কবি রফিক আজাদ : কিছু স্মৃতি

কবি রফিক আজাদ : কিছু স্মৃতি
প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০১৬, ১৯:৪১:৪৯
কবি রফিক আজাদ : কিছু স্মৃতি
মুহাম্মদ সামাদ
প্রিন্ট অ-অ+
এক.
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। কবি রফিক আজাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বাংলা একাডেমিতে। তার চারতলার অফিস ঘরে। তার পাশের দুই ঘরে বসতেন কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার ও সেলিনা হোসেন। কবি আসাদ চৌধুরী বসতেন তিন তলায়। আমি যতবার গেছি প্রায় ততবারই রশীদ ভাইকে পেয়েছি রফিক ভাইয়ের ঘরে। অনেক সময় রশীদ ভাই অফিসের ছোট-খাটো কাজও এই ঘরে বসেই সারতেন। দুজনের তুই-তুই সম্পর্ক, খিস্তি-খেউড় আর উচ্চস্বরে রফিক ভাইয়ের প্রাণখোলা হা হা হাসি সিগ্রেটের ধোঁয়ায় মিলে-মিশে জানালা দিয়ে হাওয়ায় উড়তে থাকতো। এই আড্ডায় উত্তরাধিকার-এর জন্যে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পাঠানো লেখা পাঠ করে রফিক ভাইয়ের মজার মন্তব্য ছিল খুব উপাদেয় ও উপভোগ্য। তখনকার তরুণ কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এখানেই।
 
দুই. 
বাংলাদেশে তখন নারী অধিকার আন্দোলনের সূচনাকাল। ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মেয়েরা সোচ্চার ও সংগঠিত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় একরকম ঝড় ওঠার অবস্থা। শরৎচন্দ্রে নারীর সহিষ্ণু রূপ, আর রবীন্দ্রনাথের অম্লমধুরতায় তখনো মুগ্ধ সবাই। নারীর ওপর আধিপত্যকারী পুরুষশাসিত সমাজ থেকে উঠে আসা অনেকের পক্ষেই নারীর এই জেগে ওঠাকে হৃষ্টচিত্তে মেনে নেয়া কষ্ট হচ্ছিল। এই সময়ে হঠাৎ কবি রফিক আজাদ গঠন করলেন ‘পুরুষ রক্ষা সমিতি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলি করার জন্যে একদিন দুপুরে আমার ধরিয়ে দিলেন একতাড়া লিফলেট। আমি কলাভবনে গিয়ে এদিক-ওদিক কিছু লিফলেট বিলি করে মধুর ক্যান্টিনে সামনে দাঁড়ালাম। এমন সময় দেখি বিলি করা লিফলেট হাতে কয়েকজন ছাত্র জটলা পাঁকিয়ে আমার পিছন পিছন আসছে আর একজন আঙ্গুল দিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে। শীর্ণকায় হলেও আশৈশব ডানপিটে আমার এসব অভিজ্ঞতা না-থাকার কোনো কারণ ছিলো না। তাই, ওদের উদ্দেশ্য আঁচ করতে আমার দেরি হলো না। আমি পিঠে ছালা বেঁধেও আসি নি। সুতরাং, এক দৌঁড়ে কলাভবনের টিচার্স লাউঞ্জের ভিতর দিয়ে সোজা জহুরুল হক হল! এ কথা বলতে পারি, শেষ দিন পর্যন্ত রফিক ভাইয়ের কাছ থেকে আমি কখনও পালাই নি।
 
