১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ প্রদান করেছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সে বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ ও বাক্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। বাঙালি জাতি আজ তা বেমালুম ভুলে গেছে। তারা সে বক্তব্যের বিকৃত চর্চ্চা করেছে।
বাংলাদেশে অসংখ্য গ্রন্থ ও ডকুমেন্টারিতে বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের বর্ণনা রয়েছে। লিখন ও প্রকাশণে ভিন্নতা থাকলেও বক্তব্যের মূলকথা একই। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাখো জনতার সামনে অতি আবেগাপ্লুত কন্ঠে লাখো শহীদদের বারবার স্মরণ করেন এবং স্পষ্ট ঘোষণা করেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যারা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। লাখো মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের স্বাদ পুর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও। আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। এ স্বাধীনতা রক্ষার দ্বায়িত্বও আজ আপনাদেরই। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। খেয়ে পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা।’
বঙ্গবন্ধু সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বভার দেশের সকল জনতার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা নারীর সংখ্যাটি সুনির্দিষ্ট করেছিলেন। তিনি শহীদ ও আত্মত্যাগীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি যোদ্ধা ও শহীদদের আলাদা করেননি। স্বাধীনতার পূর্বেও তিনি একই ঘোষণা দিয়েছিলেন। যেমন উল্লেখ রয়েছে, ‘২৩ শে মার্চ (১৯৭১) আওয়ামী লীগের গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে যে আন্দোলন শুরু করেছে, দেশমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা থামবে না। একজন বাঙালিও জীবিত থাকা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাঙালিরা শান্তিপূর্ণভাবে সে অধিকার আদায়ের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারেও তারা প্রস্তুত।’ (লেখক-কামাল হোসেন, “তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর’, পৃষ্ঠা-২৪৫, ঢাকাঃ অঙ্কুর প্রকাশনী-২০০৮)। অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু এদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতাকেই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহবান করেছিলেন। তার দৃষ্টিতে মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও আত্মত্যাগী পৃথক নয়। সবাই সমান এবং একেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ।
প্রশ্ন হতে পারে, বঙ্গবন্ধু মাত্র ৬৭৬ জন বীর যোদ্ধাকে খেতাব দিলেন কেন? এ বিষয়টি খুবই পরিষ্কার। বঙ্গবন্ধু মাত্র ৬৭৬ জন যোদ্ধাকে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ খেতাব প্রদান করে অবশিষ্ট সমগ্র জনতাকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি দালাল আইনে বিচারও শুরু করেছিলেন।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিচার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাসমূহের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই তিনি উক্ত বিচারের সম্মতি দেন। পরবর্তীতে পাক জান্তার বিচার সম্ভব না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু নিজেই এ বিচার প্রক্রিয়া বাতিল করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার নির্বিশেষে এদেশের প্রতিটি জনতাকেই বীরযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে ঘোষণা করেন।
আজ ২০১৬ সাল, বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর সে অমর ভাষণ ও নির্দেশনা ভূলে গিয়ে তার বিকৃত অনুশীলন শুরু করেছে। তারা ত্রিশ লাখ শহীদদের বাদ দিয়ে মাত্র দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করেছে। দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনকে বঞ্চিত করে মাত্র ৪১ জন নারীকে বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছে। তারা মনে করেছে, এ দুই লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাগণই বাংলাদেশেকে স্বাধীন করেছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আর কারো কোনো ভূমিকা ছিল না। তারা খোদ বঙ্গবন্ধুকেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকার বাইরে রেখেছে। যে হাজার হাজার ভারতীয় সেনাসদস্য দুর্বার সংগ্রাম করে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিল, তাদেরকেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। শুধু দুই লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা আর ৪১ বীরাঙ্গনা ছাড়া আর কাউকে তারা মুক্তিযোদ্ধা মানতে নারাজ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অসাধু রাজনীতিবিদগণ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এমন বিকৃত অনুশীলন শুরু করেছে। তারা রাজনৈতিক স্বার্থে মাত্র প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধার বিতর্কিত তালিকা প্রণয়ন করেছে। তালিকাভুক্তদের নানা সুবিধা দিয়ে অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি চালু করেছে। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। ‘৭১ এর সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙালি ও তাদের ত্রিশ লাখ শহীদদের বঙ্গবন্ধুর দেয়া মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেছে। খোদ বঙ্গবন্ধু কন্যা তথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ও উক্ত অসাধু রাজনীতিবিদদের অর্ন্তভুক্ত হয়েছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটা সুবিধা আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন। বাংলাদেশে প্রচলিত দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটাকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসহ নাতি-নাতনিদেরও কোটা সুবিধায় অর্ন্তভুক্ত করেছেন। তিনি ২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ব্যাপক সুবিধা প্রদাননীতি গ্রহণ করেছেন। নীতিটি এরকম- ‘৭৫ এর পর এযাবতকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিপালনে যতটুকু ভঙ্গ বা ঘাটতি হয়েছে, তা সম্পুর্ণ পুরণ করা।’ এ অবৈধ নীতির আলোকে ইতিমধ্যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিসিএস ও সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি পরিপালিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন বাড়াবাড়ি ও সংকুচিত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট বক্তব্য ও মহান চেতনা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। অথচ ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ এ বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণের মূল শিক্ষণীয় বিষয় এমন ছিল না। কোনো যুদ্ধে যোদ্ধার তুলনায় শহীদের সংখ্যা কখনো বেশি হয় না। যোদ্ধাদের কতক শহীদ, আহত, বন্দী ও বেশীরভাগই গাজী হয়। এদের সবাই একেকজন যোদ্ধা বিশেষ। ১৯৭১ সালে তাই হয়েছিল। ত্রিশ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছিল, দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল, লাখ লাখ বাঙ্গালি শরণার্থী হয়ে মানবেতর দিন কাটিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুসহ লাখ লাখ বাঙালি বন্দী ছিল এবং এদেশের কোটি কোটি বাঙালি স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছিল। লাখ লাখ ভারতীয় সেনাসদস্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করে দুর্ধর্ষ পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করেছিল। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে এদের সবাইকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
২০১৬ সালে আবারো ১০ জানুয়ারি এসেছে, বঙ্গবন্ধুর সে স্মরণীয় ভাষণের মহিমা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও শহীদদের সংখ্যা প্রসঙ্গে সম্প্রতি সৃষ্ট সংশয় দূর করতে উক্ত ভাষণের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি। এজন্য ‘৭১ এর ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন, স্বাধীনতাকামী সকল বন্দি, কষ্টভোগী, শরণার্থী, সাহায্যকারী, প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ বাঙ্গালি ও ভারতীয় বীর যোদ্ধা সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত। মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা বিভাজন দূর করে প্রচলিত দুই লাখ তালিকা ও অবৈধ মুক্তিযোদ্ধা কোটানীতি বাতিল করা উচিত। বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিকসহ ১৯৭১ সালে ভূমিকা পালনকারী হাজার হাজার ভারতীয় সেনা পরিবারকেও মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
লেখক: সিরাজী এম আর মোস্তাক
অ্যাডভোকেট, ঢাকা