সুন্দরবন নিয়ে আমাদের দেশে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে যা পড়লে মনে হয়, সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই হবে বিপন্ন। কিন্তু ইতিহাসের নিরীখে এই ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় না।
এখন যেখানে সুন্দরবন, তার মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে দালান-কোঠার ভগ্নাবশেষ। পাওয়া গিয়েছে পুষ্করিণীর নিদর্শন, যার ঘাট ছিল সিঁড়ি বাঁধা। এরকম পুষ্করিণী কেবল বড় লোকালয়েই থাকতে দেখা যায়।
সুন্দরবনের মাটি খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছে খাড়া হয়ে থাকা গাছের গুঁড়ির সারি, যা থেকে অনুমান করা চলে, আজ যেখানে সুন্দরবন, সেখানে এক সময় জনবসতি ছিল। কোনো কারণে হঠাৎ এর একটি অংশ মাটিতে দেবে যায়।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী সিদ্ধান্ত করেছেন যে, খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে সমস্ত সুন্দরবন এলাকার মাটি ধসে যায়। আর তাই ওখানকার জনপদ হয়ে যায় নিশ্চিহ্ন। পরে গড়ে ওঠে বনভূমি।
অন্য দিকে মেজর জেমস রেনল, যিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি জরিপ করে তার প্রথম মানচিত্র অঙ্কন করেন, তিনি বলেছেন যে, বয়স্ক লোকের কাছ থেকে শুনে তিনি জানতে পেরেছেন এখন যেখানে সুন্দরবন, সেখানে এক সময় ছিল জনবসতি। কিন্তু মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচারে ওই অঞ্চল জনবসতিশূন্য হয়ে যায়। গড়ে ওঠে সুন্দরবন।
অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই হতে থাকে সুন্দরবনের উদ্ভব। এর আগে সুন্দরবন বলে কোনো বন ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশবাদীরা এখন বোঝাতে চাচ্ছেন যে, সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই হয়ে উঠবে বিপন্ন।
সুন্দরবন জনশূন্য হয়েছিল কেন, এ সম্পর্কে সংক্ষেপে খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন কপিল ভট্টাচার্য তার লেখা বাংলা দেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা নামক বইতে (১৯৫১)। কপিল ভট্টাচার্যকে বাংলাদেশের নদনদী সম্পর্কে একজন খুবই জ্ঞাত ব্যক্তি বলে ধরা হতো। সুন্দরবন সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তাকেও মনে করা যায় যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বলে।
আমাদের দেশে পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনের আলোচনায় সুন্দরবন সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না।
সুন্দরবনের সবটুকুই ম্যানগ্রোভ নয়। উত্তর ভাগের বনকে বলতে হয় প্রধানত মিঠাপানির বন। কেবল দক্ষিণ দিকের বনকেই বলতে হয় উদ্ভিদবিদ্যার দিক থেকে ম্যানগ্রোভ, যার প্রধান গাছ হলো গরান। গরান ঝোপজাতীয় গাছ। উদ্ভিদবিদ্যায় ঝোপজতীয় গাছ বলতে বোঝায় যা ১৭ থেকে ১৮ ফিট উঁচু হয় এবং যার মূল কাণ্ড খুব মোটা হয় না। মূল কাণ্ড থেকে শাখা নির্গত হয় মাটির খুব কাছ থেকে। এই গাছ ঝড় আটকাতে পারে না। ঝড়ের ধাক্কায় মাটির ওপর নুয়ে পড়তে চায়।
বলা হয়, সুন্দরবনের নাম এসেছে ‘সুঁদরী’ গাছ থেকে। ‘সুঁদরী’ গাছকে বলতে হয় মাঝারি ধরনের বৃক্ষ। উচ্চতায় হয় ২০-৩০ ফিটের কাছাকাছি। সুঁদরী গাছ প্রধানত হয় সুন্দরবনের মধ্য অঞ্চলে, যেখানে মাটি নোনা হলেও খুব নোনা নয়।
সুন্দরবনের সবচেয়ে উঁচু বৃক্ষ হলো কেওড়া। কেওড়া গাছ হতে দেখা যায় নদীর ধারে। কেওড়া গাছ সাধারণত উচ্চতায় ৪০ ফিটের কাছাকাছি হয়ে থাকে।
সুন্দরবন উঁচু গাছের বন নয়। সুন্দরবনের গাছের কাণ্ড যথেষ্ট মোটা হয় না। এ হলো সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবনে গাছ আছে অনেক। কিন্তু গাছের রকমারি কম। তাই সুন্দরবন দেখে মনে হয় তুলনামূলকভাবে একঘেঁয়ে। এর দৃশ্য মনোরম নয়।
সুন্দরবনের যে অঞ্চলে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় প্রবল জোয়ার হয়, সেখানে এখনও কোনো স্থায়ী জনবসতি গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সুন্দরবনের উত্তরভাগে গড়ে উঠেছে যথেষ্ট জনপদ। এই অঞ্চলে ব্রিটিশ শাসনামলে জমি পত্তনি দেয়া শুরু ১৮৫৫ সাল থেকে।
সুন্দরবনে বাস করে নরখাদক বাঘ ও কুমির। বাস করে বহুবিধ বিষধর সাপ। এদের বাঁচিয়ে রাখার কথা বলা হচ্ছে ইউনেস্কো থেকে। কিন্তু মানুষের শত্রু প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখলে তা হতে পারে বাংলাদেশের জনসমাজের জন্য যথেষ্ট ক্ষতির কারণ। ইউনেস্কো তখন আসবে না আমাদের বাঁচাতে।
সুন্দরবনকে ইউনেস্কোর তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে। কিন্তু সুন্দরবন বাংলাদেশে অবস্থিত। বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। সুন্দরবনে জীবজন্তু কিভাবে সুরক্ষিত করা হবে সেটা শুধু ঠিক করতে পারে বাংলাদেশ সরকার; ইউনেস্কো নয়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সুন্দরবনের যে অংশ পড়েছে তাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে গণ্য করেছে কি না সেটা আমাদের পরিষ্কারভাবে জানা নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন নিয়ে বাংলাদেশের মতো কোনো মাতামাতি করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সুন্দরবন নিয়ে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেন, সেটা আমাদের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়।
ব্যবসাবাণিজ্য করতে হলে দক্ষিণবঙ্গে সমুদ্রবন্দর গড়তেই হবে। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে যাওয়া-আসা করতে দিতে হবে সমুদ্রগামী জাহাজ, তা যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। দেশের অর্থনীতির স্বার্থেই করতে হবে সমুদ্রবন্দর।
অন্যদিকে ভারতে অনেক পাহাড়ি নদী আছে, যার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। আর ভারত সেটা করছেও। বাংলাদেশের এই সুযোগ নেই। বাংলাদেশকে কয়লা ও পেট্রোলিয়ামজাতীয় দ্রব্য পুড়িয়েই উৎপাদন করতে হবে বিদ্যুৎ। আর সমুদ্রের ধারে বিদ্যুৎকেন্দ্র করলে বিদেশ থেকে পাথুরে কয়লা ও পেট্রোলিয়ামজাতীয় জ্বালানি এনে তা পুড়িয়ে ডায়নামো চালানো হবে অনেক সুলভ। ভারতে কিন্তু কাপড়ের কল, সুতাকল, লোহা ইস্পাত তৈরির কারখানা চলেছে পাথুরে কয়লা পুড়িয়ে। কিন্তু ভারতের পরিবেশবাদীরা বলছেন না, এসব কলকারখানা চালানো বন্ধ করতে হবে।
আমাদের পরিবেশবাদীরা যা বলছেন, তা মানলে আমাদের দেশের অর্থনীতি পড়ে থাকবে কুটিরশিল্পেরই যুগে। এমনকি পাওয়ার টিলার দিয়ে করা চলবে না জমি চাষ। চড়তে হবে গরুর গাড়িতে। বন্ধ করতে হবে বাস ও রেলগাড়ি।
আমাদের দেশে প্রায় সাত মাস আকাশ থাকে মেঘে ঢাকা। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন এখানে কাজে এলেও তাকে নির্ভর করে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মনে হয় না। এখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করতেও উৎপাদন খরচ পড়বে অনেক বেশি। কেননা ইউরেনিয়াম ও হেভি ওয়াটার বিদেশের কাছ থেকে কিনতে হবে চড়া দামে। এ ছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটতে পারে মারাত্মক বিস্ফোরণ, যেমন ঘটেছিল ইউক্রেনের চেরনোবিল নামক স্থানে। এই বিস্ফোরণ ঘটেছিল ওই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কারখানার কর্মচারীদের অবহেলার কারণে। অনুরূপ অবহেলা ঘটা এ দেশেও যথেষ্ট সম্ভব। সব মিলিয়ে বলতে হয়, আমাদের জন্য পাথুরে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলো অনেক সহজ ও নিরাপদ। (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক। অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী