গত ১৬ই মার্চ বুধবার কলকাতার ইডেন গার্ডেনে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচে বাংলাদেশ- পাকিস্তানের মধ্যে অনুষ্ঠিত খেলায় রান আউট থেকে বাঁচার জন্য তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সাকিবের এক পায়ের কেড্সটি খুলে পড়ে যায়। পরে কেড্সটি কুড়িয়ে সাকিবের হাতে তুলে দেন আফ্রিদি।এটি হলো আমার আজকের শিরোনামের মূল বিষয়বস্তু।
সাকিবের জুতা কুড়িয়ে দেবার বিষয়টিকে আফ্রিদির এক অনন্য দৃষ্টান্ত বলে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, টুইটার এবং ইউটিউবে অনেককে মন্তব্য করতে দেখা গেছে। এ ঘটনাকে পুঁজি করে আফ্রিদি ভক্তের বাইরের অনেককেও আফ্রিদির পক্ষে গুণকীর্তন করতেও দেখা গেছে।পাঠক আমার লেখার শিরোনাম দেখেই অনুমান করতে পেরেছেন আফ্রিদি জুতা কুড়িয়ে সাকিবের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনায় আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি।
আফ্রিদি যদি জুতা কুড়িয়ে সাকিবের পায়ে পরিয়ে দিতেন তখন আমি সন্তুষ্ট হতাম। জুতা কুড়িয়ে সাকিবের হাতে তুলে দিয়ে আফ্রিদি যতটুকু সম্মানিত ও প্রশংসিত হয়েছেন, তার চেয়ে অধিক সম্মানিত হতেন জুতোটি সাকিবের পায়ে পরিয়ে দিয়ে।
গত বছর বাংলাদেশের অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল অষ্ট্রেলিয়ায় সিরিজ খেলতে গিয়েছিল। সেখানে বাংলার এক টাইগারকে দক্ষিণ আফ্রিকার একজন ব্যাটসম্যানের জুতার ফিতা বেঁধে দিতে দেখা গেছে। তখন আমরা সন্তুষ্ট হয়েছিলাম এজন্য যে, বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছে বাংলার টাইগাররা নিরহংকারি। জুতার ফিতা বেঁধে দেবার মধ্য দিয়ে টাইগাররা দেশের ভাবমূর্তি বহুগুণে উজ্জ্বল করার পাশাপাশি বাঙ্গালি জাতিকে নিরহংকারি হিসেবে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন।
আমরা জানি পাকিস্তানের অধিনায়ক শহীদ আফ্রিদি একজন বিশ্বমানের ক্রিকেটার। পারফরমেন্স নিয়ে কিংবা পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের সাথে আমাদের মনস্তাত্বিক যে বিরোধ- সে কারণেও আমি তাকে কোন ভৎর্সনা বা হিংসা বিদ্ধেষ পোষণ করছিনা। আমি তার উদ্দেশ্যে বলতে চাই তিনি নিজের অহংকার ভেদ করে সাকিবের জুতা হাতে নিয়েছিলেন। অবশিষ্ট অহংকার ঝেড়ে ফেলে জুতাটি সাকিবের পায়ে পরিয়ে দিয়ে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে নিজেকে শিরোনামে নিয়ে যেতে পারতেন। জহরলাল নেহেরুর মত আফ্রিদিও জুতা কুড়িয়ে পরিয়ে দিয়ে ইতিহাস গড়তে পারতেন। এ প্রসঙ্গে জওহরলাল নেহেরুর জুতা কুড়ানোর একটি কথা মনে পড়ে যায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর আমন্ত্রণে পাকিস্তানের রিপাবলিকান-আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূন ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেই সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রী নূনের সঙ্গী হয়েছিলেন তার পত্নী ভিকারুননিসা নূন। পিআইএর বিশেষ বিমানে তারা নয়াদিল্লি যান। