মানুষের কী ভোগান্তি যাচ্ছে বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোতে, কী দুঃসহ জীবন-যাপন করছে বন্যার্তরা তা জানে কেবল ভুক্তভোগীরাই। এ নিয়ে ব্যস্ততা বা পদক্ষেপ খুব মৃদু, দুর্বল।
আমরা ব্যস্ত জঙ্গিবাদ, জাতীয় ঐক্য, ছাত্রদের আন্দোলন আরো কিছু বিষয় নিয়ে। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দল-মতের প্রাচীর ভেঙে নেমে পড়া, দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর সৌন্দর্য এবার দেখা যাচ্ছে না। মানবতার এ অনুপস্থিতি অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
এ ধরণের দুর্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য নির্দেশ-আহবানের প্রয়োজন না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী দলের এমপি ও নেতাকর্মীদের প্রতি দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আহবানেও এখন পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের সাড়ার মাত্রা উল্লেখযোগ্য নয়।
যতদূর জানি, বন্যায় নিজেদের এলাকার দুরবস্থা অনেকে দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করছেন। কেউ কেউ বন্যাকবলিত এলাকায় এক ঝলক গেলেও ব্যক্তিগত কাজ সেরে ফিরে আসছেন রাজধানীতে। ঢাকায় চলছে তাদের আয়েশি জীবন। বিদেশ সফরেও গেছেন বা যাচ্ছেন কেউ কেউ।
উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাটে পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষের দুর্গতি ওই এলাকার জনপ্রতিনিধি, নেতা কারোই মন গলাতে পারছে না। ঢাকা বিভাগের মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরের চিত্রও এমনই।
বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য, খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। চলছে ওষুধপত্রের অভাব। চাহিদার তুলনায় ত্রাণ-সাহায্য একেবারেই কম। অনেকেরই রান্না করার মতো অবস্থা নেই। সাহায্য হিসেবে চাল-ডাল দিলেও তা তারা খেতে পারবেন না। পাশাপাশি পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ ছড়াতে শুরু করেছে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের সাথে ব্রিজও ধসে গেছে বিভিন্ন এলাকায়। আর ধান-সব্জিসহ ফসলহানির যোগফল এখনো বাকিই রয়ে গেছে।
এবার এ নিয়ে তেমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা তৎপরতা নেই রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, সামাজিক অবস্থাসম্পন্নদের মধ্যে। অথচ পরিস্থিতি কিন্তু সত্যিই ভয়াবহ। উত্তরাঞ্চলে কোথাও কোথাও পানি কিছুটা কমলেও নতুন করে বেড়েছে নদীভাঙন, অসুখ-বিসুখসহ নানা দুর্ভোগ। মধ্যাঞ্চলে নতুন করে তলিয়ে গেছে বহু এলাকা। সারা দেশে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখের কাছাকাছি। পানিতে ডুবে মৃতের সংখ্যাও এখন পর্যন্ত ২৪/২৫ এর মতো।
দুর্গত এলাকার হাজারো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ। শোনা যাচ্ছে, নতুন করে পানির তোড় দেখা দিতে পারে। কারণ উজানে, অর্থাৎ আসাম ও সংলগ্ন এলাকায় বন্যা এখনো তীব্র। এই পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যাবে। অস্বাভাবিক জোয়ার থাকায় বর্তমানের পানি নামতে দেরি হতে পারে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলেও বন্যা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
একসময় আশপাশের মানুষের দুর্ভোগ বা কষ্টে যেভাবে সহমর্মিতা প্রকাশ পেত, ইদানিং তা অনেকটা কমে গেছে। এমনকি পাশের বাড়ির কারো মৃত্যুতেও কান্নাকাটি, দোয়া খায়ের - যা কিছু করার, মরহুমের একান্তজনরাই করেন।
বিভিন্ন কারণে ও ক্রিয়া, বিক্রিয়া, প্রতিক্রিয়ায় আজ সমাজ এ দশায় দাঁড়িয়েছে। মনের অর্গলটাকে কেমন যেন রুদ্ধতায় পেয়ে বসেছে। মনের অর্গল বন্ধ থাকলে মায়া-দয়া, যুক্তি প্রবেশ করবে কোন পথ দিয়ে?
