সুচিত্রা সেন-এর পৈতৃক বাড়ি উদ্ধার আন্দোলন এবং কিছু কথা

সুচিত্রা সেন-এর পৈতৃক বাড়ি উদ্ধার আন্দোলন এবং কিছু কথা
প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০১৬, ১৯:৩১:৪৫
সুচিত্রা সেন-এর পৈতৃক বাড়ি উদ্ধার আন্দোলন এবং কিছু কথা
হাবিবুর রহমান স্বপন
প্রিন্ট অ-অ+
সুচিত্রা সেন-এর বাবা ছিলেন করণাময় দাসগুপ্ত। পাবনা শহরের বর্তমান পুরাতন পলিটেকনিক-এর সামনে হেম সাগর লেনের এই বাড়িতেই সুচিত্রার জন্ম। ১৯৮৭ সালে পাবনা জেলা প্রশাসন ইমাম গাজ্জালি ইনস্টিটিউট নামে একটি বেসরকারি গার্লস স্কুল এবং কলেজকে লীজ দেয়। জামায়াতে ইসলামীর একটি ট্রাস্টি বোর্ড স্কুল ও কলেজটি পরিচালনা করতো। এক সময় বাড়িটির আঙ্গিনায় নানা ফুল, নানা দামি গাছ ছিল। এখন আর সেগুলো নেই। সব কেটে সাবাড় করে খোলা অংশে জুড়ে কয়েকটি টিনের ঘর তোলা হয়।  ছাদ ভেঙে টিনের চালা লাগানো হয়। বাড়ির প্রবেশ পথ বন্ধ করে সড়কের ধারে তোলা হয়েছে দোকান ঘর। প্রধান সড়ক থেকে আড়াল হয়ে গেছে বাড়িটি।
 
জামায়াত পরিচালিত ইমাম গাজ্জালি ইনস্টিটিউট সরিয়ে বাড়িটি উদ্ধার করতে পাবনার সকল সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেক দিন আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়। প্রয়াত শফিকুল ইসলাম শিবলীর বাড়ির নিকটবর্তী সুচিত্রা সেন-এর পৈতৃক বাড়িটি দখলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম কলম ধরেন শফিকুল ইসলাম শিবলী। আজকের কাগজের সহযোগী সাপ্তাহিক ‘কাগজ’-এর পাতায় দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রবন্ধে শফিকুল ইসলাম শিবলী বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িটি অবমুক্ত করে সেখানে একটি স্মৃতি সংগ্রহশালা অথবা স্মৃতি মন্দির করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এর পরেই পাবনার সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা বাড়িটি অবমুক্ত করার আন্দোলন শুরু করেন।
 
ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কমরেড জাকির হোসেন, গণতন্ত্রী পার্টির সুলতান আহমেদ বুড়ো, জাসদ-এর আমিরুল ইসলাম রাঙা, কম্যুনিস্ট পার্টির রেজাউল করিম মনি, ড্রামা সার্কেল-এর গোপাল সান্যাল, মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল, এই আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন আওয়ামী লীগ নেতা সাইদুল হক চুন্নু। পাবনায় কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিক বাদে সকল সাংবাদিক এই আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন।
 
দীর্ঘ কয়েক বছর আন্দোলন চলে। জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় দখলদার স্কুল কর্তপক্ষ মামলা করে। উচ্চ আদালত মামলায় বাড়িটি অবমুক্ত করার পক্ষে রায় দেয়। এর আগে আন্দোলন চলে মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন ইত্যাদি। সেই সাথে চলে সুচিত্রা সেন-এর জীবন ভিত্তিক আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র উৎসব ইত্যাদি। উক্ত অনুষ্ঠান সমূহে অংশ গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের সকল চলচ্চিত্র শিল্পী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নায়ক রাজ রাজ্জাক, ফারুক, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চন, নায়িকা শাবানা, কবরী, দিতি, অঞ্জনা প্রমুখ। চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন, সুভাস দত্তও এসেছিলেন। জমজমাট চলচ্চিত্র উৎসবের সমন্বয়ক বা নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড জাকির হোসেন। তিনি সকল অতিথিকে নিমন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে সকলকে আপ্যায়িত করার মূল কাজগুলো করেন দক্ষতার সঙ্গে।
 