তিন. 
ততদিনে রোববার-এর আড্ডায় আমাদের যাতায়াত শুরু হয়েছে। রোববার পত্রিকায় রফিক ভাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবে দেখেছি সাংবাদিক-লেখক তাপস মজুমদার আর মিলন ভাইকে। মিলন ভাই তখন অমিততেজী তারুণ্যের এক মূর্ত প্রতীক। মিলন ভাইকে আমি মাথায় লালপট্টি বাঁধাও দেখেছি একদিন। আমার প্রথম-পড়া মিলন ভাইয়ের ছোটগল্প ‘ফুলের বাগানে সাপ’ রোববার-এ পড়েছি। গ্রাম আর গ্রামের মানুষজনের প্রতি রফিক ভাইয়ের অসম্ভব মমতা ছিল। ফেলে আসা গ্রামজীবনের অনুষঙ্গ নিয়ে লেখা আমার একটি ছোট কবিতা খুব পছন্দ করে তিনি রোববার-এ ছেপেছিলেন। সন্ধান শিরোনামের কবিতাটির পঙ্ক্তিগুলো এরকম ‘দুধেল গাভীর বাটে চঞ্চল বাছুর কই/গৃহস্থের বাংলাঘরে বনহরিণীর শিং?/শরতের কালো জলে কাছিমের গলা কই/বন্যার ঢলের সাথে মাছের চোখের মণি?/শ্মশানে ভূতের ভয়ে লোহাপোড়া পানি কই/ঘুঘুর ডিমের খোঁজে দুপুরের অনাহার?/কুমারী মেঘের অঙ্গে শস্যের আদর কই/কচিঘাসে কম্পমান প্রজাপতি শিহরণ?/পথের ধূলির সাথে পায়ের মিতালী কই/হইচই গোল্লাছুটে আঁকাবাঁকা বালিকারা?’। পরবর্তীকালে রচিত কবি রফিক আজাদের ‘এই গ্রাম তবে উঠে যাবে?’ কবিতাটির ‘...এই গ্রামে ঘন গাছগাছালির/আড়ালে-আবডালে আছে পাখিদের অভয় আশ্রম,/ গোয়ালে জাবর কাটে খুব সুখে নদর বলদ,/ গাভী দুগ্ধবতী; বৃক্ষ ফলবান; স্বচ্ছ জলাশয়;/আর অবারিত মাঠ শস্যরিক্ত হয় না কখনো! ...প্রবাদপ্রসিদ্ধ এই ঋদ্ধ গ্রাম তবে উঠে যাবে?।’এই চরণগুলো চোখে ভাসলেই আমার এখনো কান্না পায়, আমার বুক ভেঙে যায়।
 
চার. 
দিনে দিনে রফিক ভাইয়ের মধ্যে একজন গ্রামীণ পিতা বা অগ্রজের প্রশ্রয় খুঁজে পাই। তার অকৃত্রিম স্নেহ-মমতার ছায়ায় এই নির্দয় শহরে আমার একটা মানসিক আশ্রয় তৈরি হয়। একদিন তাকে আমার  কাব্যগ্রন্থ চলো, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজি-এর প্রুফ দেখে দিতে অনুরোধ করি। সোজা জবাব ‘ভাই, বাসায় পৌঁছে দিও। দু/চারদিন সময় লাগবে।’ তারপর রফিক ভাই খুব যত্ন করে আমার বইয়ের প্রুফ দেখে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন ‘বইয়ে কিছু কবিতা আছে; আর কবিতার বেশকিছু উপাদান আছে। লিখে যাও। আর একটা বলি, কবিতায় কখনো দৃষ্টিকটু ও শ্রুতিকটু শব্দ ব্যবহার করবে না।’ আমি শ্রদ্ধাভরে তার কথাগুলো অনুসরণ করেছি এবং ক্রমাগত উপকৃত হয়েছি। কারণ, বাঙালি লোককবি-এর ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’ কিংবা কবি ভারত চন্দ্রের ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এর মতো বিখ্যাত উক্তি ব্যতীত আর কোনো পঙ্ক্তি কেউ কি উচ্চারণ করেন? এমন কি ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ এর ঠিক আগের পঙ্ক্তি ‘প্রণমিয়া পাটনী কহিল জোড় হাতে’ এটিই বা কতজন জানেন? সুতরাং, আমার মতো এক তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থে, রফিক ভাইয়ের মতো বড়ো কবির ভাষায় ‘বইয়ে কিছু কবিতা আছে’ মন্তব্য আমার জন্যে অমূল্য ছিল বৈ কি? তিনি ব্যাকরণের খুঁটিনাটি আর কিছু বানানও শিখিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া, বানানের চিত্রকল্পও যে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ সেটা বুঝাতেন ‘হাতী’ দিয়ে। তার মতে  হ্রস্ব-ই-কার দিয়ে ‘হাতি’ লিখলে সেটির আকৃতি কল্পনা করলে অর্ধেক হাতী হয়ে যায়। 
 
