কেস-১: আদনান অটিস্টিক। বাবা-মা, চার ভাইবোনের মাঝে সে সবার ছোট ও আদরের। বয়স পাঁচ-এ পা দিলে মা ছোট আদনানকে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে যায় ভর্তি করানোর জন্য। শিক্ষকেরা সাফ না করে দিলে বছর দুয়েক পর পাশের মিশনারি স্কুল তাকে ভর্তি করায় আগ্রহের সাথেই। কয়েক মাস সেখানে গেলে অন্য শিক্ষার্থীদের সমস্যা হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সেখানেও যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে বাসায়ই থাকে। মাঝে মাঝে প্রতিবেশিদের বাসায় যাওয়া ছাড়া সামাজিক কোন কিছুতেই তার আর অংশ নেওয়া হয় না। শুরুতে আদনানের সমস্যা না ধরতে পারলেও পরে স্থানীয় ডাক্তার তার অটিজমের বিষয়ে অভিভাবককে নিশ্চিত করে। আদনানের বয়স এখন ২২। ভাইবোনেরা নিজস্ব সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বৃদ্ধ বাবামার পক্ষে আদনানের সেবা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। দিনের বেশিরভাগ সময় বাসার পাশে মাঠের এককোণায় নোংরা পরিবেশে বসে সময় কাটায় সে। মশা-মাছি, পোকামাকড়ের কামড় এভাবেই বসে থেকে, খেয়ে-ঘুমিয়ে পার হচ্ছে আদনানের দিনগুলো।
কেস-২: দীপিত, বয়স ১৪। ঢাকায় অটিস্টিকদের জন্য বিখ্যাত একটি বিদ্যালয়ে পড়ে। চার বছর বয়স থেকে সে বিদ্যালয়টিতে যায়। শুরুতে অনেক ভায়োলেন্ট আচরণ করলেও এখন অনেক শান্ত। ভালো ছবি আঁকার পাশাপাশি নিজের অনেক কাজ ও সামাজিক প্রতিক্রিয়ায় পারদর্শিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনে দিনে।
কেস-৩: আমেরিকায় বসবাসরত অনাবাসি বাংলাদেশির সন্তান তিরানা। জন্মের একবছর বয়সের মধ্যেই ধরা পড়ে তার অটিজম। রাষ্ট্রীয়ভাবেই একজন শিক্ষক বাসায় এসে প্রিস্কুলিং সেবা শুরু করে দেয়। এ শিক্ষা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিরানা তার আচরণগত ত্রুটিগুলো কাটিয়ে উঠেছে। সে এখন মূলধারার স্কুলে পড়াশুনা করছে।
আদনানের মত অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছে যারা অটিজম ও অন্যান্য স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। আদনানের বাবামায়ের মত অসংখ্য অভিভাবক গ্রামে, মফস্বল শহরগুলোতে রয়েছেন যাদের সন্তানদের কোন বিদ্যালয়ে পড়ানোর ইচ্ছা এখনো অপূর্ণই থাকছে, এমনকি অনেকেই জানেনা সন্তানের সমস্যাটা কি? দীপিত’র মত রাজধানীর কিছু বিত্তবান ও সচেতন পিতামাতার সন্তানেরা এখন বিজ্ঞানসম্মত বিশেষ শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। আর আমেরিকায় বসবাসের সুবাদে অটিস্টিক তিরানা রহস্যময় জগতের বেড়াজাল কাটিয়ে আলোর পথে হাঁটছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অটিজম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও বেশ অস্পষ্টতা রয়েছে, আছে নানা অনাচার-কুসংস্কার। অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারস্- মস্তিকের স্বাভাবিক বিকাশের এরূপ একটি জটিল প্রতিবন্ধকতা যা শিশুর জন্মের দেড় বছর হতে তিন বছরের মধ্যে প্রকাশ পায়। এ ধরনের সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিদের সাধারণ শারীরিক গঠনে কোনো সমস্যা বা ত্রুটি থাকে না এবং তাদের চেহারা ও অবয়ব অন্যান্য সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের মতই হয়ে থাকে। তারা পরিবেশের সাথে যথাযথভাবে যোগাযোগ করতে পারে না, যেমন- ভাষার ব্যবহার না পারা, নিজের ভিতর গুটিয়ে থাকা ইত্যাদি, তবে অনুকরণ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ছবি আঁকা, গান করা, কম্পিউটার চালনা বা গাণিতিক সমাধানসহ অনেক জটিল বিষয়ে এই ধরনের ব্যক্তিরা বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করে থাকে।
অটিজমের কারণ এখনও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। অনেকে মনে করেন, মস্তিষ্কে কিছু কোষের অস্বাভাবিক রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ কিংবা অস্বাভাবিক গঠন এর জন্য দায়ী। আবার অনেক গবেষক বংশগতির কারণে এরূপ অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয় বলে থাকেন । ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’ নামক অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন একে দ্রুত সনাক্ত করা, আক্রান্ত ব্যক্তি ও শিশুকে সঠিক শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উপযুক্ত নার্সিংয়ের ব্যবস্থা করা।
