ফাল্গুনী ভালোবাসায়

ফাল্গুনী ভালোবাসায়
প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ০০:০১:৪৪
ফাল্গুনী ভালোবাসায়
আফরিন জাহান
প্রিন্ট অ-অ+
ভালোবাসা কী? উত্তরটা একদিকে যেমন নেই, অন্যদিকে আবার আছে। সেই উত্তর অবশ্যই বিভিন্ন! কেননা, ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি যা সংজ্ঞায়িত করার ক্ষমতা হয় তো মানব মস্তিষ্কের নেই; শুধু অনুভবের ক্ষমতা আছে, শুধু হৃদয়ে নিজের মতো করে ধারণ করার ক্ষমতা আছে! ভালোবাসা’র তাই বিশেষ কোন দিবস আছ কিনা সে আলোচনায় না যাওয়াটাই বোধ হয় ভালো।
 
এটি একটি বিতর্কিত আলোচনা এই কারণে যে, কারো কাছে ভালোবাসা দিবস মানে একটি দিনকে ঘিরে-ই ভালোবাসা; কারো কাছে আবার আজীবন ঘরের কোণে আনমনে ভালোবাসাকে মনে করাটা ভালোবাসা!
১৪ ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসার রঙ দেখে আমরা অবাক হই। ভালোবাসা কত ধরনের হতে পারে? সন্তানের প্রতি পিতামাতার, পিতামাতার প্রতি সন্তানের, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কিংবা স্বামীর প্রতি স্ত্রীর, প্রেমিক-প্রেমিকার, বন্ধুত্বের, ভাই-বোনের, আত্মীয়তার, মানুষের প্রতি মানুষের আরো কত কী।
 
অনেকেই ভালোবেসে বিয়ে করেন, কিন্তু এই ভালোবাসার মানুষটিকে ভালোবেসে একটা সামান্য গোলাপ কিনে দেওয়ার কথাও মনে থাকে না তাদের। বাস্তবতার আড়ালে যেন হারিয়ে যায় সব। অথচ একসময় এই মানুষটারই ছোট থেকে ছোট ভালোলাগা গুলো ছিল অনেক কিছু।
এসব টুকরো মুহূর্তগুলোকে সাথে করেই একটু একটু করে গড়ে উঠেছে আমাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদটি। আর যদি তাই হবে, তাহলে বলতে হয় যে ভালোবাসার কোনো সীমা নেই, বয়স নেই। মনের মানুষটিকে কাছে পেলেই অথবা বিয়ের পরেই বাস্তবতার আড়ালে যে সব মিলিয়ে যাবে, তা ঠিক না। মনের মানুষটাকে যেকোনো মুহূর্তেই জানিয়ে দেওয়া যায়, না-বলা এই ভালোবাসার কথাটা। আর তাই আমাদের সবারই উচিত, 'অনেকদিন বলা হয় না ভালোবাসি' কথাটা বলে আফসোস না করে, এই মুহূর্তেই ভালোবাসার মানুষটিকে জানিয়ে দেওয়া মনের না বলা কথাটা।
 
ভালোবাসা দিবসটির সঙ্গে আরো একটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত আর তা হল ফাল্গুন। ভালোবাসা দিবসটির ঠিক একদিন আগে এর জন্ম। সেক্ষেত্রে ফাল্গুনকে ভালোবাসা দিবসের অগ্রজও বলা যেতে পারে।
 
ফাল্গুন নিয়ে কবি বলেছেন, ‘আহা আজি এ বসন্তে/ কত ফুল ফোটে/ কত বাঁশি বাজে/ কতপাখি গায়...।’ কিংবা পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে/ এসেছে দারুণ মাস।’- কবিতা আর গানের ছন্দের মতো করেই বাংলার প্রকৃতিতে জানান দিয়ে এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। সারা বছর ধরে বসন্ত প্রেমিকরা অপেক্ষায় থাকেন কবে আসবে পহেলা ফাল্গুন।
 
বাঙালীর প্রিয় এই দিনকে ঘিরে কবি বলেছেন, ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।’ ফাগুন হাওয়ায় দোল লেগেছে বাংলার প্রকৃতিতে। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে বাংলার সবুজ প্রান্তর।
 
শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজেছে এখন প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ ছোট কচি পাতা। ধীর গতিতে বাতাসের বয়ে চলা জানান দিচ্ছে নতুন কিছুর।
প্রকৃতিতে এখন মধুর বসন্তের সাজ-সাজ রব। বসন্তের সমীরণ বলছে এ ঋতু সব সময়ই বাঙালির মিলনের বার্তা বহন করে। ফাল্গুনের আরেক পরিচয় ভাষা শহীদদের তপ্তশোতিক্ত মাস। ঊনিশ’ বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আটই ফাল্গুন মাতৃভাষা ‘বাংলা' প্রতিষ্ঠার জন্য রফিক, সালাম, জব্বার প্রমুখ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন। বসন্তেই বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল। বসন্তেই বাঙালি গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে তাদের প্রাণের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করেছিলেন। আবার এ বসন্তেই তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়েছে।
 