অথচ বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি তো এমন ছিল না। পবিত্র ধর্ম ইসলামেও রয়েছে সহমর্মিতার অনেক শিক্ষণীয় নজির, যার কিছু কিছু এক সময় আমাদের পাঠ্যবইগুলোতেও রাখা হতো। সমাজ ও বাস্তবতা বদলের তোড়ে সেগুলোকে আজ কারো কারো কাছে আহম্মকি মনে হতে পারে। সংক্ষেপে এখানে অবতারণা করতে চাই ইয়ারমুকের যুদ্ধ ময়দানের সহমর্মীতার ঘটনা। যুদ্ধে উভয়পক্ষেই অনেক হতাহত। মুসলিম শিবিরে একজন গাজী যোদ্ধা মারাত্মক আহত। একজন স্বেচ্ছাসেবী তার মুখের সামনে একপাত্র পানি ধরলেন। আহত সৈনিক ইশারায় একটু দূরের আরেকজন গুরুতর আহত যোদ্ধাকে দেখিয়ে পানিটুকু নিজে না খেয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। স্বেচ্ছাসেবী সৈনিককে দেখিয়ে তাকে আগে পানি দিতে বললেন। অগত্যা স্বেচ্ছাসেবী প্রত্যাবর্তন করে দেখলেন, প্রথম সৈনিক তৃষ্ণার ঊর্ধ্বে উঠে পরজগতে চলে গেছেন। স্বেচ্ছাসেবী দৌড়ে গেলেন দ্বিতীয় জনের কাছে। ততক্ষণে তিনিও প্রথম সৈনিককে অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ শহিদী অমৃত সুধার সন্ধানে জীবনের মায়া ত্যাগ করেছেন। কঠিন যুদ্ধে দুজনে গুরুতর আহত ও মৃত্যুপথযাত্রী। কিন্তু একজন অন্যজনকে রেখে আগে পানি পান করলেন না।
সহমর্মিতার অপার প্রশান্তির সেই সুখবোধ আজকের বাস্তবতায় আহাম্মকি মনে হতে পারে। আধুনিক বস্তুবাদী মানুষ হয়তো ওই উভয় সৈনিককেই বোকা আখ্যায়িত করবেন। কারণ অপরের শুভ কামনায় স্বীয় সুখ বা নগণ্য স্বার্থ ত্যাগের মধ্যে যে অপার আনন্দের ফোয়ারা রয়েছে, তার স্বাদ আস্বাদনে অক্ষম আমরা।
বিজ্ঞানের সূত্রমতে আমাদের প্রতিটি কর্মের (অ্যাকশন) বিপরীতে একই রকম পাল্টাকর্ম (রিঅ্যাকশন) জন্ম নেয়। হয়তো আমরা এবং আমাদের সমাজ আজ সেই রিঅ্যাকশনেরই শিকার। প্রতিয়িত আমরা হানাহানি, জেদাজেদির যে চর্চা করে আসছি, একটি অপকর্মকে আরেকটি অপকর্ম দিয়ে ঢাকছি, এর পরিণাম ঠেকাবে কে? যদি নিজের ছোটখাটো স্বার্থকে গৌণ ভেবে অন্যজনের সাহায্যে এগিয়ে যাই, তবেই ওই ব্যক্তিও আমার বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারে। নিদেনপক্ষে সহানুভূতি জানাবে, দোয়া করবে।
এই প্রাপ্তিও আমার একটা স্বার্থ। অন্যের জন্য স্বার্থ ত্যাগ করলে, সেও আমার স্বার্থে এগিয়ে আসবে। স্বাভাবিক এ ক্রিয়া-কর্ম থেকে আমরা আজ বহু দূরে। পারস্পরিক কল্যাণবোধের স্বার্থে সামান্য ত্যাগ শুধু সম্প্রীতিই জন্ম দেয় না, সেই সাথে পারস্পরিক স্বার্থও অক্ষুন্ন রাখে।
সহমর্মিতা কোনো ভাবালুতা নয়, বরং মানবজাতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ একটি যৌক্তিক আবেগ, যার মূলে রয়েছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তা ক্ষয়ে গেলে সমাজ জীর্ণ হয়ে পড়ে। সবার জীবনই সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। এটা সৃষ্টির নিয়ম। বিজ্ঞানেরও সূত্র। বিশ্বের কেউ আজ পর্যন্ত এ সূত্র ও নিয়মের বাইরে যেতে পারেনি,পারবেও না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন