সিকদার আবুল বাশারের সাথে আমার সরাসরি পরিচয় খুব বেশি দিনের নয়। অনেকের কাছেই প্রশংসা শুনেছি তার কিন্তু দেখা হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। লেখালেখির সুবাদে বাংলাবাজারে যাতায়াত। আমার ‘বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা’ গ্রন্থসমূহের প্রকাশক শ্যামল দা বাশার ভাইকে খুব ভালোবাসেন। তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘আপনার গবেষণাধর্মী গ্রন্থগুলো বাশার ভাই প্রকাশ করবেন। আমি বলে দেব।’ শ্যামলদা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি। আমারতো ব্যস্ততার শেষ নেই। অবশেষে একদিন হাজির হলাম বাশার ভাইয়ের সামনে। পরিচয় দেওয়ার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘স্যার আপনাকে আমি প্রথমত চিনি ফেসবুকের মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত চিনি শ্যামলদার মাধ্যমে। আপনি শ্যামলদার লেখক।’
তখন ফেব্র“য়ারি। প্রচণ্ড ব্যস্ত তিনি। কম্পিউটারে কাজ করছেন। আমাকে বসতে ইঙ্গিত করে বললেন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি বলেন। আমি বললাম, আমার বই প্রকাশ করতে হবে আপনাকে। তিনি বললেন, অবশ্যই করবো। শ্যামলদা অনেক আগেই বলেছেন কিন্তু আপনিতো আসেন নি। এখন এ মাসে কি সম্ভব? এখনও অনেক বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। মেলা শুরু হয়ে গেছে, আমরা রাতদিন কাজ করছি। আমি চুপচাপ বসে আছি ইতোমধ্যে চা চলে এসেছে।
তিনি চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন, পাণ্ডুলিপি তৈরি আছে? আমি বললাম, কম্পোজ করা আছে, আপনি বললে পেনড্রাইভে নিয়ে আসব। তিনি সম্মতি দিলেন। আমি দুই দিন পর পেনড্রাইভ নিয়ে গেলাম। তিনি লেখাগুলো তার কম্পিউটারে সেভ করে মনোযোগসহকারে দেখলেন। তারপর বললেন, গবেষণাধর্মী সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ সবগুলো। অনার্স মাস্টার্সের রেফারেন্স বই হবে। কিন্তু এসব সিরিয়াস বইয়ের পাঠককি আছে ? আপনাদের ছাত্ররা কি বই কেনে ?
শিক্ষকরাও বই কেনেন না। যারা লেখক তারাই কেনেন। আপনি লেখক না হলে আপনিও কিনতেন না। আমি নিরুত্তর। কারণ কথাগুলো শতভাগ না হলেও আটানব্বই ভাগ সত্য। তিনি বললেন, বিক্রি হোক আর না হোক আপনার এ বই আমি ছাপবো এবং মেলা চলাকালীনই বের হবে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দেন। আমি বিস্মিত হলাম তার কথা শুনে। আর অভিভূত হলাম তার চমৎকার ব্যবহারে। মানুষকে এত দ্রুত আপন করে নিতে পারেন, তা বাশার ভাইয়ের কাছে না এলে বিশ্বাসই হতো না। ফেসবুকে যে মানুষটির ছবি ট্যাগ করতে দেখেছি অনেক ভক্ত নারী পুরুষকে, যার প্রশংসা করতে দেখেছি অনেক গুণী মানুষকে সেই মানুষটি এত চমৎকারভাবে আমার মন জয় করলেন যে আমি সত্যিই আনন্দে আপ্লুত। ‘ফেব্র“য়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার’ আমার বই সত্যি সত্যিই মেলায় গেল আর আমি হলাম বাশার ভাইয়ের ভক্ত।
সিকদার আবুল বাশার ইতোমধ্যে খ্যাত হয়েছেন সব্যসাচি প্রকাশক হিসেবে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক গ্রন্থ, বিশ্ববিদ্যালয়পাঠ্য বই, রেফারেন্স বই, লোকসাহিত্য, কৃষি ও মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, ছড়া ও শিশুতোষ গ্রন্থ, কর্মক্ষেত্রে সাফল্য বিষয়ক গ্রন্থ, ধর্মগ্রন্থ, প্রকৃতি বিষয়ক গ্রন্থ, নদী বিষয়ক গ্রন্থ, ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ, আবৃত্তি শিক্ষা কি নেই তার প্রকাশনার তালিকায়?