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু পাকিস্তানি অতিথিদের পালাম বিমানবন্দরের গ্যাংওয়েতে গিয়ে অভ্যর্থনা জানান। মালিক ফিরোজ খান ও ভিকারুননিসা বিমানের সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি নামছিলেন। সিঁড়ির কয়েক ধাপ অবশিষ্ট থাকতেই বেগম ভিকারুননিসার এক পায়ের জুতা খুলে নিচে পড়ে যায়। নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা বিমানটি ঘিরে ছিলেন। তাদের কেউ নন, সিঁড়ির নিচ থেকে বেগম নূনের জুতাটি স্বয়ং জওহরলাল নেহেরু তুলে আনেন। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা ও অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারাও তখন হতবাক। হতবাক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু তাদের হতবাক হওয়ার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন তারা দেখেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জুতাটি বেগম নূনের পায়ে পরিয়ে দিতে এগিয়ে গিয়ে নিচু হচ্ছেন। সেটি ছিল অকল্পনীয় দৃশ্য।
বেগম নূনের পায়ে জুতা পরিয়ে দিতে গিয়ে নেহেরু ছোট হয়েছেন, সে-কথা দুনিয়ার কোন মানুষ বলবে না। বরং প্রকাশ পেয়েছে নেহেরুর ঔদার্য, পরম সৌজন্যবোধ ও শিষ্টাচার। নেহেরু, ফিরোজ খান বা ভিকারুননিসা কেউই ছোট পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ নন। একজন এলাহাবাদের অভিজাত পরিবারের মানুষ, আরেকজন পাঞ্জাবের অভিজাত সামন্ত-ভূস্বামী পরিবারের। নেহেরুর বাবা মতিলাল নেহেরু ছিলেন ভারতের ব্রিটিশবিরোধী শীর্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একজন এবং পরে মহাত্মা গান্ধীর বন্ধু ও সহকর্মী। নেহেরু যদি প্রধানমন্ত্রী নাও হতেন, ছিলেন একজন বিশ্বমানের বুদ্ধিজীবী। ফিরোজ খান নূন পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। ভিকারুননিসা ছিলেন একজন সমাজকর্মী।
বাংলাদেশে থাকা অবস্থায় তিনি গভর্নর হাউসে বসে থাকতেন না। বাঙালি নারী নেত্রীদের সঙ্গে মিশে তিনি বহু কাজ করেছেন নারী সমাজের উন্নতির জন্য। বাংলার চিত্রশিল্পীদের ভিকারুননিসা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ঢাকায় সেকালে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজকও ছিলেন। বেইলি রোডের ভিকারুননিসা নূন স্কুলটি তিনি তারই নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
স্যার ফিরোজ খান তার এক স্মৃতিকথায় লিখেছেন, জওহরলাল নেহেরু ভিকারুননিসার জুতা কুড়িয়ে ওর পায়ে পরিয়ে দিয়ে কোনো বিপদে পড়েননি, বরং প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা যদি বিপরীত হতো? নেহেরু যদি পিন্ডি আসতেন। বেগম নেহেরু বা তার কন্যা ইন্দিরার জুতা আমি যদি তাদের পায়ে পরিয়ে দিতাম? পাকিস্তানের নেতারা আমাকে ছিঁড়ে ফেলত।
বছর খানেকের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফিরোজ খান নূন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তাকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। পরে আইয়ুব তার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, আমার দুঃখ যে একজন ভালো মানুষের নিকট থেকে আমাকে ক্ষমতা নিতে হয়েছে।
এখানে শহীদ আফ্রিদির কি কোন শঙ্কা ছিল? তিনি বাঙ্গালির জুতা কুড়িয়ে পায়ে পরিয়ে দিয়ে পাকিস্তান গিয়ে জনরোষে পড়ার চিন্তা করেননি তো? যে আশঙ্কা নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুন। যদি সে আশঙ্কা থেকে তিনি জুতা পরানো থেকে বিরত থেকে থাকেন তাহলে এক কথায় বলতে হয়, এ কারণেই পাকিস্তান দিন দিন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে।
