আজ তিন বছর! ছেলেটা এখনো ঘরে ফেরে না। কাজ থেকে ফিরে তড়িঘড়ি করে মাকে ডেকে খাবার দিতে বলে না। মা রেঁধে বসে থাকেন ঠিকই কিন্তু ছেলে ফেরে না। হয়তো ফিরবে না আর কোনোদিন। কোনোদিনই না!
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ধর্মকুল গ্রামের হোসেন আলীর ছেলে সুরুজ নিখোঁজ হয়েছে আজ তিন বছর। তিন বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার উপকন্ঠে সাভার বাসস্ট্যান্ডে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন রানা প্লাজা ধসের পর নিখোঁজ হন তিনি। স্মরণকালে ভয়াবহতম ওই ট্র্যাজেডিতে সেদিন এক হাজার ১৩৮ জন পোশাক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। এখনো নিখোঁজ রয়েছে ১৮২ শ্রমিক। আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন আরো প্রায় দু হাজার ।
জীবিত না হোক অন্তত লাশটুকু পেলেও সান্ত্বনা পেতেন সুরুজের মা জোসনা বেগম। কিন্তু তাও জোটেনি তার ভাগ্যে। হতভাগিনী মা এখনও শোকে পাগলপ্রায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের কোণায় এবং কপালে ঘাঁ হয়েছে। বেওয়ারিশ হিসেবে ৩১৮টি লাশের কবর দেওয়া হয়েছে রাজধানীর জুরাইন কবর স্থানে। ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সুরুজের কবরটুকুর সন্ধ্যান পাবেন এ আশায় বুক বেঁধে ছিলেন জোসনা বেগম। কিন্তু ডিএনএ রিপোর্ট পাওয়ার পর সে আশাতেও গুঁড়েবালি।
অসহায় এ পরিবারটি এখনো পাননি কোনো সরকারি বা বেসরকারি আর্থিক সহায়তা। সুরুজের চাকরির পরিচিতি সংক্রান্ত সব তথ্য সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দিয়েও মেলেনি নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ। ফলে একদিকে ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর মা জোসনা বেগম, অন্যদিকে আর্থিক অসচ্ছল পরিবারটি নিদারুণ কষ্টের দিনাতিপাত। পরিবারজুড়ে এখনও চলছে বোবা কান্না।
২৪ এপ্রিলের ওই ঘটনা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। এ ঘটনায় শুধু বাংলাদেশই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিলো গোটা বিশ্ব। এই ঘটনাটিকে বিশ্বে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ভয়াবহ এ ট্রাজেডিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের মুখে অনেক আশার বাণী শোনা গেলেও তা আজো নিরাশার অন্ধকারে ঢাকা। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে যে কজন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন তা নিতান্তই নগন্য।
ভয়াবহ এ ঘটনার জন্য প্রথম অবস্থায় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মামলা করার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। শুধু তাই নয়, শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য তিন দফায় কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের কথা ছিল। তারও কোনো অগ্রগতি হয়নি।
যে তিনটি দফায় আন্দোলন করার কথা ছিলো সেগুলো হচ্ছে প্রথম অবস্থায় রাজপথে আন্দোলন, এর পর জনমত সৃষ্টি ও আইনি লড়াই। এগুলোর সব কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনাও করেছিল শ্রমিক সংগঠনগুলো। কিন্তু পরে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির দাবি বাস্তবায়ন ও রাজনীতির তীব্র ঝড়ে সবার দৃষ্টি চলে যায় সেদিকে। ফলে এর কোনোটিই বাস্তবায়ন করতে পারেনি শ্রমিক সংগঠনগুলো। এর পরেও ক্ষতিগ্রস্তরা যেটুকু পেয়েছেন এটি শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনেরই ফসল।
আমরা মাত্র নয় মাসে একটা দেশ স্বাধীন করেছি। অথচ আজ তিনবছরেও রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন করতে পারিনি। পারিনি যারা অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে আছেন তাদের পুনর্বাসন করতে। পারিনি নিখোঁজদের মায়েদের কাছে ছেলে/মেয়ের লাশের কবরটা কোথায় তা দেখিয়ে দিতে, পারি নি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানাগুলো চিহ্নিত করে শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে।
রানা প্লাজা ধসে হাজারো মৃত্যুর পাশাপাশি সুরুজদের মত নিখোঁজেরা আমাদেরকে ডেকে বলছে ভবন ধসের মতো দুর্যোগে আমরা কতটা বিপদাপন্ন। এরই মধ্যে এই অঞ্চলে বড়সড় ভূমিকম্প হয়ে গেছে। আমাদের ঘুম কিন্তু ভাঙেনি। ভবন আইন বাস্তবায়নের তোয়াক্কা করছি না আমরা! বরং সরকার বলছে আমরা যে কোন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত! রানা প্লাজা ছিল জেগে ওঠার ডাক। সে ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙেনি। আদৌ কি কোনদিন ভাঙবে?
লেখক: সাংবাদিক