একটি সত্য ঘটনার বর্ণনা দেয়া যাক শুরুতেই। আমার এক আত্মীয়ের বোনের মেয়ে (বয়স চার কিংবা পাঁচ, গায়ের রঙ্ কিছুটা কালচে) টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে বেশ কয়েকবার তার বাবা-মাকে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি কিনে দিতে বললো। বাবা-মা’তো মেয়ের এই আবদার শুনে হতবাক। অনেকভাবে মেয়েকে বুঝাল এটি একটি বিজ্ঞাপন বৈ কিছু নয়। মেয়েতো নাছোড়বান্দা, সে ফর্সা হবার ক্রিম কিনবেই। আর বাবা-মা মেয়ের এই অর্থহীন আবদার মানবেন না কিছুতেই। অবশ্য নানা বাড়িতে বেড়াতে এসে মোক্ষম সুযোগ মেলে মেয়ে শিশুটির। নানা নানু নাতনির আবদার মেটাতে একটি ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি কিনে দিলেন। মেয়ে এবার হাফ ছেড়ে বাঁচল। বলল, ‘এবার আমি এই ক্রিম মেখে ফর্সা হয়ে যাব। কেউ আমাকে আর কালো বাবু বলবে না।’
পাঠক এই হল আমাদের বর্তমান বিশ্বের পণ্য বাণিজ্যিকীকরণের ধরণ। যেখানে পূঁজিবাজার বাণিজ্য স্পর্শ্ করে্ একটি ছোট্ট শিশুকেও।
আসলে কি জানেন, এখন পৃথিবীটাই চলছে বাণিজ্যের ওপর ভর করে। নতুন যেকোনো ধারণাকেই এখন ব্যবহার করা হয় পণ্য বাণিজ্যিকীকরণের কাজে। আর এই বাণিজ্য পূঁজি নিয়েই ব্যবসায়ীরা জাঁকিয়ে শুরু করেন তাদের ব্যবসা। কিন্তু পণ্যটির গুণাগুণ সম্পর্কে এতটুকুও চিন্তা করেন না তারা। কিংবা চিন্তা করেন না পণ্যটি যদি মানুষের উপকারের পরিবর্তে ব্যাপক ক্ষতি করে তবে তার নেতিবাচক প্রভাবই বা কী হতে পারে। ঠিক এমনই একটিপণ্য হল ফেয়ারনেস ক্রিমগুলো।
শুধু কি ব্যবসায়ীরা? তাদের পাশাপাশি ফর্সা হওয়ার এই বিজ্ঞাপনের সুযোগ নেন ফর্সা হতে চাওয়া কালো রঙের নারীগুলো। হয়ত তারা অনেক বঞ্চনার শিকার হন। তাদের গায়ের রঙ নিয়ে অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে নিয়েও ঝামেলা তৈরি হয়। ইন্টানেটের যুগে অনেকে আবার ফেসবুক কিংবা টুইটারে ছবি দেখে পছন্দ করে বিয়েও ঠিক করে ফেলেন। কিন্তু বিপত্তি হয় তখন যখন দুজনের সামনা সামনি দেখা হয়। বিয়ে ভেঙে যাবার এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে এখন আমাদের সমাজে।
আবার অনেক সময় পাত্ররা কালো মেয়েকে পছন্দ করলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। ফলে এসব বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতেই নারীদের বেছে নিতে হয় দ্রুত রঙ ফর্সাকারী ক্রিমগুলোকে। বাজারে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় এমন অনেক রঙ ফর্সাকারী ক্রিম রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করলে রাতারাতি গায়ের রঙের কিছুটা ঔজ্জ্বল্য বাড়ে। তবে কয়েকদিন পরেই বাধে বিপত্তি। ত্বকে দেখা দেয় বিভিন্ন চর্ম্ রোগ।
ভারতের গবেষণা সংস্থা এসিনিয়েলসেন এর মতে, শুধু ভারতেই ২০১০ সালে এই রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বাজারের আর্থিক মূল্যমান ছিল ৪৩২ মিলিয়ন ডলার। প্রতি বছর তা ১৮% প্রবৃদ্ধি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। গত বছর পর্য্ন্ত দেশটিতে শুধু ফেয়ারনেস ক্রিম ব্যবহার করা হয়েছে ২৩৩ টন।
এতে অবাক হবার কিছু নেই। কারণ বর্ণবাদ প্রথা এই মহাদেশে নতুন কিছু নয়। বর্ণপ্রথার সুবাদে আমাদের মহাদেশে যুগ যুগ ধরে এই ধারণা জন্মেছে যে ‘ব্রাহ্মণরা শুদ্ধ বলেই তারা সাদা এবং নিম্ন বর্ণের লোকজন অশুদ্ধ বলে তারা কালো’। আর এ কারণেই ধীরে ধীরে ফর্সা হওয়ার ধারণা এশিয়া মহাদেশে এত বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশ ফেয়ারনেস ক্রিম কোম্পানিগুলোর সবচাইতে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে।
পাশ্চাত্যের তারকা অভিনেতা ও অভিনেত্রীদের পাশাপাশি আমাদের উপমহাদেশের নামজাদা সব অভিনেতা-অভিনেত্রীই বড় অঙ্কের সম্মানীর বিনিময়ে ফেয়ারনেস ক্রিম কোম্পানি গুলোর মডেল হচ্ছেন, ফলে এসব ফেয়ারনেস ক্রিম নারীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধুই কি নারী? ফেয়ারনেস ক্রিম এখন পুরুষেরও ফ্যাশনের অনুষঙ্গ । বড় বড় অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে লাল গালিচার আয়োজন করা হয় সেখানে নামকরা সব প্রসাধনী সামগ্রীর মডেলরা হেঁটে বেড়ান। এখনতো বড় বড় কো্ম্পানির প্রসাধন সামগ্রীর মডেল হওয়া নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা লাগে। কে কত বেশি পারিশ্রমিক নিয়ে কাজ করতেপারেন এবং অ্যাওয়ার্ড্ অনুষ্ঠানের লাল গালিচায় হাঁটতে পারেন। অর্থের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেন তারা। হাজারও ভক্ত অনুরাগী আর প্রিয় তারকার দেয়া বিজ্ঞাপনের প্রসাধনীটি বাজার থেকে সযত্নে কিনে ব্যবহার করেন। তারকাদের কি তাহলে সমাজের/ভক্তদের প্রতি কোনো দায়ভার নেই?