আর যদি তিনি খেয়ালের ভুলে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ মিস করে থাকেন-তাহলে এ পর্বে আমরা তাকে আর তুলোধুনো করতে চাইনা। তবে এটুকু বলবো- তিনি বিশ্বমানের ক্রিকেটারের পাশাপাশি নিজেকে বিশ্বমানের নিরহংকারী মানুষ হিসেবে পরিচিত করার মোক্ষম সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছেন।
একজন খোলোয়াড়ের পক্ষে নিজের কেড্স নিজে পরে নেয়া সম্ভব হয় না। খেলার মাঠকে ঘিরে থাকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা। বাইরের কোনো লোকও খেলার মাঠে প্রবেশ করতে পারেন না। খেলোয়াড়রাই একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমি আগেই বলেছি, গত বছর অষ্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি এক ক্রিকেটার আফ্রিকার একজন ব্যাটসম্যানের জুতার ফিতা বেঁধে দিয়েছিলেন। সে নিরিখে বলতে গেলে সাকিবের জুতা কুড়িয়ে আফ্রিদি অবশ্যই প্রশংসিত হয়েছেন- এটি আমি অস্বীকার করছি না। আফ্রিদি জানতেন, এ জুতা পরতে সাকিবকে কারো না কারো সাহায্য নিতে হবে। সে সাহায্যটুকু আফ্রিদি নিজেই করতে পারতেন। কারো পায়ে জুতো পরিয়ে দিলে কেউ ছোট হয়ে যায়- এ কথা নিছক ছোট লোক ছাড়া কেউ বলবে না।
আজকে আমাদের সমাজে অহংকারের ছড়াছড়ি। দুই পয়সার ক্ষমতা পকেটে থাকলে অহংকারের ভারে চারিদিকে তাকানোর ইচ্ছে জাগে না। সালাম দেয়াতো দূরের কথা, নেয়ার মানসিকতাও থাকেনা। মাথা নিচু করে হাঁটেন। চারিদিকে তাকালে কোন অলক্ষীর অবয়ব দর্শন করতে হয় কিনা-সে সংশয় তাড়া করে এসব অহংকারীদের।
মানুষের আবার কিসের অহংকার। জওহরলাল নেহেরুর মত বিশ্বমানের পন্ডিত মানুষ যদি কারো পায়ে জুতা পরিয়ে দিতে পারেন- তাহলে সমাজের দুই পয়সার ক্ষমতাবানদের এত অহংকার কিসের? আমরা কি শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে-গুণে, অর্থ সম্পদ বা ক্ষমতার বিবেচনায় জওহরলাল নেহেরুকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছি? তা অবশ্যই নয়।
আজকে সমাজে এক শ্রেণির অহংকারের ভারে মানবতা যেন পালিয়ে বেড়াতে শুরু করেছে। সবকিছুকেই বাণিজ্যিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কাউকে সম্মান করতে হলে- তিনি অর্থ, বিত্ত ও ক্ষমতায় আমার থেকে বড় কিনা, আগে সেটি হিসেব করা হচ্ছে। আজকাল অনেকেই নিজের চেয়ে অধম কাউকে সম্মান করে নিজের জাত নষ্ট করতে চান না। এটাই হলো অংহকারের মাপকাঠি।
সম্প্রতি সহকর্মী একজন সম্পাদকের বাসায় গিয়েছিলাম। তার পুত্র একটি বেসরকারি স্কুলে প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বড় হয়ে তুমি কি হবে? সে জবাবে বলল, বড় হয়ে মানুষ হব। ছোট এ শিশুর জবাবে আমি বিস্মিত হয়েছি।
আমরা নিজেদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। মানুষ হবার পরিবর্তে আমরা নিজেদেরকে ধন-দৌলত, গাড়ি-বাড়ি, টাকা-পয়সা উপার্জনের মেশিন বানিয়ে ফেলেছি। যার কারণে সমাজ থেকে দিন দিন মনুষত্ব হারিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: কলামিস্ট, সম্পাদক দৈনিক রূপসী লক্ষ্মীপুর।