পাঁচ.
দুই পঙ্ক্তি কবিতা লেখার সুবাদে নব্বইয়ের দশক থেকে এ পর্যন্ত কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমুদ্র গুপ্ত, আসলাম সানী, তারিক সুজাতসহ আমরা অসংখ্যবার আমন্ত্রিত হয়ে কলকাতার বাংলা কবিতা উৎসব, আবৃত্তিলোক উৎসব, বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব, মেঘ উৎসব, বিশ্ব বাংলা কবিতা উৎসব, প্রথম আলো কবিতা উৎসব, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজš§ উৎসবে যোগ দিয়েছি। আর এভাবে বেড়েছে সুনীলদা, সমরেন্দ্রদা, তারাপদদাসহ কলকাতার কবিদের সঙ্গে আমাদের গভীর আত্মীয়তা। এসব উৎসবের সময় রাতভর আড্ডায় গুণদার রসিকতা আর রফিক ভাইয়ের মজার মজার কান্ড-কারখানা উপভোগ করার সুযোগ যাদের ভাগ্যে জুটেনি তাদের দুর্ভাগা বললে অন্যায় হবে না। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, সমুদ্র গুপ্ত, তারিক সুজাতসহ আমরা দ্বিতীয়বার আমন্ত্রিত হই বিখ্যাত হলদিয়া উৎসবে। সে বছর সমকালীন বাংলা কবিতার  কিংবদন্তি মানিকজোড় সুনীল-শক্তির সঙ্গে প্রথম কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হয় আমাদের। মনে আছে, খুব উৎফুল্লচিত্তে শক্তিদা তার কমলালেবু সিরিজের বেশ কয়েকটি কবিতা পড়েছিলেন সেদিন। কে জানতো এই হলদিয়া উৎসব থেকে বিশ্বভারতীর অতিথি অধ্যাপক হিসেবে শান্তিনিকেতনে গিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন আমাদের প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়!
 
 
যাহোক, কলকাতা হয়ে হলদিয়া যাওয়ার আগের দিন বিকেলে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী কবি-অনুবাদক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য আমাদের নন্দন-এ চায়ের দাওয়াত দেন। সেখানে শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যকে সকলেই ‘বুদ্ধদেব দা’ বললেও আমাদের হক ভাই বারবার তাকে ‘মাননীয় মন্ত্রী’ সম্বোধন করছিলেন। আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিলাম। বিষয়টি আমাদের কারোরই ভালো লাগে নি। অবশেষে ‘কবিদের এহেন অপমানের’ বিচারের (?) ভার রফিক ভাইকে দেয়া হলো। রফিক ভাই বললেন ‘রাতে খেয়ে’! আমাদের বরাবরের আস্তানা কিড স্ট্রিটের স্টেট গেস্ট হাউসে অনেক রাত অবধি পানাহার চলছিল। আমি বিচারের (?) আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম! হঠাৎ দেখি, রফিক ভাই ঢুলতে ঢুলতে হক ভাইকে ধরে বসলেন এবং প্রশ্ন করতে লাগলেন যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইস্ত্যা; সুকান্ত কবি, আমরাও কবি, কাজেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যও আমাদের ভাইস্ত্যা। আপনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ‘মাননীয় মন্ত্রী’ সম্বোধন করলেন কেনো? হক ভাই হকচকিত হয়ে বলে উঠলেন এই বেলাল দেখ্, রফিক কী করছে! ঘটনা সাজানো হলেও রফিক ভাইকে শাসনের ভান করে দ্রুত সরিয়ে আনি আমরা।
 