৬৪ জেলাসহ বাংলাদেশের উপজেলাসমূহের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকাশের এক মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন এবং ইতোমধ্যে অনেক জেলা উপজেলার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগ্রন্থ প্রকাশিতও হয়েছে; যার ফলে দেশব্যাপী তিনি এক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। সে কারণেই তাকে বলা হয় সব্যসাচি প্রকাশক। কোনো প্রকার সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই সমগ্র বাংলাদেশের আঞ্চলিক ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে এনে প্রকাশ করা এককভাবে কোনো ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে খুবই দুরূহ কাজ, অথচ সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছেন সিকদার আবুল বাশার।
এ যে অসাধ্য সাধন! সিকদার আবুল বাশার বলেন, ‘দেশ ও জনগণের জন্য যে দায় কাঁধে নিয়েছি, তাতে সরকারি আনুকূল্য আশা করি না; তবে সরকার যেন বিভিন্ন পাঠাগার ও প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো মানের বই কেনে, আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত গ্রন্থ অধিক হারে সংরক্ষণ করেÑসেটাই আশা করি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই কিনতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।’
সিকদার আবুল বাশারের সাথে মিশতে গিয়ে একটি বিষয় উপলব্ধি করেছি যে, তিনি সমগ্র বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে এনে প্রকাশ করে জাতীয় দায়িত্ব পালন করার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের নেক নজরে তিনি নেই। হয়তো তিনি রাজনৈতিক দলবাজি কিংবা সরকারের কর্তাব্যক্তি বা প্রশাসনের চাটুকারিতা করেন না বলেই এমনটি হয়েছে। অথবা দলবাজ লোকদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে সরকারের নেক নজর থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এমনটি সত্যিই জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আমরা মনে করি বর্তমান সময়ে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা তারাই, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সিকদার আবুল বাশার সেইসব কৃতি মানুষদেরই একজন।
আমরা জানি, বাংলাদেশের প্রকাশকরা সাধারণত বাণিজ্যিক ধ্যান-ধারণা পোষণ করেই এ ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ এবং আত্মনিয়োগ করেন। আর এটা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু ব্যবসার কাঁচামালের মূল্য তো হিসেবে রাখতে হবে। কিন্তু তারা অনেক সময়ই ভুলে যান যে, লেখক আছে বলেই তারা প্রকাশক। ফলে লেখকের সৃষ্টিশীলতার পুরস্কার সম্মানের পরিবর্তে অবজ্ঞা জোটে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু সিকদার আবুল বাশার কাঁচামালের মূল্য হিসেবে রাখেন কি না আমি জানি না ; তবে লেখকের মর্যাদার বিষয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন। তাছাড়া যে বিষয়টি আমার কাছে মনে হয়েছে, তিনি অন্যান্য প্রকাশকের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তার কাছে ব্যবসাটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও মুনাফা মুখ্য নয়। তিনি বই প্রকাশ করেন যতটা-না ব্যবসার চিন্তা থেকে, তার চেয়ে অনেক বেশি অন্তরের তাগিদ এবং দায়বদ্ধতা থেকে। তিনি উপলব্ধি করেছেন, ‘যে জাতির সামগ্রিক ইতিহাস নেই, সে জাতি পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন।’ তাই তিনি নিজেই মাথায় তুলে নিয়েছেন জাতির ইতিহাস উদ্ধারের দায়, পালন করছেন জাতীয় দায়িত্ব। তিনি লাভ-লোকসানের হিসেব না করেই এগিয়ে চলেছেন দৃপ্ত পদে।