বারবার ফিরে আসে ফাল্গুন, আসে বসন্ত আসে ভালোবাসা দিবস। নৈসর্গিক ক্যানভাসে রক্তাক্ত বর্ণমালা যেন এঁকে দেয় অনির্বচনীয় সুন্দর এক আল্পনা। প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে উদার সড়কের বুকে। সড়কের দেয়াল থেকে লোহিত ধারার মোহনা বয়ে যায় শহীদ মিনার পর্যন্ত। এই কংক্রিটের নগরীতে কোকিলের কুহু ধ্বনিত হয় ফাল্গুনের আগমন সামনে রেখে। ফুলের মঞ্জরিতে মালা গাঁথার দিন বসন্ত কেবল প্রকৃতিকেই রঙিন করেনি, রঙিন করেছে আবহমানকাল ধরে বাঙালি তরুণ-তরুণীর প্রাণও।
 
আবারও ফিরে আসি সেই ফাল্গুনী ভালোবাসায়, বাংলাদেশে যখন ভালোবাসা দিবসটি আসে, তখন প্রকৃতিও একে বরণ করে নিতে এবং যুগলদের ভালোবাসার পরিবেশ তৈরি করে দিতে নতুন রূপে সাজে। ফেব্রুয়ারির শুরুতেই শীতার্ত প্রকৃতি গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে নতুন বসন্তের ডাকে। ভ্যালেন্টাইন ডে' বা 'বিশ্ব ভালোবাসা দিবস' শুনলে প্রথমেই যে কথাটি মনে হয়তা হলো প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল কিংবা স্বামী-স্ত্রী একসাথে ঘুরে বেড়ানো আর আনন্দ-ফূর্তিতে কাটানো সুন্দর একটি দিন। মধুর সম্পর্কে কাছের মানুষ পাশে থাকলে সময় আরো সুন্দর হয়ে ওঠে।
 
দুই যুগ আগের সাথে বর্তমান সময়ের তুলনা করলে দেখা যাবে আমাদের দেশের শহর কিংবা গ্রামের চিত্রে এক আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের কারণে আমরা বাইরে বের হলে দেখি নারী-পুরুষ বন্ধু হয়ে, প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে রাস্তায় বের হয়। যা সময়ের পরিক্রমায় সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। এর ভালো এবং খারাপ দুটি দিকই আছে। ভালো দিকটি হলো নারী আরো এগিয়ে যাচ্ছে, সাবলম্বী হচ্ছে। আর খারাপ দিকটি—নারী নির্যাতনের কিংবা হয়রানির শিকার হচ্ছে।
 
সাম্প্রতিক সময়ে এটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কখনো দেখা যায়, এই পবিত্র সম্পর্কে ভালোবাসার থেকে কখনো কখনো হিংস্রতা-বর্বরতাআমাদের হকচকিয়ে দেয়। প্রতিনিয়ত পত্রিকা কিংবা টেলিভিশনের সামনে বসলে দেখা যায় নারীর উপর বর্বরতার নির্মম চিত্র। আমাদের দেশে নারীরা বিয়ের পূর্বে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়, বিয়ের পরে স্বামী কিংবা স্বামীর বাড়ির পরিবারের মানুষদের দ্বারা নির্যাতিত হয়। দেখা যায় নারীরা নীরবে নিভৃতে এগুলো সহ্য করে যাচ্ছেন। অনেক সময় প্রেমিক তার প্রেমিকার সাথে নির্মম আচরণ করে। যখন ভালোবাসার কথা, গল্পে, কবিতায় স্বপ্নে সময়টা রঙিন হওয়ার কথা, তখন কোনো এক স্বার্থ, দুরভিসন্ধি বয়ে আনে বিপর্যয়, ভালোবাসা হারায় রঙ।
 
এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন মানুষে-মানুষে, নারী-পুরুষের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা। এক অপরকে সম্মান করা। শুধু নারী-পুরুষের সম্পর্ক-ই না মানুষে মানুষে আজ যে এতো বিভেদ তা দূর করতে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। অনেক সময় দেখা যায় সন্তান বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে, গৃহ পরিচারিকার সাথে খারাপ ব্যবহার করে, সমাজের উঁচু স্তরের প্রায় প্রতিটি মানুষ তার থেকে নিম্ন স্তরের মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। কিন্তু মানুষকে ভালোবেসে, তার পদ-পদবি কিংবা সামাজিক অবস্থা বিচার না করে মানুষ হিসেবে সবাইকে বিচার বিবেচনা করলে আর এই ধরনের ঘটনা ঘটে না।
 
তবে এত কিছুর পরেও যান্ত্রিকতা ছাড়িয়ে ফাগুনের আগুনময় ভালোবাসা হয়ে উঠুক নুতন স্বপ্ন রচনার সূতিকাগার। যুগল ও দম্পতিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক আবেগী অনুরাগ–এমনটিই ভালোবাসা দিবসে আমাদের সবার প্রত্যাশা।
 
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
ই-মেইল: [email protected]
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com