ছয়.
বলা বাহুল্য, সে সময় কলকাতায় আবৃত্তিলোকের কবিতা উৎসব ছিল খুবই লোভনীয়। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবৃত্তিশিল্পী-নাট্যজন সৌমিত্র মিত্রের আমন্ত্রণে কবি রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, বেলাল চৌধুরী, তারিক  সুজাত ও আমি কলকাতায় যাই। আবৃত্তিলোকের কবিতা উৎসবের শেষদিন লেক ক্লাবের আড্ডা ও রাতের পানাহারের পর সুনীলদার সামনেই কথা হলো কবি রফিক আজাদ আর আমি দুয়েকদিন থেকে যাব। পরদিন ভোরে কিড স্ট্রিটের স্টেট গেস্ট হাউসে রফিক ভাইকে সুনীলদা ফোন করে জানালেন তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন, আমাদের পিকনিকে যেতে হবে। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে আমরা তৈরি হয়ে সুনীলদার গড়িয়াহাটের ম্যান্ডে ভিলা ফ্ল্যাট বাড়িতে পৌঁছলাম। অই দিন সকালের আর একটা ঘটনার কথা বলা উচিৎ। রফিক ভাই কিছু পারিবারিক জিনিস-পত্র কিনতে যা বাজেট করে নিয়ে এসেছিলেন তার দ্বিগুণ টাকার দরকার পড়ল। রাতে সুনীলদার কাছ থেকে টাকা ধার করার সিদ্ধান্ত হলো। রফা হলো রফিক ভাইয়ের পক্ষে টাকাটা আমি চাইবো। সুনীলদার পাশে বসে লাজুক রফিক ভাই বারবার আমাকে ইশারা করছিলেন আর গোপনে আঙ্গুলের গুঁতো মেরে মেরে তাড়া দিচ্ছিলেন। অবশেষে আমি বললাম সুনীলদা, রফিক ভাইয়ের কিছু টাকা লাগবে। সুনীলদা জিগ্যেস করলেন কত টাকা? আমি উত্তর দিলাম পাঁচ হাজার। সুনীলদা কোন কথা না-বলে ভিতরে গিয়ে পাঁচ হাজার টাকা এনে রফিক ভাইয়ের হাতে দিলেন।
 
যা হোক, সুনীলদা, স্বাতীদি, রফিক ভাই ও আমাকে নিয়ে সুনীলদার দীর্ঘদিনের বহনসঙ্গী মহীন্দ্রদা আমাদের নিয়ে ছুটলেন। আমি স্বাতীদির পাশে, তারপর রফিক ভাই আর সামনের বামসিটে সুনীলদা। স্বাতীদি জানালেন, কলকাতার খুব বড় হার্টের ডাক্তার শৈবাল গুপ্তের বিশাল বাগানবাড়িতে পিকনিক হবে। সঙ্গে শৈবালদার স্ত্রী সমাজকর্মী শ্রীমতী বিদ্যুতপর্ণা, সুনীলদার আরেক বন্ধু সুস্নাতদা এবং কয়েকজন শিশু কিশোর কিশোরীকে নিয়ে আমাদের পিকনিকবহর প্রায় তিন ঘন্টায় পৌঁছল কলকাতা শহর থেকে পয়ষট্টি মাইল দূরে তেতুঁলচন্ডী গ্রামে। পুকুরের শানবান্ধা ঘাট ঘেঁষে অনিন্দ্য স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি সুন্দর দোতলা বাগানবাড়ি। বাগানভরা নানান জাতের ফুলের সমাহার। আম-জাম-কাঠাল-লিচু-জামরুল-বৈচিসহ বিচিত্র সব ফলগাছের সমারোহ। এমন জমিদার বাড়ির মতো বাগানবাড়ি দেখে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও মালিকানার নীতি বিষয়ে আমার কেমন যেনো স্বপ্নভঙ্গ হলো। মনে মনে খুব বড় একটা ধাক্কা খেলাম।
 
