বছরের শেষদিনে আস্ত তিনটা ধাক্কা দিয়ে বাঙালির জীবণ থেকে বিদায় নিল বাংলা ১৪২২ সন। রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে হঠাৎ হালকা দুলুনি। খানিক বিরতি দিয়ে দুদফায় তীব্র ঝাঁকুনি প্রায় সারাদেশে। এতে চট্টগ্রাম ও ফেনীতে বেশ কয়েকটি ভবন হেলে পড়ে। চট্টগ্রামে আতঙ্ক ও হুড়োহুড়িতে অন্তত ৫০ জন আহত হয়। ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের কয়েক জায়গায় আহত হয় আরো অন্তত ৪৫ জন। এর ক’দিন আগ থেকে প্রকৃতিতে দেখা দেয় চরম খামখেয়ালিপনা। চৈত্রের দাবদাহের মাঠ অভিনবভাবে দখল করে নেয় শীতার্ত পরিবেশ। কদিনের মধ্যে আবার চেপে বসে ভ্যাপসা গরম। এ রকম অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক ধরা পড়ে রডের বদলে বাঁশ দিয়ে ভবন নির্মাণের ঘটনা। এর মাঝেই হানা দিল ভূমিকম্প।
বাংলাদেশ বরাবরই ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল। বাংলাদেশের অবস্থান বড় ফল্ট লাইনের আশপাশে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল্ট লাইন ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের ধাক্কায় তৈরি হয়েছে। যার কারণে আমরা হিমালয় পর্বতমালা পেয়েছি এবং সেখানে গত বছরের ভয়াবহ নেপালের ভূমিকম্প হয়েছে। সেটা খুবই সাবধানে বাংলাদেশকে এড়িয়ে তার উত্তর দিক দিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে দক্ষিণে নেমে গেছে। ফল্ট লাইনটি বাংলাদেশের যথেষ্ট কাছ দিয়ে গেছে এবং সেখানে বড় ভূমিকম্প হলে আমরা বাংলাদেশে বসে সেটা খুব ভালভাবেই টের পাব, নেপালের ভূমিকম্প, মণিপুরের ভূমিকম্প এবং সম্প্রতি মিয়ানমারের ভূমিকম্পের জের আমরা সেটা দেখেছি। দ্বিতীয় কারণে বড় ফল্ট লাইন ছাড়াও ছোট ছোট এমনকি অজানা ফল্ট লাইনও থাকতে পারে যেগুলো আমাদের মাঝেমধ্যে কাঁপাতে পারে।
সেদিনের ভূমিকম্প আতঙ্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রসহ মোট তিনজন অসুস্হ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভূমিকম্পের সময় এবং এরপর প্রায় দুই ঘণ্টা দেশের বেশির ভাগ মোবাইল অপারেটরের সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মোবাইল ফোন-নির্ভর বেশির ভাগ সেবা ভূমিকম্প -পরবর্তী দুই ঘণ্টা বিঘ্নিত হয়।
দেশে ইমারত কাজে ভালো ইট বালু সুরকির ব্যবহার কমে গেছে। তার ওপর রয়েছে কমিশন ভাগাভাগি। এই ভাগ মেলাতে গিয়ে ঠিকাদার, প্রকৌশলী, স্থানীয় হোমড়াচোমড়ারা ভাগ মেলান। যার কারণে হয়তোবা সেটি এখন বাঁশ দেয়ার পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। রাজধানীর পাশের জেলা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সদ্য তৈরি করা এক স্কুলে ফাটলের খবর। গত অর্থবছরে এটি নির্মাণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর বা এলজিইডি। ৩৭ লাখ টাকায় ভবন নির্মাণের কাজ করেছেন ঠিকাদার মো. জুয়েল মিয়া। উদ্বোধনের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সূচি নির্ধারণের আগেই খসে পড়া শুরু হয় ভবনের আস্তর।
স্থানীয়রা দেখতে পান এক তলা ভবনের পিলার, মেঝে, দেয়াল, ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে ফাটল। পরে তাড়াহুড়া করে ঠিকাদারকে দিয়ে ফাটল ঢেকে দেন এলজিইডির কর্মকর্তারা। কিন্তু উদ্বোধনের কয়েক দিন যেতে না যেতেই দেখা যায় সেই ফাটল। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রকৌশলী ও ঠিকাদারের যোগসাজশেই নিম্নমানের কাজ হয়েছে। কারণ, নির্মাণের সময়ই নানা অনিয়মের বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ করেছিলেন। তবে তা আমলে নেওয়া হয়নি। কিন্তু উদ্বোধনের আগে ধসে পড়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভূমিকম্প হওয়ার কথা উল্লেখ করে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠায় উপজেলা এলজিইডি অফিস।
কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই সরকারি টেন্ডারের কাজে দুর্নীতি চলে ওপেন সিক্রেট। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের এ যৌথ অপকর্মই যেন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে গত মাসের শুরুতে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা পৌর ভবনের পাশে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কার্যালয়ের নতুন পাঁচ তলা ভবনের নির্মাণকাজ উদ্বোধন হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জয় ইন্টারন্যাশনাল আড়াই কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। কিন্তু ৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে ঢালাই করতে দেখতে পায় স্থানীয়রা। নির্মাণাধীন ভবনের পাশের বাড়ির মালিক পরান মিয়া, নাহিদ পারভেজসহ এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে গিয়ে হাতেনাতে ধরে ফেলেন ঠিকাদারের লোকজনকে।
পরে উত্তেজিত জনতা ঢালাই ও পিলার ভেঙে ফেলে। বন্ধ করে দেওয়া হয় নির্মাণকাজ। গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। অবশ্য ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ঠিকাদার কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা ষড়যন্ত্রের শিকার। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গায় রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড়ের মধ্যেই উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের মেঘডুমুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শৌচাগার নির্মাণের ঢালাইয়ে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার হাতেনাতে ধরে ফেলে এলাকাবাসী। এ ধরনের জোচ্চোরদের শাস্তি হয় না। শাস্তির বদলে পুরষ্কারই পায়। ইস্পাতের কাজ বাঁশ দিয়ে করার কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাদেরকে পদার্থবিজ্ঞান শাখায় পদকও দেয়া হয় কি-না কে জানে ?
তারওপর জলাভূমি ভরাট করে এবং নরম মাটির এলাকায় যেসব বহুতল ভবন হয়েছে, সেখানে দুলুনি বেশি অনুভূত হয়েছে। তাই ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে এবং জলাভূমি ভরাট না করে ভবন তৈরি করলে আতঙ্ক ও ক্ষতি দুটোই কম হবে। সরকারি নির্মাণকাজে যে ভীষণ রকম চুরি চলেছে যুগের পর যুগ ধরে, ওই বাঁশের ছবি তা স্পষ্ট করে তুলেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঠিকাদার-প্রকৌশলী মিলে যে ভবন বা সড়ক বা সেতু বানানো হয়, তার মান খুবই খারাপ। বিল্ডিংগুলো বছর যেতে না যেতেই ঝুরঝুর করে ঝরতে থাকে, দরজা-জানালা খুলে যেতে থাকে। পিচঢালা পথ ঘেয়ো কুকুরের পিঠের মতো হয়ে যায়, খোয়া বেরিয়ে আসে। পুকুরচুরি বললেও কম বলা হয়।
জাতিসংঘের ভূতাত্তিক জরিপে বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ বা ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি দেশের মধ্যে চিহ্নিত বাংলাদেশও। ভূমিকম্পের মাত্রা ৭-এর ওপরে উঠলে বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানীর পুরান ঢাকার স্থাপনাগুলো চুরমার হয়ে যাবে এমন অনেক গবেষণা প্রতিবেদন আমরা দেখেছি। ভূমিকম্প নিয়ে মানুষের মধ্যে বাড়াবাড়ি আছে, আতঙ্কও আছে। কিন্তু সচেতনতা নেই বললেই চলে। হিসাবে দেখা যায়, এই ভূমিকম্পে বাংলাদেশে যত মানুষ মারা গেছে তারা কেউ ভূমিকম্পের কারণে মারা যায়নি, মারা গেছে ভূমিকম্পের ভয়াবহ আতঙ্কে ! ভূমিকম্প শুরু হলে মানুষজন চারতলা বাসা থেকে নিচে লাফ দিয়ে ফেলে। বলা হয়ে থাকে, ভূমিকম্পের সময় টিকে থাকার প্রথম বিষয়টাই হচ্ছে মাথা ঠান্ডা রাখা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভয় পেলে মাথা ঠান্ডা রাখা যায় না। যিনি অন্যদের মাথা ঠান্ডা রাখার বুদ্ধি বাতলে দেন, ভূমিকম্প এলে তিনি মাথা গরম করে ছুটাছুটি করেন সবার আগে। আমাদের যে প্রতিরোধ, উদ্ধার প্রক্রিয়া ও জনসচেতনতা, পূর্ব প্রস্তুতি যা থাকা দরকার, তা বলতে গেলে প্রায় শূন্য। পুরান ঢাকায় এমন কিছু বাড়ি রয়েছে যা শুধু চুন-সুরকিতে নির্মিত। এমন গলি আছে যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দূরে থাক একসঙ্গে দু’জন মানুষের যাওয়াই দুষ্কর। এই যখন অবস্থা, তখন দুর্ঘটনায় কি হবে- তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
