নাহিদ সুলতানার স্বপ্ন

নাহিদ সুলতানার স্বপ্ন
প্রকাশ : ৩০ মে ২০১৬, ২২:১৫:৫৮
নাহিদ সুলতানার স্বপ্ন
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+
অন্যসব পরিবারের মতো নাহিদ সুলতানার পরিবারেরও ইচ্ছে ছিল মেয়েকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানোর। কিন্তু নাহিদের ইচ্ছে ছিল ভিন্ন। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে শিশুদের জন্য কিছু একটা করার। ফুটপাতে শিশুদের দেখলে ভীষণ কষ্ট হতো তার। তাই তার ইচ্ছে হতো এমন কিছু করার, যেখানে অনেক শিশু একসাথে খেলাধুলা করবে। কেউ কাঁদবে না। সবাই হাসবে, আনন্দ-ফূর্তি করবে। 
 
সময়ের পালাবদলে স্বপ্নের রঙও যায় বদলে। নাহিদের আবাল্যের সে ইচ্ছে পূরণ হয়নি। জীবনের পথপরিক্রমায় নাহিদ হয়ে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে কিছুদিন শিক্ষকতা করে তিনি এখন নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিসে সহকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করছেন।
 
শুক্রবার সকালে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় নাহিদ সুলতানা কথা বলেন বিবার্তা২৪.নেটের সাথে। দীর্ঘ আড্ডায় বেরিয়ে আসে তাঁর শৈশব থেকে স্বপ্ন পূরণ এবং জীবনের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা। কী সেই ঘটনা? সেই গল্প জানাচ্ছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।
নাহিদ সুলতানার স্বপ্ন
নাহিদ সুলতানার জন্ম চট্টগ্রামে। শৈশব, কৈশোর, বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ণ রিফাইনারি কলোনিতে। দুই ভাই ও দুই বোন। বোন হাইকোর্টের লইয়ার। এক ভাই নাট্য পরিচালক। ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন। আব্বা সুলতান আহমেদ স্ট্যান্ডার্ট চাটার্ট ব্যাংকে চাকরি করতেন। বর্তমানে অবসর নিয়ে চট্টগ্রামে একটা তেল কোম্পানিতে চাকরি করছেন। আম্মু নারগিস সুলতানা গৃহিনী।
 
ইস্টার্ণ রিফাইনারি কলোনি মডেল হাইস্কুলে নার্সারি থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
 
নাহিদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে ছোটবেলা থেকেই। এবিষয়ে তার ভাষ্য, আব্বুর রাত জেগে বই পড়া দেখে আমিও শুরু করি। এক সময় সেটাই নেশায় পরিণত হয়। ছোটবেলা আমি অনেক বই পড়েছি। কিন্তু স্কুলের পাঠ্য বই পড়েছি কম। বাড়িতে প্রচুর রাশিয়ান বই ছিল। সব বই পড়তে পাড়তাম না। ছোটদের জন্য যেগুলো ছিল যেমন-শিশু সাহিত্য, তিন গোয়েন্দা, লা নুই বেঙ্গলি এসব বই পড়তাম। 
 
বই পড়ার নেশাটা তার এমন ছিল যে রাতে একটা বইয়ের অর্ধেক পড়া বাকি আছে, সকালে সেটা নিয়ে বসে যেতেন পড়তে। কখন যে স্কুলের সময় হয়ে গেছে বুঝতেই পারতেন না। আম্মু ভাবতেন সে স্কুলে চলে গেছে। একদিন ঘটে এমন এক মজার ঘটনা। তার ক্লাসের বান্ধবী লোপা স্কুল থেকে দৌড়ে বাসায় এসে আম্মুকে বলে, আন্টি নাহিদ কই? আম্মু বলেন, ও তো স্কুলে গেছে। লোপা বলে, ও তো স্কুলে যায়নি। আম্মু তখন ঘরে খুঁজে দেখেন নাহিদ সোফার পেছনে বসে তিন গোয়েন্দা পড়ছে।
 
তারপরও স্কুলে এসএসসি পর্যন্ত ফার্স্ট গার্ল ছিলেন নাহিদ। তাই কলোনিতে সবার কাছে আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতাও ছিল তার। কলোনিতে যত প্রোগ্রাম হতো, সব জায়গাতেই সবার আগে থাকতেন। বাস্কেটবল, ভলিবল খেলা হবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে- সব কিছুর আয়োজক নাহিদ। 
নাহিদ সুলতানার স্বপ্ন
তার ভাষায়, আমার বয়সী মেয়েদের বাবা-মারা এগুলো করতে দিতে চাইতো না। কিন্তু আমি গেলে ওদের আসতে দিতো। এসব করেই দিন কাটতো। অনেক মজা করেছি সেই দিনগুলোতে। স্কুলের স্যাররাও জানতেন আমি ফাঁকিবাজ, আড্ডাবাজ, এক রাতের স্টুডেন্ট। কিন্তু সবাই এও জানতো যে পড়াশুনা করুক আর না-ই করুক, নাহিদ বোর্ডে স্ট্যান্ড করার ক্ষমতা রাখে। 
 
এসসিসিতে তার ৮টা সাবজেক্টে লেটারসহ ৮৫৩ মার্কস ছিল। ১৯৯৮ সালের জন্য এই রেজাল্ট ছিল অনেক কিছু। কিন্তু স্কুলের স্যাররা খুশি হননি।
 
এসএসসি পাস করে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন নাহিদ। শুরু হয় কলেজের রঙিন জীবন। এক ঝাঁক বান্ধবী ছিল। কলেজের বান্ধবীদের বিষয়ে বলেন, কেয়া, লুনা, তানিয়া, নুসরাৎ, সামিহা, নাদিরা সবাই মিলে একটা শক্তিশালী দল ছিল। বান্ধবীরা মিলে কলেজ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলায় যেতাম, আড্ডা দিতাম। 
 
কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, নাহিদের কলেজ পড়ার সময় লম্বা চুল ছিল। এর জন্য বান্ধবীরা তাকে ডেলা ডাকতো। তখন তিনি মজা করে বলতেন, তোমরা আমাকে ডেলা ডেকো না। আমার তো জিম নাই। আমার মার্কেট তো বন্ধ হয়ে যাবে। বান্ধবী নাদিরার বিষয় বলেন, ওর বয়কাট চুল ছিল। এর জন্য ওকে আমার খুব ভালো লাগতো।
 
একদিন আমি নাদিরাকে ডেকে বললাম, তুমি কি জান তুমি দেখতে অনেক সুন্দর। তখন নাদিরা বলল, আমাকে তুমি সুন্দর বলতাছ আমার ছোট আপাকে দেখলে কি বলবা? বাসায় আমার কোন নামই নাই। বুঝছো? আমার ছোট আপা এতো সুন্দর। আমি বলি, ও তাই? বান্ধবীমহলে নাহিদের এভাবেই কাটে কলেজের রঙিন দিনগুলো। সারাক্ষণ চলতো বিরামহীন দুষ্টুমিতে।
 
পড়ালেখা বিষয়ে তার সোজাসাপ্টা কথা হলো-এতো পড়ালেখা করবো কেন? ঘুরবো-ফিরবো, ফূর্তিফার্তা করবো, আড্ডা দিয়ে লাইফ এনজয় করবো। এভাবেই ফাঁকি দিতে দিতে ইন্টারমিডিয়েটের ফাইনাল পরীক্ষা চলে এলো। সাইন্সের পড়ালেখা অনেক। আমি তো কোনো সাবজেক্টই পড়িনি। মাথায় বাজ পড়লো। পরীক্ষা তো দিতে হবে। এক রাতে পড়াশুনা করে এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা খারাপ হলো। রেজাল্ট দেবে। টেনশন শুরু হলো। হয় ফেল না হয় দ্বিতীয় বিভাগ। শেষে দেখলাম প্রথম বিভাগে পাস করেছি।
নাহিদ সুলতানার স্বপ্ন
জীবনের ইচ্ছের বিষয়ে বলেন, ছোটবেলা থেকে আমার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছে ছিল না। একমাত্র স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার আর শিশুদের জন্য কিছু করার। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পরে আম্মু আমার জন্য মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য্ ফর্ম নিয়ে এলেন। আমিও ফর্ম পূরণ করে জমা দিলাম। ভর্তি পরীক্ষার দিন হলে ঢুকে প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে আর কোনো দেখাদেখি নেই। একটা প্রশ্নে চারটা করে গোল্লা ছিল। সঠিকটা পূরণ করতে হবে। আমি ২০ মিনিটের মধ্যে ৪০০শটা গোল্লা পূরণ করে সবার আগে জমা দিয়ে বের হয়ে গেছি। স্যাররা আমার কাণ্ড দেখে তো অবাক!
 
মেডিকেলে না পড়ার কারণ হিসেবে জানালেন, তার একজন ফুপু মেডিকেলে পড়তেন। একদিন তাদের বাসায় এসেছিলেন। সারাক্ষণ শুধু বই নিয়ে বসে থাকতেন। তাকে তিনি জিজ্ঞস করলেন, অ্যাই তুমি এত পড়ালেখা কর কেন? উত্তরে ফুপু বললেন, আমি শুধু পাস করার জন্য এতো পড়াশুনা করি। তখন তিনি বললেন, শুধু পাস করার জন্য যদি দিনে ২৩ ঘণ্টা পড়ালেখা কর তাহলে জীবনে আর থাকবে কী!
 
অবশেষে তার ইচ্ছেরই জয় হয়। তিনি ঢাবিতে ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন রিসার্চ (আইইআর) বিভাগে ভর্তি হন। ওঠেন বেগম রোকেয়া হলে। বিভাগে ১২০ জন ছেলেমেয়ে ছিল। ইনকোর্স পরীক্ষায় সবার চেয়ে বেশি নম্বর পান নাহিদ। এমন রেজাল্টে সবাই আবাক। বিশেষ করে তার রুমমেটরা। কারণ তিনি তো সন্ধ্যা সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বাইরে আড্ডা দিতেন।
 
অনার্সের তৃতীয় বর্ষে এসে পারিবারিকভাবে এক প্রবাসী ব্যাংকারের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তারপরেও পড়াশুনা চলতে থাকে। অনার্সে প্রথম বিভাগে পাস করেন। মাস্টার্সেও প্রথম বিভাগ। মাস্টার্সে থিসিসের বিষয় ছিল-‘কাজী মোতাহার হোসেনের শিক্ষা-চিন্তার স্বরূপ বিশ্লেষণ’।
 
এখানে তিনি তুলে ধরেন, কাজী মোতাহার হোসেন শিক্ষা নিয়ে যেসব চিন্তা-ভাবনা করেছেন, তার লেখার দর্শন, শিক্ষার থিওরি এবং এগুলোর সাথে বর্তমান শিক্ষার নতুন নতুন থিওরির কী সম্পর্ক রয়েছে। এরপরে কাজী মোতাহার হোসেন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে থিসিসটা একটা বই আকারে প্রকাশ করা হয়। বইটি সিনেট ভবনে উদ্বোধন করেন ঢাবি ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
নাহিদ সুলতানার স্বপ্ন
মাস্টার্স পাস করার পর হঠাৎ ঘোষণা হলো ঢাবির আইইআরে পার্টটাইম টিচার লাগবে। ভালো ছাত্রী হওয়ার সুবাদে নাহিদ লেকচারার হিসেবে চান্স পেয়ে যান। চার বছর চাকরিটা করেন। এরই মধ্যে স্বামীর আগ্রহ ও পীড়াপীড়িতে বিসিএস দেন। এবিষয়ে তার আগ্রহ বা ইচ্ছে কোনোটাই ছিল না। সংসার সামলে আবার পড়াশুনা। এসবের মধ্যেই বিসিএস দিয়ে হয়ে যান বিসিএস ক্যাডার। এরপরে বিসিএস ক্যাডারদের তিন মাসের একটা ট্রেনিং হয়, সেখানেও তিনি মেধাতালিকায় প্রথম হন।
 
২০১২ সালের ৩ জুন অ্যাডমিন ক্যাডারে প্রথম পোস্টিং ছিল মুন্সিগঞ্জ। তারপরে দুটি ট্রেনিংয়ে প্রথম হওয়ার কারণে অ্যাডমিন একাডেমিতে অ্যাটাচমেন্ট ছিলেন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ ডিসি অফিসে সহকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আছেন।
 
এতো কিছুর পরও শৈশবের স্বপ্ন ভুলে যাননি নাহিদ। বললেন, চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর সব বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা শিশুসদন বানাতে চাই। শিশুদের জন্য লেখারও ইচ্ছে আছে। তিনি বলেন, দেশে শিশুদের লেখালেখি হচ্ছে, তবে তা নিতান্তই কম। তাই লেখালেখির মাধ্যমেও শিশুদের জন্য কিছু করতে চাই।
 
বিবার্তা/উজ্জ্বল/কাফী
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com