একজন নভেরার গল্প

একজন নভেরার গল্প
প্রকাশ : ১৮ মে ২০১৬, ১৪:০৮:৩৫
একজন নভেরার গল্প
রুবাইয়াত আফরীন
প্রিন্ট অ-অ+
সামিউন জাহান দোলা, একজন নাট্যকর্মী। ঢাকা থিয়েটারে কাজ করেন। নিজেই ‘ধ্রুপদী অ্যাক্টিং অ্যান্ড ডিজাইন স্কুল’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালান। কিছুদিন আগে বেইলি রোডের মহিলা সমিতিতে মঞ্চস্থ হয়ে গেল ভাস্কর নভেরা আহমেদের জীবন নিয়ে নির্মিত তাঁর একক মঞ্চ নাটক ‘নভেরা’। শুধু মঞ্চে নয়, ব্যক্তিজীবনে দোলার নভেরা হয়ে ওঠার গল্পটা বিবার্তাকে শুনিয়েছেন নিপাট আড্ডায়। 
  
দোলার জন্ম চট্টগ্রামে। বাবার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। বাবা নেভিতে চাকরি করার সুবাদে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে দোলার শৈশব কৈশোর আর তারুণ্যের উচ্ছ্বল দিনগুলো কেটেছে চট্টগ্রাম, ঢাকা আর নেত্রকোনায়। মাধ্যমিক পাস করেছেন নেত্রকোনার সাবেরুন্নেসা গার্লস স্কুল থেকে। 
একজন নভেরার গল্প
ছোটবেলা থেকেই দোলার নাচ পছন্দ, আর অন্যরকম ভাল লাগা ছিল থিয়েটারের প্রতি। স্কুলে, এক্সট্রা কারিকুলামে নাচ থাকায় নাচটা তখনই শেখা হয়েছিল। এরপর ২৫ বছর নাচ করেছেন। পরিবারের বাধা সত্ত্বেও থিয়েটারও শুরু করেছিলেন নিজের উদ্যোগেই, যখন স্কুলে পড়তেন। কলেজে উঠার পর হোস্টেলেই থাকতেন। সন্ধ্যায় কলেজ হোস্টেলের গেইট বন্ধ হয়ে যেত, দেয়াল টপকে পার হয়েছেন অনেক দিন, থিয়েটার করার জন্যই।
 
কলেজ শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্বে ভর্তি হলেন। বিষয়টা বাবার বরাবরের মত পছন্দ হয়নি একদমই। বাসা থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন একটা সময়। নিজের খরচ নিজেই চালাতেন টিউশনি করে। ঢাকা থিয়েটারে যোগ দিলেন। রিহার্সেল করে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হতো। এরকম অনেকদিন রাতে খাবার পাননি দেরিতে ফেরার জন্য। এভাবেই চলতে থাকল থিয়েটারের জন্য, নিজের ভাল লাগার যুদ্ধ। 
    
পড়াশুনাও চলছে। এরই মাঝে ঘুরে এলেন মিসর। ২০০৮ সালে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার ফেস্টিভালে অংশ নেন। ২০১২ সালে লন্ডনে গ্লোবে থিয়েটারে শেক্সপিয়ারের ‘দ্য টেম্পেস্ট’ এর ট্রিনকুলো চরিত্রে অভিনয়ে করেছেন, নির্দেশনায় ছিলেন নাসিরুদ্দিন ইউসুফ। 
 
সামিউন জাহান দোলার একটা সময় স্কাল্পচার ভাল লাগতে শুরু করে। নভেরা আহমেদের স্কাল্পচারগুলো ভালোই লাগত। তিনি তার নিজের স্কুলের জন্য একটি নাটক তৈরি করবেন ভাবছিলেন। ঠিক সেই সময়ই নভেরা আহমেদ মারা গেলেন। দোলা ভাবলেন, ‘একটা বয়স পর্যন্ত আমি নিজেই নভেরা আহমেদকে চিনতাম না অথচ ইনিই হামিদুর রহমানের সাথে সম্মিলিতভাবে তৈরি করেছিলেন জাতীয় শহীদ মিনারের নকশা। কেন নভেরা আহমেদকে নিয়ে কাজ করছি না? নভেরা আহমেদকে নিয়ে কাজ করা যেতেই পারে। এর আগে মঞ্চে নভেরা আহমেদকে নিয়া কোনো কাজ হয়নি। 
 
