শুরুটা জীবিকার, ভালোবাসার নয়

শুরুটা জীবিকার, ভালোবাসার নয়
প্রকাশ : ১৪ মে ২০১৬, ১১:১৮:১৯
শুরুটা জীবিকার, ভালোবাসার নয়
রুবাইয়াত আফরীন
প্রিন্ট অ-অ+
সাদাসিধে ছিপছিপে লম্বা গড়নের মানুষটাকে দেখলে বুঝার উপায় নেই, জীবনে এতোটা সংগ্রাম করে, পরিশ্রম করে এতোটা দূর এসেছেন। ‘আপনার এক্সিবিশন নিয়ে, আপনার জীবন নিয়ে কিছু জানতে চাই’ এ রকমটা শুনার পর সাদামাটা জবাব, ‘আসেন, বসে কথা বলি’। 
 
এটা এক রিক্সা পেইন্টারের গল্প, যে গল্প আর দশটা সাধারণ শিল্পীর জীবনের গল্প নয়। নাহ, ছোটবেলার ভালোবাসা থেকে ছবি আঁকা শুরু হয়নি তার। নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য, জীবিকার জন্য তার রিক্সা পেইন্টার হয়ে ওঠা। 
 
বিনয়ী শিল্পী নবকুমার ভদ্র, বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার শাখারী বাজার এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্য নিত্য সঙ্গী তার। পড়াশুনা করেছেন ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত। দারিদ্র্যের জ্বালাতনে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। পেটের দায়ে শুরু করেন সিনেমার ব্যানার আর পোস্টার আঁকার কাজ। তার নিপাট ভাষায়, ‘সংসারের প্রয়োজনে কারখানাতে কাজ করতে যাই। আস্তে আস্তে কাজ শিখি, বিভিন্ন অর্ডার আসতে থাকে। বাড়তি রোজগারের জন্য বাড়িতেও কাজ করা শুরু করি। ওই সময় আমার সংসার চলতো ওই টাকায়।’ 
শুরুটা জীবিকার, ভালোবাসার নয়
এই কাজ করে পরিবার চালানো কষ্টকর। পরে তিনি একজন রিক্সা পেইন্টারের সাথেই রিক্সা পেইন্টিং শুরু করেন, যাকে নবকুমার ‘ওস্তাদ’ মানেন। গল্পের ফাঁকে ওস্তাদের নাম বলতেও ভুললেন না। তিনি জীবনে একজনকেই ওস্তাদ বলে মানেন যার নাম সিতেস্বু।  
 
১৯৯৯ সাল, তখনো সিতেস্বুর সাথেই কাজ করে যাচ্ছিলেন শিল্পী নবকুমার ভদ্র। হঠাৎ করে তার বাসায় ফ্রান্সেস লানিয়ার নামের এক ভদ্রলোকের আগমন। পরে জানলেন, ফ্রান্সেস লানিয়ার আলিয়ান্স ফ্রঁসেস গ্যালারির ডিরেক্টর। লানিয়ার কিছু রিক্সা পেইন্টিং করে দিতে বললে নবকুমার রাজিও হয়ে যান। প্রত্যেক প্লেট এঁকে দিলেই ১০০ টাকা পেতেন নবকুমার। 
 
এক সময় লানিয়ার নবকুমারকে আলিয়ান্স ফ্রঁসেসের স্টাফ সার্ভিসে কাজ করার সুযোগ করে দিলেন। লানিয়ার ডিরেক্টর পদ থেকে অবসর নেবেন, এরকম সময় তিনি একটি রিক্সা পেইন্টিং এক্সিবিশনের আয়োজন করেন যেখানে নবকুমারসহ ৮৩জন রিক্সা পেইন্টার অংশ নেন। এরপর প্রায় ১০ বছর শিল্পী নবকুমার কোনো রিক্সা পেইন্টিং করেননি। এক সময় উপলব্ধি করেন তার রিক্সা পেইন্টিং আবার শুরু করা দরকার। তবে এবার শুধু জীবিকার জন্যেই নয়, নিজের জন্য, নিজের শান্তির জন্য শুরু করলেন রিক্সা পেইন্টিং। 
 