সিকদার আবুল বাশার শুধু যে একজন প্রকাশক এমন নয়, তিনি বহুমাত্রিক লেখক, গবেষক, অনুবাদক, সাহিত্যিক এবং নন্দিত প্রচ্ছদশিল্পী। অর্থাৎ মানুষ হিসেবেও তিনি একজন সব্যসাচি। গতিধারা এ পর্যন্ত দেড় হাজারের অধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে এবং এসব বইয়ের প্রচ্ছদও তিনি নিজেই করেছেন। অসম্ভব সুন্দর এবং শিল্পঋদ্ধ সেইসব প্রচ্ছদ। আর এ সবের স্বীকৃতিসরূপ তিনি ২০০১, ২০০২ ও ২০০৩ সালে পরপর তিনবার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পী নির্বাচিত হন এবং পুরস্কৃত হন। সৃষ্টিশীল এই গুণী মানুষটি মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য মানসম্পন্ন গ্রন্থ প্রকাশনার মধ্য দিয়ে ‘গতিধারা’কেই শুধু প্রকাশনা শিল্পের শীর্ষে পৌঁছে দেননি, নিজেকেও প্রতিষ্ঠিত করেছেন সমকালীন প্রকাশনা জগতের একটি প্রশংসার্হ আসনে। এরই স্বীকৃতিসরূপ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০০৮এ সেরা মানের গ্রন্থ প্রকাশনার জন্য সম্মাননা লাভ করেন।
এতসব গুণের সমন্বয় যে মানুষটির মধ্যে, তিনি অসাধারণ এবং অহংকারী মানুষ হওয়ারই কথা অথচ তিনি অতি সাধারণ একজন মানুষ। প্রচণ্ড কর্মঠ এবং কর্তব্যপরায়ণ। কৃতি এই প্রকাশক এতটাই প্রচারবিমুখ যে, অনেক সময় নিজের পরিচয়টাও গোপন রাখেন। একুশের বইমেলায় যেখানে লেখক প্রকাশকদের মিলন মেলা বসে এবং টিভি ক্যামেরার সামনে কথা বলার জন্য সবাই উন্মুখ থাকেন, সেখানে সিকদার আবুল বাশার মেলাতেই যান না। তিনি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তার প্রকাশনা সংস্থা ‘গতিধারা’র বিক্রয়কেন্দ্রে বসে কম্পিউটারে কাজ করেন। প্রচ্ছদ করা, ট্রেসিং বের করা, বই বিক্রি করা সবই তিনি নিজে করেন। তার বিক্রির কৌশল দেখে আমি সত্যিই অভিভূত হয়ে যাই।
আমি দেখেছি কোনো ক্রেতা যদি একটি বা দুটি বই কিনতে আসেন তিনি পাঁচ-সাতটি বই কিনে নিয়ে যান। বাশার ভাইয়ের ব্যবহার এবং বিক্রির কৌশলে মুগ্ধ ক্রেতারা বলেন, হাতে টাকা থাকলে আরও অনেক বই নিয়ে যেতাম। দেখা যায়, বাশার ভাইয়ের সামনে সব সময়ই কয়েকজন লেখক বা বন্ধু-বান্ধব বসা থাকেন। তিনি কাজ করছেন অথচ সবার সাথে গল্পও করছেন। রসিকতা তার নিত্যসহচর। সবাই মুগ্ধ তার আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায়। ‘সকল কাজের কাজী’ সিকদার আবুল বাশার কিভাবে যে এতসব পারেন তা কাছে থেকে না দেখলে বিশ্বাসই হবে না।
আমি এই কৃতি মানুষটির দীর্ঘায়ু কামনা করি। এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি তিনি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছুবেন তার কর্মনিষ্ঠা, একাগ্রতা ও নিরলস কর্মতৎপরতায়। তিনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন, সুখে থাকুন। জয় হোক ‘গতিধারা’র, জয় হোক সত্য সুন্দর আর প্রেমের।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।