প্রতি বছরের মত আবারও এসেছে মহান মে দিবস। আজ থেকে ১২৮ বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে শ্রমিকেরা অধিকার আদায়ের জন্য যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তা দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাদের কর্মক্ষেত্রে কাজের অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, মজুরি এবং দৈনিক সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নির্ধারণে সহায়তা করেছিল। তখন থেকে অনেক দেশে দিনটি শ্রমিকশ্রেণি কর্তৃক উদযাপিত হয়ে আসছে।
শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় এত ঢাকঢোল পেটানো, এত আয়োজন হলেও সত্যিকার অর্থে কতটা মুক্তি পেয়েছে বিশ্বের খেটে খাওয়া, ঘাম ঝরানো শ্রমিক সম্প্রদায়-এ প্রশ্ন খুব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে পৃথিবীবাসীর সামনে। শ্রমিকের মুক্তির নামে পেটানো ঢোলের বয়স ১০০ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এতে ঢোলেরই যা ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে। আজও শ্রমিক আঠারো ঘণ্টা কাজ করে মরে কারখানার ধোঁয়া আর কালিতে। অল্প বয়সে রোগে আক্রান্ত হয়ে ধুকে ধুকে মরে এই শ্রমিকেরা। বিনিময়ে কি পায় তারা? কতটুকু মর্যাদা পায়?
বর্তমান সময়ের শ্রমিকরা হয়ত শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার পেয়েছে, পেয়েছে মে দিবসের ছুটিতে গালভরা কিছু বুলি আওড়ানোর জন্য সভা সেমিনার করার সুযোগ। কিন্তু এগুলোতে তাদের কোন লাভ হচ্ছে কি?
একদিকে শ্রমিকদের অধিকার দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন করার, আন্দোলন করার, অপরদিকে দ্রব্যের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করতে মালিককে চাপে ফেলা হচ্ছে। মালিকরা যদি শ্রমিক ইউনিয়নের চাপ, অসহোযোগ আন্দোলন, লকআউট ইত্যাদির কারণে তাদের দাবি দাওয়া মেনেও নেয়, মজুরি বৃদ্ধিও করে তাতেও কোনো লাভ নেই। কারণ যাতায়াত ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ার কারণে শ্রমিকের মজুরি দু’ টাকা বাড়লে ব্যয় বাড়ে দশ টাকা। এভাবেই আবর্তিত হয় শোষণের চক্র, ঘুরে ফিরে আসে ‘মে’ দিবসের প্রহসন।
আজও শ্রমিকরা কল-কারখানায় আগুন লেগে, ভবন ধসে, কলে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করে।দেশ বিদেশের বড় বড় সংস্থা ও কর্তৃপক্ষগুলো কাগজ কলমে ৮ ঘণ্টা কাজ দেখালেও বাস্তবে শ্রমিকদের দিনে আঠারো ঘণ্টা খেটে মরতে হয়। এতকিছুর পরেও মালিকদের আরাম আয়েশ আর বিলাসিতাকে আরো নিচ্ছিদ্র করতে ছাটাই করা হয় সাধারণ শ্রমিকদের।
তাহলে কি দিলো এই দিবস? সভ্যতার গর্ব যে অবকাঠামো, দালান কোঠা, চোখ জুড়ানো নান্দনিক স্থাপত্য, সেতু;কার শ্রম দিয়ে গড়া এই সব? যার শ্রমে গড়া সেই শ্রমিকের নাম কি খুঁজে পাওয়া যায় কোথাও? একবারও কি কেউ তার কথা উচ্চারণ করেন?
তাই বার বার মে দিবস এসে মনে করিয়ে দিয়ে যায় শ্রমিকের না পাওয়ার কথা, বঞ্চনা আর শোষণের কথা, তাদের বুকে পা দিয়ে নতুন যুগের উত্থানের কথা। অন্য দিবসগুলোর মত আজও কিছু ব্যক্তি বক্তব্য বিবৃতি দেবেন, শ্রমিকদের মুক্তির সুশ্রবণীয় কাব্যিক বাণী শোনাবেন। টকশো মাতাবেন বুদ্ধিজীবীর দল। প্রেসক্লাবে হবে গোলটেবিল-সেমিনার। কিন্তু শ্রমিকের মুক্তি এবং শ্রমের মর্যাদা কি সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা পাবে? শ্রমিকের রক্তে গড়া বড় বড় অট্টালিকায় বসবাসকারীরা কি আপসে তাদের ভোগবিলাস পরিত্যাগ করে, অন্যায়- অন্যায্য নীতিকে বর্জন করবেন?
লেখক: সাংবাদিক