হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালি জাতির জনক এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসের এ মহানায়ক ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বার বার কারাবরণ করেছেন।
১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তিনি কারারুদ্ধ হন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ঢাকায় সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে পিকেটিং করতে গিয়েই তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত এভাবে তিনি বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হন।
পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরের মধ্যে ১২ বছরই বঙ্গবন্ধুকে কারাজীবন কাটাতে হয়েছিল। কখনো একই বছরে তিনবার, কখনো এক সাথে তিন বছর (১৯৬৬-১৯৬৯খ্রি.) কারাভোগ করেছেন। আবার কখনো ১৭-১৮ মাস বন্দি থাকার পর মুক্তি পেয়ে জেলগেটে পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৪৮-১৯৫৪ সালের মধ্যে এক নাগাড়ে ২৭ মাস পর্যন্ত তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিলের পর তিনিই ঐ মন্ত্রিসভার একমাত্র সদস্য ছিলেন যাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করে সকল প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। প্রায় চৌদ্দ মাস জেলখানায় থাকার পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেটে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬০ সালের ৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬২ সালের ১৮ জুন তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে পুনরায় গ্রফতার করা হয়।
১৯৬৫ সালে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। ঐ মামলায় তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
ঐতিহাসিক ছয় দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তিনি গণসংযোগ শুরু করেন। এ সময় সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বার বার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ঐ বছর তিনি প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ জানুয়ারি তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। ১
৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে। জনগণের অব্যাহত চাপের মুখে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামীদের মুক্তি প্রদান করতে বাধ্য হয়।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে গড়িমসি করে।
এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরী বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে সাড়া দেয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ঐতিহাসিক এ ভাষণে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আহক্ষান জানিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। ... রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করে।
বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ ১২ টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘোষণাটি ছিল, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’
স্বাধীনতার এ ঘোষণা ওয়্যারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরিত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায়। এর তিন দিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়েই তাঁর জীবনে বার বার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গ কারাজীবন নেমে আসে।
যতটুকু সময় কারাগারের বাইরে থাকার সুযোগ পেয়েছেন তাও হয় হুলিয়া, না হয় গোয়েন্দাদের কঠোর নজরদারির মধ্যে কাটিয়েছেন। তাই, পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য এক বৃহত্তর কারাগার। একবার গ্রেফতার হওয়ার সময় এক রাজনৈতিক কর্মীকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কেন কাঁদিস, এই তো আমার জীবন।’
বঙ্গবন্ধুর একের পর এক কারাভোগের কারণে তাঁর সন্তানরা পিতৃস্নেহ থেকেও বঞ্চিত হয়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু [ফজিলাতুন্নেছা মুজিব] বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু [হাসিনা] ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আবক্ষা’ ‘আবক্ষা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘‘হাচু আপ, হাচু আপা, তোমার আবক্ষাকে আমি একটু আবক্ষা বলি।’ ... আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আবক্ষা।”
গোপালগঞ্জে কোর্টে হাজিরা দিতে মাঝে মাঝে যখন বঙ্গবন্ধুকে অন্য কারাগার থেকে উপস্থিত করা হতো, তখন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে শিশু কামালকেও নিয়ে আসা হতো। সে বঙ্গবন্ধুকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো কিন্তু কাছে যেত না।
এমন একদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কামাল কিছুতেই আমার কাছে আসবে না। দূর থেকে চেয়ে থাকে। ও বোধ হয় ভাবত, এ লোকটা কে?’ এত কারা নির্যাতনের পরেও তিনি কখনো পাকিস্তানিদের সাথে আপস করেন নি। ফাঁসির দড়িকেও ভয় করেন নি। জনগণই ছিল তাঁর প্রাণ। এ মহান নেতা নিজের জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে জনগণের দাবি আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, বাঙালি জাতিকে দিয়েছে স্বাধীনতা।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়