেশের জনপ্রিয় নাট্যকারদের মধ্যে পলাশ মাহবুব অন্যতম। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। 
 
নাটক লেখার বিষয়ে বলেন, আমি শুধু লেখার জন্য লিখি না। আমার নাটকে অবশ্যই কোনো  মেসেজ থাকবেই। এখন পর্যন্ত আমি যতগুলো নাটক লিখেছি কোনোটিই এর ব্যতিক্রম নয়। তার জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে আছে জর্দা জামাল, শিক্ষা সফর, সাধারণ জ্ঞান, বাল্যশিক্ষা,  একটি দৈনন্দিন প্রেমের গল্প, সাধারণ জ্ঞান, হঠাৎ খলিল, জোছনার অন্ধকারে, হাঁটাবাবা, হাঁটাবাবা রিটার্ন, পরীক্ষামূলক ভালোবাসা, আন্টি ম্যাডাম, তিনি একজন সৌভাগ্যবান ও পিটি রতন সিটি খোকন উল্লেখযোগ্য।
 
বর্তমানে টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে তৈরি হয়েছে তার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা। তার নির্মিত টিভি অনুষ্ঠানের সংখ্যা ১৫’শ  ছাড়িয়ে গেছে। মাঝে মাঝে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবেও দেখা যায় তাকে।
 
লেখালেখি ও অন্যান্য কাজের জন্য ইতোমধ্যে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কলকাতার সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার, অন্নদাশঙ্কর রায় সাহিত্য পুরস্কার, এসিআই-আনন্দ আলো শিশু সাহিত্য পুরস্কার, নাট্যসভা পদক। এছাড়া প্রতিশ্রুতিশীল লেখক হিসেবে ভারতীয় সরকারের আমন্ত্রণে ঘুরে এসেছেন সেই দেশ। দেখা করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে।
 
লেখালেখি ও সংস্কৃতি চর্চায় জীবনে পরিবেশগত প্রভাব বিষয়ে পলাশ মাহবুব বলেন, আমার জীবনে ত্রিমুখী পরিবেশের প্রভাব রয়েছে। শৈশবে উত্তাল সমুদ্রের তীরে বেড়ে উঠা। ওই পরিবেশ আমাকে ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতিচর্চার প্রতি অনেকটা প্রভাবিত করেছে। 
 
এরপর চলে আসি খুলনায়। চট্টগ্রাম ও খুলনা শিল্প নগরী। সংস্কৃতি চর্চায় এ দুটি জায়গা বেশ এগিয়ে। পরিবেশ, আবহাওয়া এগুলো মানুষের জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে। আমাকেও হয়তো প্রভাবিত করেছে। আর তৃতীয়টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমার জীবনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাও অনেক।
 
লেখালেখি ও অনুষ্ঠান নির্মাণ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে বলেন, আমি লিখতে চাই। লেখাতেই আমার সব আনন্দ। লেখাই আমার নেশা। আমার লেখা পড়ে মানুষ যদি একটুও আনন্দ পায় ও আলোকিত হয় সেটাই সার্থকতা। আর অনুষ্ঠান নির্মাণ নিয়ে পরিকল্পনা হলো নিজে স্ক্রিপ্ট লিখে ভালো মানের একটা ছবি বানাতে চাই। আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ মানের হবে চলচ্চিত্রটি। নিজের পরিচালনায় হবে ছবিটি। তাই সময় নিচ্ছি। নিজেকে প্রস্তুত করছি সেভাবেই।
 
বিবার্তা/উজ্জ্বল/কাফী
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com