কবি রফিক আজাদকে নিয়ে এই লেখায় পিকনিক প্রসঙ্গের অবতারণা এই জন্যে যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর  শ্রদ্ধা-ভালোবাসার চরম পরাকষ্ঠা দেখেছিলাম সেদিনÑ যা কেউ কল্পনাও করতে পারবেন না। পিকনিকের রান্না-বান্নায় দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছিল। নানান মজাদার খাবারের সৌরভ বাগান ছাপিয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল হেমন্তের মৃদু-মন্দ বাতাস। চারিদিকে উর্বর কালোমাটির কৃষিজমিতে কাঁটা ধানের নাড়াগুলো বিচ্ছেদবেদনায় আকাশের দিকে হা করে তাঁকিয়ে কাঁদছে। সেই বাগানবাড়ির দেখাশোনা করেন মুজিব নামে এক দরিদ্র মুসলমান যুবক। সবাই তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ডাকাডাকি করায় বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক কবি রফিক আজাদের মন বেদনায় ভরে ওঠে। তিনি আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বঙ্গবন্ধুর নাম ডাকা আমার সহ্য হচ্ছে না। ওর আসল নামটা থাকুক আর নতুন একটা ডাকনামে ওকে ডাকলেই তো চলে। আমি বললাম চলেন সুনীলদাকে বলি। রফিক ভাই বললেন আমি সাথে থাকি, তুমি বলো। তথাস্তু। কাজ হয়ে গেলো। এতোদিন পরে সেই যুবক মুজিবের নতুন ডাকনাম আমি ভুলে গেছি!  
 
সাত.
নব্বইয়ের দশকে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী স্তিমিতপ্রায় আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চারে বাংলাদেশের শুভবাদী কবিদের আয়োজনে জাতীয় কবিতা উৎসবের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ১৯৯৭ সাল। সে বছর সৈয়দ শামসুল হকের জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতির পদ ছেড়ে দেবার পালা। ১৯৮৭ সাল অর্থাৎ প্রথম কবিতা উৎসব থেকে দৈনিক সংবাদ-এ কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহ পহেলা জানুয়ারি থেকে দোসরা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উৎসবের প্রস্তুতি আর খুঁটিনাটি নিয়ে প্রতিদিন একটি করে লেখা লিখতেন। ১৯৯৭ সালে, উৎসবের দু’একদিন আগে আতীকুল্লাহ ভাই লিখে দিলেন এবার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হবেন যথাক্রমে কবি রফিক আজাদ ও মুহাম্মদ সামাদ। কবি শঙ্খ ঘোষের একটি কথা আছে বাঙালির সংঙ্ঘ এক দশকে ভেঙে যায়। সেটি উল্লেখ করে জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি রফিক আজাদ পরের বছর এগারতম কবিতা উৎসবে তার ভাষণে লিখলেন বাংলাদেশে সংঙ্ঘ এক দশকে ভাঙে না, যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন আমাদের এই কবিতা পরিষদ থাকবে, এবং আমাদের উৎসব অনন্তকাল ধরে চলবে, আমাদের কবিরা যুগে-যুগান্তরে জাতিকে আলোর পথ দেখাবে। আমরা কবি রফিক আজাদের অনুপম কবিতা আর আলোর পথের অঙ্গীকার আমরা বহন করে নিয়ে যাচ্ছি।
 
আট.
জাতীয় কবিতা পরিষদের উদ্যোগে কবি-সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের আশিতম জন্মবার্ষিকীর আয়োজনে অংশগ্রহণ ছিল কবি রফিক আজাদের জীবনের শেষ অনুষ্ঠান। সেদিন অসুস্থ শরীরে লাল পোশাক পরে আনন্দিতচিত্তে এসেছিলেন রফিক ভাই। স্বতঃস্ফুর্ত, সুন্দর ও সাবলীল বক্তৃতায় তার শেষ কথা ছিল হক ভাইয়ের কবিতা পড়ার জন্যে আরও কয়েকটা দিন বেঁচে থাকতে চাই!
 
মার্চ ২০১৬, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com