২০০৯ সালের ২৩ অক্টোবর পাবনা টাউন হল প্রাঙ্গণে উৎসবের উদ্বোধন করেন, চলচ্চিত্র অভিনেত্রী সারা কবরী এমপি। প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যথাক্রমে চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত, নাট্যজন আলি যাকের ও চলচ্চিত্র সমালোচক সাব্বির চৌধুরী। জেলা প্রশাসক ড. এ এফ এম মঞ্জুর কাদির সভাপতিত্ব করেন। প্রতিদিনই চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
কিংবদন্তি পাবনার মেয়ে কৃষ্ণা ঘটনাচক্রে একদিন হয়ে যান সুচিত্রা সেন। কৃষ্ণা থেকে রমা দাশগুপ্ত তার পর রমা সেন এবং সুচিত্রা সেন। বাংলার মানুষের প্রিয় শিল্পী। অবিভক্ত পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহাকুমার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা) বেলকুচি উপজেলার সেন ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে নানা রজনীকান্ত সেনের বাড়িতে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল সুচিত্রা সেনের জন্ম।
 
পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার একতলা পাকা পৈতৃক বাড়িতে আজকের সুচিত্রা সেনের শিশুকাল, শৈশব ও কৈশোর কেটেছে। তার স্কুলে ভর্তি করার সময় আরো একটি নাম রাখেন কৃষ্ণা দাশগুপ্ত। তার সম বয়সিরা তাকে কৃষ্ণা এবং কম বয়সিরা কৃষ্ণাদি বলে ডাকতেন। বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির স্যানিটারী ইন্সপেক্টর পদে চাকরি করতেন। মা ইন্দিরা দাশগুপ্ত ছিলেন গৃহিনী। দু'বোনের মধ্যে সুচিত্রা ছিলেন বড়। ছোট বোন হেনাদাশগুপ্ত। শহরের মহাকালী পাঠশালায় পড়ালেখা শেষে সুচিত্রা সেন স্থানীয় পাবনা বালিকা বিদ্যালয়ে (বর্তমান সরকারি) নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। পাবনায় আট থেকে দশজন তার ঘনিষ্ট স্কুল বান্ধবী ছিলেন। এদের মধ্যে মঞ্জুশ্রী ও সিরাজুন নেছা খানমের সাথে ছিল বেশি ঘনিষ্ঠতা। পড়ালেখায় খুব একটা মনোযোগী ও মেধাবী ছিলেন না সুচিত্রা সেন। তার গান, নাটক, অভিনয় প্রিয় ও পছন্দের ছিল। পাবনা শহরের নানা অনুষ্ঠানে গান গাওয়া ও নাটক থিয়েটারে তিনি অভিনয়ে দক্ষতা দেখান। বাংলার গভর্নর জন এন্ডারসন  এর স্ত্রী উইলি এন্ডারসন পাবনা বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসলে তার সম্মানে কৃষ্ণার নেতৃত্বে (সুচিত্রা সেন) সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ‘ঋতুরঙ্গ’ মঞ্চস্ত হয়। সুচিত্রার পিসি (ফুফু) বানী দাশ গুপ্ত এই বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিলেন । তিনি নাচ গান ও অভিনয়ের শিক্ষা দিতেন।
 
উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া সুচিত্রা সেনের ওপর বাবা-মায়ের একটু বাড়তি আদর-সোহাগ-স্নেহ ছিল। আবার বাড়তি শাসনও ছিল। ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের ক’মাস পরে সুচিত্রার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনার বাড়ি-ঘর, চাকরি সবকিছু ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যান। করুণাময় দাশগুপ্ত নিজের বাড়িটি সরকারের কাছে ভাড়ার বন্দোবস্ত হওয়ায় অনেকটা অভিমান করেই পাবনা ছাড়েন। এরপর সুচিত্রা ও তার বাবা-মা কিংবা তার পরিবারের কেউ পাবনার এ বাড়িতে আসেননি। সুচিত্রা সেনেরও এখান থেকে যাওয়ার পর চেনাজানা ও ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের সাথে সম্পর্কের ইতি ঘটে। কোনো যোগাযোগ হয়নি। কলকাতা বেড়াতে যাওয়ার বছর দুয়েক পরেই সেখানকার বনেদি পরিবারের ছেলে দিবানাথ সেনের সাথে পাবনার মেয়ে রমাদাশগুপ্ত অর্থাৎ কৃষ্ণার বিয়ে হয়। বিয়ে হয় পাবনার বাড়িতেই। চলে যান কলকাতায়। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তিনি একবার পাবনায় এসছিলেন। আর বিয়ের পর স্বামীর পদবীতে রমাদাশগুপ্ত হয়ে যান রমা সেন। সুচিত্রা সেনের স্বামী দিবানাথ সেনের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশেরই দক্ষিণের এক জেলায়।
 