নেপালের মতো বাংলাদেশে কোনো ভূমিকম্প হলে আমাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ঢাকা শহরের যে অবকাঠামো তাতে এটা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হবে। ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের এ শহর ধ্বংস হয়ে যাবে। শহরের নিচে জালের মতো বিছিয়ে আছে গ্যাস আর পানির লাইন। আছে বিদ্যুতের লাইনও। ভূমিকম্প হলে গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইনে আগুন ধরে ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। তখন অবস্থা এমনও হতে পারে যে, তখন হয়তো এ শহর পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হতে পারে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে, যে কাজের জন্য যে ভবন অনুমোদন দেয়া হল, সেই কাজে তা ব্যবহার হচ্ছে কিনা, আবাসিক ভবনে গার্মেন্ট কারখানা হল কিনা ইত্যাদি নজরে রাখতে হবে। বাংলাদেশের ভেতর এবং পাশাপাশি কিছু ফল্ট (ভূমিকম্প উৎপত্তি স্থান) রয়েছে যেখান থেকে যে কোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। আমাদের দেশ ও আশপাশের ভূ-গঠন বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া এলাকা এবং মৌলভীবাজার এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা।
ভারত ও বার্মার প্লেট আমাদের দেশের ভেতর দিয়ে গেছে। এর সংযোগ ফল্টও আরেকটি ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এ ফল্টটা ঢাকা শহরের আরও কাছে। দেশের বাইরে অতি সন্নিকটে ডাউকি ফল্ট। গত দুই থেকে আড়াইশ’ বছরে এ এলাকায় বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। এর আগে যখন এ স্থানে ভূমিকম্প হয়েছে, তখন ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। ডাউকি ফল্টের পূর্বাংশে গত ৫ থেকে ৭শ’ বছরে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। এর মানে হচ্ছে, সেখানে শক্তির সঞ্চার হচ্ছে। হিমালয় থেকে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার এলাকা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ১৯৯৩ সাল থেকে নেপাল ভূমিকম্পের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের চেয়েও নেপাল ভালো অবস্থানে রয়েছে। সিকিম-ভুটানে গত ১০ লাখ বছরে কোনো ভূমিকম্প হয়নি। এদের প্রস্তুতির দরকার নেই।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের ভূমিকম্প মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে। ভূমিকম্পের জন্য আমাদের এসব উৎসস্থল চিনে রাখতে হবে এবং কোনটা কতটা ভূমিকম্পপ্রবণ সেটা মাথায় রেখে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। তাই ক্ষতি রোধে পূর্বপ্রস্তুতির মধ্যে সর্বাগ্রে আসে ভবন ‘কন্সট্রাকশন অ্যান্ড ডিজাইন’ যথাযথ হওয়ার বিষয়টি। এটা সঠিক না হলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব নয়। মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার বিষয়টি মাথায় রেখে তাই টেকসই ভবন গড়ে তুললে অন্তত ৯০ শতাংশ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ভূমিকম্পের সময় ভবনের নিরাপদ জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘ভবনের কলাম’। কিন্তু রাজধানীর ভবনগুলোর কলামও অত্যন্ত নিম্নমানের করে তৈরি করা হচ্ছে। তাই ভবনের কলাম তৈরির নির্মাণ সামগ্রীর যথাযথ ব্যবহারের প্রতিও যত্মবান হওয়া দরকার। ভবন তৈরির সময়ে নকশা অনুসরণ, নির্মাণ সামগ্রীর যথাযথ ব্যবহার, সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে নির্মাণ কাজের যথাযথ মনিটরিং, এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার জনবল ও সার্বিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
ভূমিকম্প কখন হবে কেউ বলতে পারে না। এটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিষয় নয়। তাই কেউ এর আভাস দিতে পারে না। এ কারণে ভূমিকম্প প্রতিরোধ কথাটাই অবান্তর । যদিও হরহামেশাই শোনা যায় কথাটি। প্রতিরোধ আর প্রতিকার হচ্ছে ভূমিকম্পের পর। অর্থাৎ ঘরবাড়ি তৈরি করার সময়ই ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় রাখা। কিন্তু আমরা কি সেটার ধারে-কাছেও আছি ?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
বিবার্তা/মহসিন