বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল-আইসিটি) কখনও কখনও বিদেশি কোনো কোনো মহলের সমালোচনার লক্ষ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের জনপ্রিয় ইস্যু। এক একটি রায় ঘোষণার দিন প্রায় জাতীয় ছুটির মতো উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়- দেশাত্মবোধক গান, রাস্তার পাশে স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত, শিশুদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ চলে।
চলতি মাসের গোড়ার দিকে যখন ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধী ওবায়দুল হক তাহের ও আতাউর রহমান ননীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিলেন, তখন বাংলাদেশের নাগরিকরা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। ওই দুই যুদ্ধাপরাধী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, নির্যাতন ও ১৫ জনকে হত্যা এবং কমবেশি সাড়ে চারশ' বাড়ি লুটের সঙ্গে জড়িত ছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর বাংলাদেশের মানুষের এমন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে যুদ্ধাপরাধী মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পর ঢাকা ও অন্যান্য শহরে হাজার হাজার মানুষ দু'দিন ধরে সেই ঘটনা উদযাপন করেছে। গত নভেম্বরে যুদ্ধাপরাধী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকরের পরও একই ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দেখা গিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যাতে তাদের দায়িত্ব পূর্ণ করতে পারেন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছিল, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিচালিত গণহত্যায় ৩০ লাখ বাঙালির প্রাণ বিনাশে সহায়তা করেছিল, তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে পারেন, সে জন্য এ ধরনের জনসমর্থন গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছর ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের পক্ষে জাতীয়ভাবে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গিয়েছিল, অংশগ্রহণকারীদের ৭৯ শতাংশ চান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত থাকুক। জরিপে দেখা গেছে, এমনকি বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জন্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল সমর্থন এলাকা খুলনা বিভাগেও ৬৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী চেয়েছেন যে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। ব
স্তুত এর একটি বড় কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কারণেই ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিপুল (নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দলের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি সমর্থন নিয়ে) বিজয় লাভ করেছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের প্রতিক্রিয়ায় এমন বিভক্তি কেন? এর সরল-সোজা কারণ হচ্ছে, বাইরের পক্ষ কখনও পুরোপুরি বুঝতে পারে না যে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার সময় বেঁচে থাকা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কতটা কঠিন ছিল। তারা কখনও বুঝতে পারে না যে, দশকের পর দশক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতার বাইরে থেকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখলে একাত্তরের নির্যাতিত বা নিহতের পুত্র ও কন্যাদের কেমন লাগে।
বাংলাদেশ এই বিচারের জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল। ওই যুদ্ধে হানাদার বাহিনী ও তার দোসরদের সাধারণ হাতিয়ার ছিল নির্যাতন ও ধর্ষণ। এমনকি যখন পাকিস্তানি পক্ষ নিশ্চিত হয়েছিল যে, ওই যুদ্ধে তারা হারতে চলেছে, তখন তারা যত বেশি সম্ভব বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী হত্যার এক ভয়াবহ, পরিকল্পিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল_ নিহতদের মধ্যে ছিলেন চিকিৎসক, শিল্পী, শিক্ষক ও লেখক।
তা সত্ত্বেও নিকৃষ্টতম ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীরা চার দশকের বেশি সময় বিচারের কাঠগড়ার বাইরে ছিল। বস্তুত দফায় দফায় সেনা অভ্যুত্থান, হত্যা ও সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে নৃশংসতম কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃস্থানীয় পদে বসানোর পথ তৈরি করা হয়েছিল।
২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধী লালন প্রক্রিয়া বন্ধ করেন। আসলে তিনি স্বাধীনতার পরপরই তার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠিত যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইব্যুনালটিই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ওই ট্রাইব্যুনাল নিষ্ক্রিয় করে।
শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন বৈশ্বিকভাবে আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত রোম স্টাটিউটের কাঠামো অনুসারে। ফলে এই বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। যে কেউ গিয়ে বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। উপরন্তু বিশ্বে বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনালই একমাত্র যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল, যেখানে বিবাদীরা বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারে।
বস্তুত বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিবাদীদের আপিলের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া কয়েকটি মৃত্যুদণ্ডের সাজা যাবজ্জীবন করেছেন। সংক্ষেপে বললে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক। বাংলাদেশি নাগরিকরা তা জানেন।
বিদেশিরা ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করে থাকে এই বলে যে, বিবাদীদের বড় অংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর নেতা। এই সমালোচনার দুটি খুঁত রয়েছে। প্রথমত, অন্যান্য দলেরও, এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও একজন সাবেক সদস্যের বিচার করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
দ্বিতীয়ত, সাক্ষ্য-প্রমাণে যদি দেখা যায় যে জামায়াতের সদস্যরা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাহলে তাদের কি কেবল এই যুক্তিতে বিচার করা যাবে না যে তারা একটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য? বাইরের কারও চোখে ভালো দেখাচ্ছে না বলেই কি ১৯৭১ সালের নৃশংসতার শিকার ব্যক্তি ও দীর্ঘদিনের যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো স্বজনরা বিচার পাবেন না? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়াটাই বরং স্বাভাবিক। কারণ দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকাশ্যই বিরোধিতা করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।
বাইরে থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালবিরোধী সমালোচনা বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ফাঁপা মনে হয়। কারণ তারা প্রত্যক্ষভাবে জানেন, যুদ্ধাপরাধীরা একাত্তরে কী করেছিল। তারা ঘনিষ্ঠভাবে দেখছেন, ট্রাইব্যুনাল কতটা স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। বড় কথা, তারা ন্যায়বিচারের এই সংগ্রামে আস্থা রেখেছেন। এ কারণেই ট্রাইব্যুনাল বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় এবং উচিতভাবেই জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকবে।
লেখক: প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা, ওয়াশিংটন টাইমস থেকে ভাষান্তরিত