পাবনার উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রমা বনেদি পরিবারের বধু হয়ে ঘর সংসার করতেই সিনেমার অভিনয়ে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের আড়াই বছরের মাথায় ১৯৫২ সালে “শেষ কোথায়” নামের একটি বাংলা ছবিতে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। অজ্ঞাত কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে নায়িকা হয়ে তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবিটি মুক্তি পায়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ৩৫ বছর সুচিত্রা সেন নিজেকে সিনেমার অভিনয়ে জড়িত রেখেছিলেন। স্বামী দিবানাথ সেনের প্রবল আপত্তি থাকলেও সুচিত্রা সেন মনের তাগিদে নিজেকে অভিনয়ে জড়িত রেখেছিলেন। ‘সাত নম্বর কয়েদি’ ছবির পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। তারই একজন সহকারী পরিচালক নীতিশ রায় এ ছবিতে অভিনয় করার পর ছবি মুক্তির সময় রমা নাম বদলে নাম দেন সুচিত্রা সেন।
 
এরপর থেকেই কিশোরী বেলার বান্ধবিদের কৃষ্ণাদি বাবা-মায়ের দেওয়া নাম রমা দাশগুপ্ত থেকে স্বামীর পদবী নিয়ে রমা সেন সবশেষে স্বপ্নসুন্দরী সুচিত্রা সেন। সাত নম্বর কয়েদি ছবির নায়ক ছিলেন সমর রায়। সুচিত্রা সেন বাংলা ৫৬টি ও ৭টি হিন্দি মিলে মোট ৬৩টি ছবিতে নায়িকা হয়ে অভিনয় করেছেন। এর মধ্যে ৩২টি ছবিতেই নায়ক ছিলেন উত্তম কুমার। উত্তম কুমারের সাথে ১৯৫৩ সালে প্রথম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে সুচিত্রা সেন নায়িকা’র চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে উত্তম-সুচিত্রা জুটির শেষ ছবি ‘প্রিয় বান্ধবী’ মুক্তি পায়। সুচিত্রা শেষ অভিনীত সর্বশেষ ছবি  ‘প্রণয় পাশা’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। এ ছবির নায়ক ছিলেন, সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়। সুচিত্রা অভিনীত ৭টি ছবিতে বিকাশ রায় এবং ৫টিতে বসন্ত চৌধুরী নায়ক ছিলেন।
 
এক সময় পাবনা থেকে কেউ কোলকাতা গিয়ে সহজেই সুচিত্রা সেন এর সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে পারতেন। তিনি তাদের কাছ থেকে পাবনা শহর, পুরোনো বান্ধবীদের চেনা-জানা ব্যক্তিদের খোঁজ-খবর আগ্রহ ভরে জিজ্ঞাসা করে জানতেন। ১৯৭৮ সালে সিনেমায় অভিনয় বন্ধ করে দেয়ার পর থেকেই তিনি আর কারো সাক্ষাৎ দেন না। পাবনার অনেকেই কোলকাতায় গিয়ে সুচিত্রা সেনের সাক্ষাৎ পেতে গেলে ভিতর থেকে বিনয়ের সাথে না উত্তর মিলেছে।
 
পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লার (পুরাতন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বিপরীতে) সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বাড়িটির হালদশা দেখে মনে ব্যাথা জাগায়। একতলা পাকা বাড়িতেই সেই রমার শিশুবেলা, শৈশব, কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে। এ বাড়ির সবখানেই তার হাতের ছোঁয়া, পদচারণা স্মৃতি হয়ে মিশে আছে। এক সময় এই বাড়ির তুলশিতলায় মায়ের আচল ধরে সাঁঝবাতি দেওয়া আর শাখাধ্বনি দিতে দেখেছেন আজকের সুচিত্রা সেন।
 
এখন এ বাড়িতে নেই তুলসিগাছ। প্রায় ভগ্নদশা। বাড়িটিতে ১৯৪৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত জেলায় কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটগণ থাকতেন। পরে এ বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করেন অনেকেই। বাড়ি ভাড়া দেয়া টাকাতেই বাড়িটির মেরামত রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা বা বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। পাবনার মেয়ে সুচিত্রা সেন। কিংবা রমাদের বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি করা হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। কিন্তু ওই দাবি বাস্তবায়ন হয়নি।
 
পাবনায় সুচিত্র সেন-এর জন্ম দিন উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ৫ দিন ব্যাপী চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছে। কিন্তু যারা এই বাড়িটি উদ্ধারের আন্দেলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তারা এখন আর নেই। তাদের রাখা হয়নি উদ্যাপন কমিটিতে। কিছু ব্যক্তি এই সাফল্য নিজের বলে চালাতে চাচ্ছেন। যা কখনোই সম্ভব হবে না। ইতিহাসকে কেউ কখনো খণ্ডিত বা বিকৃত করতে পারে নাই পারবেও না। আমরা চাই সুচিত্রা সেন-এর স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি হোক সাংস্কৃতিক আঙিনা।
 
 
লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক, পাবনা।
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com