তবে ফেয়ারনেস ক্রিমের এত বড় বিজ্ঞাপণের বাজারেও গবেষকরা হাত গুটিয়ে বসে নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ রঙ ফর্সাকারী পণ্যে মারকিউরাস ক্লোরাইডের মতো অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্টস ব্যবহার করা হয়, যা ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সম্প্রতি ভারতের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের (সিএসই) পলিউশন মনিটরিং ল্যাব-এ পরীক্ষা করা সবকটি ফেয়ারনেস ক্রিমেই পারদ পাওয়া গিয়েছে যা পরিমাণের দিক থেকে প্রয়োজনের চেয়ে ৪৪ শতাংশেরও বেশি। বাজারে প্রথম সারির মোট ১৪টি ফেয়ারনেস ক্রিমের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হয়। যদিও কসমেটিক্সে পারদের ব্যবহার সম্পূর্ণ ভাবে অনৈতিক ওবেআইনি।
যারা রঙ ফর্সাকারি ক্রিম ব্যবহার করেন তাদের মনে রাখতে হবে, ত্বক গাঢ় বা উজ্জ্বল হওয়ামূলত নির্ভর করে মেলানিন নামে একটি রঞ্জক (পিগমেন্ট) পদার্থের ওপর, যা ত্বকের ওপরের স্তরের (এপিডার্মিস) ঠিক নিচে থাকে। মেলানিনের উপস্থিতি বেশি হলে ত্বক গাঢ় বা কালো হয়, কম হলে উজ্জ্বল বা ফর্সা হয়। একই সঙ্গে মেলানিনের আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যআছে- ত্বক সুরক্ষার কাজটিও এটি করে থাকে। ত্বকে মেলানিন বেশি থাকলে ত্বক তুলনামূলকসুস্থ থাকে ও বিভিন্ন চর্মরোগের ঝুঁকি তেমন থাকে না।
কিন্তু মেলানিন কম হলে ত্বক সহজেই বাইরের আবহাওয়ায় আক্রান্ত হয়, সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এই মেলানিনকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই ত্বকের আসল রঙ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এ জন্যই শীতপ্রধান দেশে শ্বেতাঙ্গরা অতিরিক্ত ফর্সা ত্বকে ট্যান লোশন ব্যবহার করেন মেলানিনের ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য। এগুলোর মধ্যে হাইড্রো কুইনোনই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যা মেলানিনের ঘনত্ব কমিয়ে ত্বককে উজ্জ্বল করতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এর অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহত ত্বক ক্যান্সারের ঝুঁকি। হাইড্রোকুইনিন সমৃদ্ধ যে কোনো পণ্য ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক দেশে নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো প্রসাধনীতে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ হাইড্রোকুইনিন ব্যবহার করা যেতে পারে। একই রকম ঝুঁকিতে রয়েছে স্টেরয়েড।
স্টেরয়েড মেলানিনকে প্রভাবিত করতে পারলেও এর দীর্ঘ ব্যবহারে ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল ও পাতলা হয়ে যেতে পারে, ত্বকে মেলানিনের ভারসাম্য নষ্ট করে কোনো অংশ কালচে ও কোনো অংশ সাদাটে করে দিতে পারে। জাপানে একসময় মার্কারি সমৃদ্ধ ফর্সাকারী ক্রিম চালু হলেও এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে দ্রুত বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে ইউরোপ, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে কোনো প্রসাধনীতে দশ লাখ ভাগের এক ভাগ মার্কারি ব্যবহার করার অনুমতি রয়েছে। এর বেশি হলেই এটিকিডনি সমস্যা, স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যা তৈরির পাশাপাশি গর্ভবতী নারীদের জন্য বড় ধরণের কোনো ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই বলব ত্বকে এমন ক্ষতিকর দ্রব্য ব্যবহার করার চাইতে কৃষ্ণ কলি হয়ে থাকাটাই শ্রেয়। কবিগুরুতো কালো মেয়েদের জন্যও রচেছেন কবিতা- কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক। মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে, কালো মেয়েরকালো হরিণ-চোখ। জয় হোক সব কৃষ্ণকলিদের।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
বিবার্তা/মহসিন