অটিস্টিক শিশুদের মূলধারায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিতকরণ সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া বিদ্যালয় গমনোপযোগী সকল শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তভুর্ক্তকরণ বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকারও। সেইসাথে এসডিজি অর্জনের প্রতিশ্রুতি। সরকারের এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি ও তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ায় ন্যাশনাল অটিজম এন্ড নিউরো ডিসঅর্ডার এডভাইজরি কমিটি এবং গ্লোবাল অটিজম পাবলিক হেলথ এর চেয়ারম্যান সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এর নেতৃত্বাধীন Global Autism Public Health Bangladesh গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থার পথ সুগম করার লক্ষ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা-২০০৯’ প্রণয়ন করে। উক্ত নীতিমালার আওতায় সুইড বাংলাদেশ পরিচালিত অর্ধশত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুল এবং বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন পরিচালিত ইনক্লুসিভ স্কুল এর পাঁচশতাধিক শিক্ষক/কর্মচারীর শতকরা ১০০ভাগ বেতন ভাতা ফেব্রুয়ারি ২০১০ থেকে সরকারিভাবে পরিশোধ করা হচ্ছে। এ বাবদ প্রতিবছর রাজস্ব বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। স্নায়বিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিদেরকে সমাজের মূলধারায় আনয়নের লক্ষ্যে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে। এ আইনে ¯œায়বিক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর যথাসম্ভব শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং তাদের উপযোগী শিক্ষা ও কারিগরি জ্ঞানসহ সার্বিকভাবে সক্ষম করে তোলা, তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা এবং অধিকার সুরক্ষার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে।
২০১০ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফাউন্ডেশনের নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু হয় অটিজম রিসোর্স সেন্টারের। প্রধানমন্ত্রী ২ এপ্রিল ২০১০ আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত সেন্টারের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। কনসালট্যান্ট (ফিজিওথেরাপি), ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট, ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, সাইকোলোজিস্ট, ক্লিনিক্যাল স্পিচ অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপিস্ট এর মাধ্যমে অটিজমের শিকার শিশু বা ব্যক্তিকে উক্ত সেন্টার থেকে বিনামূল্যে নিয়মিত থেরাপি, রেফারেল ও কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ২০১০ সালে চালু হওয়ার পর থেকে দেড় হাজারেরও অধিক অটিজমের শিকার শিশু/ব্যক্তিকে বিনামূল্যে ম্যানুয়াল ও ইনস্ট্রুমেন্টাল থেরাপি সার্ভিস প্রদান করা হয়েছে যা অব্যাহত আছে। এছাড়া এ সেন্টারের আওতায় রেজিস্ট্রিকৃত অটিস্টিক শিশুদেরকে নিয়মিত বাড়িতে গিয়েও সেবা প্রদান করা হচ্ছে।
২০১১ সালে ঢাকায় একটি সম্পূর্ণ অবৈতনিক অটিস্টিক স্কুল চালু করা হয়েছে। ২৮টি দরিদ্র পরিবারের ৩০ জন অটিস্টিক শিশুকে বিশেষ পদ্ধতিতের শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। অটিস্টিক স্কুলের আওতায় পরিচালনাধীন বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে স্কুলে বর্তমানে অধ্যয়নরত অটিস্টিক শিক্ষার্থীবৃন্দ বিভিন্ন ফিজিওথেরাপি/অকুপেশনাল থেরাপি গ্রহণ করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি করে Autism Corner স্থাপন করা হয়েছে ২০১২ থেকে । কেন্দ্রে কর্মরত কনসালট্যান্ট ফিজিওথেরাপি, ক্লিনিক্যাল ফিজিওথেরাপিস্ট, ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ও অটিজম-এ প্রশিক্ষিত কর্মীরা অটিজমের সুনির্দিষ্ট পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত থেকে অটিস্টিকদের সেবা প্রদান করে আসছে।
অটিজমসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০০৯ সন হতে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি তাদের পিতামাতা ও অভিভাবককেও সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। এ যাবৎ অনুষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসমূহ হচ্ছে - ‘ট্রেনিং ফর দ্য মাদার্স অভ্ মেন্টালি চ্যালেঞ্জড চিলড্রেন’, ‘অটিজম সচেতনা বিষয়ক অভিভাবক প্রশিক্ষণ কোর্স’ Modification and Picture Exchange Communication System (PECS), Autism and Development Disorder Management, Training on Parents' Role in Managing Children with Autism Spectrum Disorder, ‘অটিস্টিক সন্তানদের ব্যবস্থাপনায় বাবা-মায়ের ভূমিকা’ ইত্যাদি। এসব প্রশিক্ষণ নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
অটিজম এক ধরনের মানসিক সমস্যা, এটি কোন রোগ নয়- এ বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকার দিয়ে অটিজম বিষয়টিকে পৃথকভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিগত ১৬ হতে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখ পর্যন্ত অটিজমসহ একীভূত শিক্ষার ওপর শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে মাস্টার ট্রেইনার তৈরির জন্য মাঠ পর্যায়ের ৩২ জন কর্মকর্তাকে এঅচঐ ইধহমষধফবংয এর সহযোগিতায় পাঁচদিনের ঞঙঞ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। অটিজমসহ একীভূত শিক্ষা বিষয়ে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে একজন করে শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। একীভূত শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তকরণের উদ্দেশ্যে Strategic Action Plan for Children with Special Needs অনুমোদিত হয়েছে এবং এ অ্যাকশন প্লান এর আওতায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মূলধারার প্রাথমিক শিক্ষায় সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রতিটি পিটিআই হতে দুইজন করে ইন্সট্রাক্টর/সহকারী সুপারিনটেনডেন্টকে একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য পাঁচদিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) ও Global Autism and Public Health, Bangladesh (GAPH,B) এর যৌথ আয়োজনে নায়েমের ২৭ জন অনুষদ সদস্যকে অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এ অনুষদ সদস্যরা মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে নায়েমে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। নায়েম এ অটিজম বিষয়ে মডিউল তৈরির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
ইতোমধ্যে জাতীয় টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক প্রণীত নবম ও দশম শ্রেণির কারিকুলামে অটিজম বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরীক্ষা হলে প্রতিবন্ধী ছাত্র/ছাত্রীরা স্বাভাবিক ছাত্র/ছাত্রীদের তুলনায় ৩০ মিনিট সময় অতিরিক্ত পাবে। বেসরকারি স্কুল/স্কুল এন্ড কলেজ, মাধ্যমিক ও নিন্ম মাধ্যমিক ও সংযুক্ত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা ২০১২ অনুসারে ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের ভর্তির ক্ষেত্রে শূন্য আসনের বিপরীতে দুই শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বেসরকারি খাতও অটিস্টিকদের শিক্ষাপ্রশিক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ‘সুইড বাংলাদেশ’ অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধিদের জন্য সারাদেশে ৯০টি বিশেষ শিক্ষা বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। একটি প্যাকেজ প্রোগ্রাম এর মাধ্যমে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অটিস্টিক শিশু ও তাদের পরিবারকে সেবা দিয়ে আসছে ‘অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’। অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের শিক্ষা কার্যক্রমের বৈশিষ্ট্য হল একটি উচ্চমানের সুসংগঠিত কার্যক্রম যেখানে ছাত্র/শিক্ষকের আনুপাতিক হার ১:১ এবং শিক্ষা কার্যক্রমে যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতা, ব্যবহার ও লেখাপড়ার উপর জোর দেয়া হয়। সেই সাথে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য 'Free Saturday Clinic এবং ৫ বছরের কম অটিস্টিক শিশুদের ‘ঊধৎষু ঝঃরসঁষধঃরড়হ চৎড়মৎধস’ চালু রয়েছে। বর্তমানে ২টি শিফটে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনে ১৬০ জন অটিস্টিক শিক্ষার্থী এবং ৬৫ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা রয়েছেন। ফাউন্ডেশন শিক্ষা/প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে Early Stimulation Program অনুসরণ করে যার মধ্যে Evidence based practice অইঅ, চঊঈঝ অন্যতম। মেধাবী অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে সাধারণ কারিকুলাম ও সিলেবাসসমৃদ্ধ স্বতন্ত্র ক্লাসরুমের ব্যবস্থা। প্রত্যেকটি অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ব্যক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা।
‘সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিলড্রেন (সোয়াক)’ এর সকল ছাত্রছাত্রীকে সেনসরি, অকুপেশন ও স্পিচ এন্ড ল্যাংগুয়েজ থেরাপি এবং হোম রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম প্রদান করা হয়। ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য মা সহ ‘আর্লি ইন্টারভেনশন’ ক্লাস। ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বেসিক এডুকেশন ক্লাস। ১০ বছর বয়স থেকেই প্রি-ভকেশনাল প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের প্রিপারেটরি ওয়ার্ক এন্ড একটিভিটি ক্লাসে ভকেশনাল প্রশিক্ষণ (ব্লক, টাইডাই, বাটিক, সেলাই, পেপার টেকনলজি, ড্রাই ফ্লাওয়ার, মোম, জুয়েলারি, খাম ও ঠোঙা তৈরি, অফিস স্কিল, লন্ড্রি, গার্ডেনিং) দেওয়া হয়। ২৫ ও তদোর্ধ্ব ছাত্রছাত্রীরা ওয়ার্ক এন্ড একটিভিটির অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রুপটি হস্তশিল্প সামগ্রী ও এডুকেশনাল ম্যাটিরিয়াল তৈরি, অফিস ও সেক্রেটারিয়াল কাজ, ক্যাফে ও গার্ডেনিং এর কাজ- অর্থাৎ প্রোডাকশনের ও সেন্টারের প্র্যাকটিকাল কাজগুলো করে থাকে। এছাড়াও প্রয়াস, সীড ট্রাস্ট প্রভৃতি সেচ্ছাসেবী সংগঠন ও এনজিও গিফটেড চাইল্ডদের উন্নয়নে কাজ করছে।
প্রতিটি অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হলে প্রয়োজন সকলের সমন্বিত উদ্যোগ, সঠিক ব্যবস্থাপনা, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, অর্থ ও কঠোর মনোবল। এর সাথে সন্বিবেশ ঘটাতে হবে প্রযুক্তির। আমাদের দেশে সামাজিক পুঁজি তথা স্নেহ, ভালবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহনশীলতা, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এসবের কোন অভাব নেই, যার প্রতিফলন ঘটেছে ’৭১-এ, ’৯৭ এর বন্যায়, ২০০৮-৯ এর বিশ্বমন্দা, কিংবা পদ্মাসেতু নির্মাণ! কোন কিছুতেই থামেনি এ জাতি। স্বল্পসময়ে রহস্যে ঘেরা এসব শিশুদেরকে শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ ও সামাজিক যোগাযোগে পারদর্শী করে তুলতে সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয় সমগ্র বিশ্বের জন্য মডেল। এ যাত্রায় আরও সাফল্য আনতে প্রয়োজন এসব শিশুর কল্যাণে সামাজিক পুঁজির বিনিয়োগ। দেশের চিকিৎসক, বিঞ্জানী, গবেষকগণ অটিজম নিয়ে গবেষণা করতে পারেন, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অটিস্টিক ব্যক্তিদের উপযোগী সংবেদনশীল প্রযুক্তিপণ্য-শিক্ষাপোকরণ তৈরি করতে পারে, শিক্ষাবিদগণ অটিজম ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী বান্ধব বিশেষ শিক্ষা কারিকুলাম বানাতে পারেন। গণমাধ্যম প্রচারের মাধ্যমে সকলের দোড়গোড়ায় এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পৌছে দিবে যাতে আক্রান্ত একটা শিশুও এর পরিকাঠামো থেকে বাদ না যায়, কোন ভ্রান্ত ধারণা তাদের পথ রুখে দেয়। বিত্তবানরা এগিয়ে আসবে তাদের পাশে। যেহেতু অটিস্টিক ব্যক্তির সমস্যার ধরন ও সমাধান প্রক্রিয়া ভিন্ন ও দীর্ঘমেয়াদি, তাই পরিবার-শিক্ষকের পাশাপাশি অন্যদেরও তাদের প্রতি সহমর্মী হতে হবে। আর এতে করেই একদিন এদেশের আদনানরা তিরানার মত সমাজের মূলধারায় মিশে যাবে।
বিবার্তা/এমহোসেন