১৯৯৫ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীতে আয়োজিত ‘একুশ আমার পরিচয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগ হয় আমার। একুশের ওই অনুষ্ঠানে কবি-লেখকদের মধ্যে দুই মহাপ্রাণ মনীষী শ্রী অন্নদাশঙ্কর রায় ও শ্রী রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে এক মঞ্চে বসে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
সেদিন আলোচকদের মধ্যে আরো ছিলেন কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অধ্যাপক অমলেন্দু দে, গীতা মুখার্জী এমপি, তৎকালীন কলকাতার মেয়র প্রশান্ত চট্রোপাধ্যায় প্রমুখ।
প্রায় সব বক্তার কথার মধ্যে ‘এপার বাংলা-ওপার বাংলা’ শুনতে শুনতে আমার ভেতরে কেমন যেন অসম্মানের ক্ষোভ জমতে থাকে। বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমি মৃদু প্রতিবাদের সুরে উপস্থিত বিদ্বজনের সামনে সবাইকে সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিই যে, সুদীর্ঘ সংগ্রাম আর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বহু রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সর্বভৌম দেশ। আর পশ্চিমবঙ্গ বা তাদের ভাষায় ‘এপার বাংলা’ ভারতের একটি রাজ্য বা প্রদেশ মাত্র। আমার কথায় রণেশ দা ও সুনীলদা খুব খুশি হয়েছিলেন।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা ব্যানার্র্জি পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ করে বিধানসভায় প্রস্তাব পাস করিয়েছেন। এখন রাজ্যসভায় প্রস্তাবটি অনুমোদিত হলেই পশ্চিমবঙ্গের নাম হবে ‘বাংলা’। পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে কলকাতার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা মমতা ব্যানার্র্জির সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান রচনা, ভারত বিভাগ বা বঙ্গদেশের কালানুক্রমিক নাম পবির্তনের ধারাবাহিকতা নিয়ে বিস্তর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা আমরা করতে পারি। কিন্তু, আমার এই ক্ষুদ্র লেখাটির লক্ষ্য তা নয়। আমার লক্ষ্য, জেল-জুলুম-নিযার্তন সহ্য করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের আপোসহীন সংগ্রাম, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা; মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লক্ষ শহীদের পবিত্র রক্ত আর প্রায় পাঁচ লক্ষ মা-বোনের পাপস্পর্শহীন সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’ এবং মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগসহ, মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সকল গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, ইতিহাসবিদ, কবি-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মী সকলের কাছে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা যে, ‘জয় বাংলা’ বাঙালির শৌর্য-বীর্য, জীবন-মৃত্যু ও বাংলাদেশের জন্মের মূলমন্ত্র, পশ্চিমবঙ্গের নাম ‘বাংলা’ হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’-এর মর্মার্থ কী হবে?
পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্র্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারের অদূরদর্শীতার কারণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ-এর সম্মান ও মর্যাদা কোথায় দাঁড়াবে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ভারতের জাতীয় সংগীতে যে সকল অঞ্চল বা ভূপ্রকৃতির বিশেষ উল্লেখ রয়েছে তা হচ্ছে: ‘পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ/বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ’।
কাজেই, পশ্চিমবঙ্গের নাম বদল আদৌ যদি প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে বাংলায় ‘বঙ্গ’ আর ইংরেজি ‘বেঙ্গল’ হলে তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অধিকন্তু, বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অমোঘ বন্ধন সারা বিশ্বে যেমন আমাদের অমলিন অহংকার, বাংলাদেশ ও জয় বাংলাও তেমনি।
মুজিব-ইন্দিরার পর, স্মরণকালের ইতিহাসে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক বর্তমানে সকল ক্ষেত্রেই সুন্দর, সম্মানজনক ও সহযোগিতাপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাময় নেতৃত্বে আমরা সমুদ্র ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান করেছি; যোগাযোগ, যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার অবারিত করে চলেছি।
তারই ধারাবাহিকতায়, যেহেতু এখনো সময় ও সুযোগ রয়ে গেছে, সেহেতু দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আলোচনা করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ-এর সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে আমাদের প্রিয় রণধ্বনি জয় বাংলা অক্ষুন্ন ও অখণ্ডিত রাখার উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।
কারণ, হিমাচল যমুনা গঙ্গার উচ্ছল জলধির তরঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত তো একই সঙ্গে অবগাহন করে পূত হয়, পরষ্পর সুখে-দুখে ‘তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিষ মাগে’।
লেখক: কবি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
বিবার্তা/কাফী