অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। অতীতে ঘোষিত যেকোনো বেতন স্কেলের চেয়ে বৃদ্ধির শতকরা হার বেশি। যা নজিরবিহীন। আর বেতন বৃদ্ধি সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সময়ের দাবি ও ছিল বৈকি? ফলে স্বভাবতই সর্বস্তরের সরকারি চাকরিজীবীদের খুশী হওয়ার কথা।
কিন্তু দিন দিন এই বেতন স্কেল নিয়ে মানুষের ক্ষোভ, হতাশা বাড়ছেই। পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিসিএস এর ২৬ ক্যাডার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নন ক্যাডারসহ অন্যান্য সরকারি চাকরি জীবীরা আন্দোলন করছেন।
আমার প্রশ্ন কেন এই আন্দোলন? দ্বিগুণ বৃদ্ধি কি কম হয়েছে? কখনই নয়। কারো আন্দোলনের ইস্যু তাদের অবনমন করা হয়েছে, কারো সাথে বৈষম্য করা হয়েছে, কারো ক্ষমতা হরণ করা হয়েছে, আবার কারো বা মর্যাদাহানি করা হয়েছে।
যে বৈষম্যের জন্য বাঙালী জাতি পাকিস্তানী হায়েনাদের সামনে জীবন দিয়ে, তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে, মা-বোন ইজ্জত সম্ভ্রম দিয়ে এই দেশ স্বধীন করলেন। আজ ২০১৫ সালে কেন সেই বৈষম্য হবে? আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধারা কি এই বৈষম্য চান? নিশ্চয় চান না।
প্রথমেই আসা যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে। নতুন এই বেতন স্কেলে দেখা যায় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে যারা প্রফেসর হতেন তাদের ২৫% সিলেকশন গ্রেড যেয়ে ১ম স্তরের বেতন পেতেন। যা অষ্টম জাতীয় স্কেল থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বভাবতই ক্ষতিগ্রস্থ হন। তার ওপর তৈরি করা হয়েছে সুপার গ্রেড। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রায় পাঁচ ধাপ নিচে অবস্থান।
নতুন স্কেলে কারো কারো প্রমোশন হলে শিক্ষকদের কেন অবনমন করা হবে? পূর্বে বহাল থাকা সুযোগ সুবিধা কেন কেড়ে নেওয়া হবে? বলা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানে পাঠদান না করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। আমার প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কতজন এ কাজ করেন? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতাদের ভাষ্যমতে, মোট শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ৪% শিক্ষক এই কাজ করেন। তাহলে এই যুক্তি দিয়ে কি বাকী ৯৬% শিক্ষকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া বিবেক সম্মত? বরং উচিত, যে ৪% শিক্ষক প্রাইভেটে ক্লাস নেন তাদের প্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান ঠিক রাখা।
বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৯টা থেকে ৫টা অফিস করেন না। ৯টা থেকে ৫টা অফিস করাই কি মুখ্য? না কি মান সম্মত পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা কাজ চালানো মুখ্য? তাই যদি হয় তাহলে এগুলোই নিশ্চিত করা হোক। ৯টা থেকে ৫টা অফিস করা কখনোই যুক্তিযুক্ত নয়। শিক্ষকরা রাত জেগে খাতা দেখা, প্রশ্ন করাসহ আরো অনেক কাজ করে থাকেন।
এবার আসা যাক বয়সের ক্ষেত্রে, বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছর চাকুরি করেন অন্যরা করেন ৫৯ বছর। আমার কথা হলো কে কত বছর পর্যন্ত দেশ ও জাতির সেবায় নিয়োজিত থাকবেন তা নির্ভর করবে কাজের ধরনের ওপর। নিশ্চই সকল কাজের ধরণ এক নয়।
অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৬টি ক্যাডারে কর্মরত চাকরিজীবীর সংখ্যা ৫৫ হাজার৩০৮ জন। ক্যাডার বর্হিভূত প্রবেশ পথে নবম গ্রেডে চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারসহ ৯ম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব চাকরিজীবীর সংখ্যা লক্ষাধিক। এদের মধ্যে সচিবসহ গ্রেড এক ভূক্ত চাকরিজীবীর সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ১২২ জন।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের সংখ্যা ১১ হাজার ৪১১ জন। তার মধ্যে গ্রেড-১ ভূক্ত অধ্যাপকের সংখ্যা ৮২০ জন।
কি অসাধারণ যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে? রাতে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির ভাষা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা একটি বিশেষ মহলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করা যৌক্তিক? আর সংখ্যা নিয়ে যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে তাই বা কতটুকু যৌক্তিক? আপনারা কি কোন মন্ত্রণালয়ে কতজন সেই শতকরা হার অনুযায়ী পদ পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছেন? না কি যোগ্যতার মানদণ্ডে?
আপনারা কি দেখেছেন চারটা ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে কতজন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন ? শুধু ফার্স্ট ক্লাসই বলছি কেন ? ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট, সেকেণ্ড বা পজিশন ধারী কতজন আছেন? নিশ্চই দেখেননি। আর সচিবদের কতজন থার্ড ক্লাস নিয়ে সরকারি চাকরি করছেন বা সচিব হয়েছেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদান করা আর বি সি এস ক্যাডার হিসেবে যোগদান করার মানদণ্ড কি এক? (সরি, কারো আঘাত করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়, যুক্তি বা সমসাময়িকতার জন্য শুধু )।
আপনারা কি দেখেছেন? উপমহাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কত বেতন পান? উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ শিক্ষাখাতে কত বরাদ্দ দেয়? আর বাংলাদেশে কত? স্বাধীনতার পর থেকে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কিভাবে কমছে? সরকারি কর্মকতারা গাড়ী, বাড়ীর জন্য যে ব্যাংক ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা পান, শিক্ষকরা কি তা পান? গবেষণা খাতে কত টাকা বরাদ্দ দেন? উচ্চ শিক্ষার বৃত্তির জন্য কত টাকা দেন?
ধরে নিলাম আপনারা কম বেতন পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অনেক বেশি বেতন পান। অনেক আয় করেন। তারপরও একজন সচিবের গাড়ী-বাড়ী, সম্পদ বেশি নাকি, শিক্ষকের বেশি? এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চই জাতি জানে। আর আপনারা তো সুদ ঘুষ খানই না। একজন সাধারণ মানুষ সরকারি অফিসে গেলেই তার প্রমাণ পায়। যদিও সব জায়গায় সৎ, যোগ্য নিষ্ঠাবান ও দেশ প্রেমিক কিছু মানুষ আছে। প্রশাসনেও আছে।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না, পরীক্ষা গ্রহণ করেন না, তাদের বিরুদ্ধেও আইনী ব্যবস্থা নেওয়া হোক। শিক্ষার মান বাড়ানো হোক। অচিরেই শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবির সম্মানজনক সমাধান হোক। আমরা চাই না শিক্ষকরা অনিদিষ্ট কালের কর্মবিরতিতে যাক। ছাত্রদের পাঠদান ব্যহত হোক, তারা আবার সেশন জটে পড়ুক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া বিসিএস’র অন্যান্য ২৬ ক্যাডারের সাথে যে বৈষম্য করা হয়েছে তার অবসান ঘটানো হোক, নন ক্যাডারদের চাকরিতে যোগদানের যে গ্রেড অবনমন করা হয়েছে তার যৌক্তিক সমাধান হোক। উপজেলায় প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের ওপর ইউএনও’র একনায়কত্ব বাতিল করা হোক। চিকিৎসক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের যথোপযুক্ত মর্যাদা ও বেতন প্রদান করা হোক।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী জাতি যে চেতনায় উজ্জীবীত হয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সেই চেতনার বাস্তবায়ন হোক। দূরিভূত হোক সকল বৈষম্য। একতাবদ্ধ হয়ে এই দেশকে সুখী সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি, এই হোক আমাদের সকলের ব্রত।
লেখক : প্রভাষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/এমহোসেন