নিজের মত করে ধীরে ধীরে কিছু পেইন্টিং জমালেন, ঠিক করলেন এবার নিজের একটা সলো এক্সিবিশন করবেন। সালটা ২০১০, তখন আলিয়ান্স ফ্রঁসেসের ডিরেক্টর ছিলেন জ্যাক বুনু। বলাতে বুনু রাজি হয়ে যান। বুনু আলিয়ান্স ফ্রঁসেসের পক্ষ থেকে নবকুমারের এক্সিবিশনের সকল সহায়তা ও সহযোগিতা করেন। এমনকি এক্সিবিশনের ক্যাটালগ, ব্যানার থেকে শুরু করে সব ধরনের সাহায্য করেন।
 
এতেই ক্ষান্ত হননি নবকুমার। প্রথম সলো এক্সিবিশনের পর নিজের জমানো টাকা দিয়ে প্লেট কিনে আবার আঁকতে থাকলেন। ২০১৩ সালে আবারও আলিয়স ফ্রঁসেজের সহায়তায় তার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রায় আড়াই বছর ধরে কাজ করেছেন নিষ্ঠার সাথে। যার ফলশ্রুতিতে ২৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে ‘রঙে ভরা গ্রীষ্ম’ শিরোনামে নবকুমারের তৃতীয় একক প্রদর্শনী।এটি চলবে ১৪ মে পর্যন্ত। সব সময় রিক্সা পেইন্টিং আর সিনেমার ব্যানার করে অভ্যস্ত হলেও তিনি তার এক্সিবিশনে ১৭ টি স্কেচও রেখেছেন। এ ছাড়াও কিছু মিনিয়েচার বেবি টেক্সি, রিক্সা আর সরাও রেখেছেন তার এই প্রদর্শনীতে। 
শুরুটা জীবিকার, ভালোবাসার নয়
পরিশ্রমী এই শিল্পী তার ইচ্ছের কথা জানতে চাইলে জানান, ‘আগে আমি যাদের সাথে কাজ করতাম, যারা রিক্সা পেইন্টিংয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের সবাইকে একসাথে করার ইচ্ছা খুব।পারলে একসাথে একটা গ্রুপ এক্সিবিশন করতে চাই।’
 
রিক্সা পেইন্টিং এবং রিক্সা পেইন্টারদের নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘যখন আমি প্রথম রিক্সা পেইন্টিং করতাম তখন আমরা ছিলাম ৮৩ জন। কিন্তু এখন টিকে আছে হাতে গোনা ৭-৮ জন। রিক্সা পেইন্টিংয়ের কাজের মানের তুলনায় টাকা কম আসে। কষ্ট লাগে যখন দেখি সহকর্মীরা অল্প দামে পেইন্টিং করছে, অথবা করলেও দাম পাচ্ছে না।’
 
নবকুমার আরো জানান, তার এই নতুন করে কাজের মধ্যে ফিরে আসা শুধু নিজের জন্যে নয়, সহকর্মীদের ফিরিয়ে আনার জন্যে। 
 
কথায় কথায় উঠে আসে পরিবারের গল্প। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। বাবাকে মিস করেন। পরিবারে আছেন মা, স্ত্রী আর তিন মেয়ে। ভালোবাসার মানুষগুলো আর তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ আজ নবকুমার ভদ্রকে রিক্সা পেইন্টার নবকুমার ভদ্র হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। সারাক্ষণ হাসিমাখা মুখের পেছনের গল্পটা খুব স্বাচ্ছন্দে, সানন্দে শুনিয়েছেন বিবার্তাকে। আর বারবার তার মুখ থেকে ঝরেছে আলিয়স ফ্রঁসেজের জন্য হাজারো কৃতজ্ঞতা। এরকম একজন লড়াকু মানুষ আসলেই স্যালুট পাওয়ার যোগ্য।
 
বিবার্তা/রুবা/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com