পরে তিনি হাসনাত আবদুল হাইয়ের লিখা, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ‘নভেরা আহমেদ’, অন্যান্য প্রতিবেদন সব ঘেটে নিজেই বানালেন ‘নভেরা’র  স্ক্রিপ্ট। 
 
‘নভেরা’র প্রসঙ্গে আসতেই দোলা জানালেন, ‘নভেরা দূরের কেউ নন। আমাদের মতই একজন। উনি যে স্ট্রাগল করে গেছেন ১৯৬০ সালে, আমরা ২০১৬ তে এসেও সেই একই স্ট্র্রাগল করে যাচ্ছি। উনার থেকে অনুপপ্রেরণা পাই এই ব্যাপারটায়, দেশের বাইরে থেকেও তিনি দেশকেই তুলে ধরেছেন, তিনি  ভৌগোলিক দূরত্বে থেকেও বাংলাদেশেকে তাঁর শিল্পে এনেছেন প্রতিনিয়ত।’
 
‘নভেরা’ দোলার প্রতিষ্ঠান ধ্রুপদী অ্যাক্টিং অ্যান্ড ডিজাইন স্কুলের প্রথম প্রযোজনা। এই ‘নভেরা’ দোলার জন্য অনেক আনন্দের ছিল, আবার নভেরা করার সময় দোলা হারিয়ে ফেলেন তার ছোটবেলার এক বন্ধুকে, যে সব সময় দোলাকে উৎসাহ দিয়ে এসেছে, সেই শুরু থেকে। যার ‘নভেরা’ দেখার ইচ্ছা ছিল, যে ‘নভেরা’কে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। অন্যদিকে দারুণ দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে ‘নভেরা’। দোলার ইচ্ছে নভেরা আরো ১০০ বার মঞ্চস্থ হোক। 
     
‘নভেরা’ নাটকটি কতখানি চ্যালেঞ্জিং এরকম জিজ্ঞেস করলে দোলার সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘হ্যা চ্যালেঞ্জিং তো বটেই, এটা নভেরা আহমেদকে নিয়ে করা প্রথম মঞ্চ নাটক। নভেরা আহমেদের মতই বলি ‘চ্যালেঞ্জ ছাড়া জীবনে বেঁচে থাকার অর্থ হয় না, কঠিন কিছু করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও সান্ত্বনা থাকে, আর শিল্পের রাস্তায় সহজ বলে কিছু নেই।’ 
 
এ রকম অসংখ্য চ্যালেঞ্জ নিয়ে এতদূর আসা এই ‘নভেরা’র। অনেক বাধা এসেছে, সামাজিক, পারিবারিক অথবা অর্থনৈতিক। কিছুতেই থেমে থাকেননি এই অভিনেত্রী। বরাবরই নিজের ভালোলাগা, ভালোবাসার জায়গায় থেকেছেন অনড়, বিশ্বস্ত।
  একজন নভেরার গল্প
আড্ডার শেষ প্রান্তে এসে দোলা জানালেন তার ইচ্ছের কথা। তার ইচ্ছে: ‘বাংলাদেশের থিয়েটারকে প্রোফেশনাল জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। আর এই লড়াইটা আমাদের করতেই হবে। স্বীকৃতি কিংবা অস্বীকৃতিতে কিছু যায় আসে না।কাজটা জরুরি।’
 
সামিউন জাহান দোলা কাজ করেছেন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, শিমুল ইউসুফের মতন গুণি শিল্পীদের সাথে। তিনি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করেন প্রয়াত সেলিম আল দীনকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পেয়ে। এগুলো তার জীবনের অন্যতম বড় পাওয়া। 
 
দোলা অভিনয়ের পাশাপাশি একজন কোরিওগ্রাফারও। এক সময় বিবিসির কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতেন। তিনি ১০০টির উপরে টিভিসি, ৪টি সিরিয়াল, ৩টি সিনেমার কস্টিউম ডিজাইন করেছেন। ৩০টিরও বেশি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন। নাচ করাটা আর আগের মত করা হয়ে ওঠে না দোলার। তবে নৃত্য এখন তার অভিনয়েরই অংশ। 
 
বিবার্তা/রুবা/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com