শহর-নগরের সকল প্রসাদপম অট্টালিকার প্রতিটি ইটের গাঁথুনিতে শ্রমিকের রক্ত, ঘাম মিশে আছে। ভদ্রভাবে সমাজের চলার জন্য আমাদের পথকে মসৃণ করেছে সমাজের সবচেয়ে বেশি অনাদর, অবহেলায় কাটানো মানুষগুলো। আজকে যে সভ্যতায় বাস করে নিজেদেরকে মূল্যবান দাবি করছি, সেই সভ্যতার স্রষ্টাও স্বয়ং শ্রমিক।
শ্রমিকের শ্রম না থাকলে থেমে থাকতো কালের চাকা, ভেঙ্গে যেত সভ্যতা। যাদের অবদানে আমাদের প্রতিটি সকাল হয়ে উঠল রঙিন সেই শ্রমিকগুলো সমাজ ও রাষ্ট্রে কতটুকু মুল্যায়িত হচ্ছে তা কি ভেবেছি কখনো?
ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার আগেই যে মানুষগুলো শহরের সকল আবর্জনা শহর থেকে বহুদূরে ফেলে আসে সেই মানুষগুলোর ক্ষুধার খবর রেখেছি কখনো? গাছতলা কিংবা বস্তিতে বাস করলেও ওরাও ক্ষুধার্ত হয় আমাদের মতো করে, ওদেরও একটা দেহ আছে যে দেহ আমাদের দেহের মত বিলাসী না হলেও একটুখানি বিশ্রাম চায়, ওদেরও যেহেতু মান আছে কাজেই আত্মসম্মানবোধও রয়েছে, যা আমাদের আত্মসম্মানবোধের মতো এত বৃহৎ না হলেও একেবারে সস্তা নয়-সেই মানুষগুলোকে নিয়ে আমরা কতটুকু ভেবেছি?
যারা আমাদের সকল কষ্ট-ব্যথা প্রশমিত করে দেয়, তাদের ক্ষুদ্র-বৃহৎ কষ্টগুলো আমাদেরকে কি একটুও কষ্ট দেয়? অথচ মানুষ হিসেবে অনুভব করা উচিত ছিল। এ সমাজে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব শাসক ও শোষিতের দ্বন্দ্বের ন্যায়। একদল ঘোষণা দিয়ে অত্যাচার করে যাচ্ছে আরেকদল অসহায় হয়ে কেবল পিষ্ট হচ্ছে।
শ্রমিকের শ্রমকে লুট করে, তাদের রক্ত চুষে একদল অঢেল সম্পত্তির মালিক হচ্ছে কিন্তু পাহাড়সম ধন তৈরিতে যারা ব্যবহৃত হচ্ছে তারা দু’বেলা আধপেট খাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে কি? রাষ্ট্রের সংবিধানে সকল মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের কথা বলেছে অথচ শিক্ষা, চিকিৎসার অধিকার থেকে গরীবেরা আজও বহুদূরে।
গরীব শ্রমজীবিদের জন্য আইন ভিন্ন না হলেও তার প্রয়োগ ভিন্ন। একদলের এঁটো উচ্ছিষ্টটুকু গ্রহণের জন্যই বোধহয় তাদের জন্ম! ক্রমশ মানুষ সচেতন হচ্ছে। আজও যদি গরীবের অধিকার ফিরিয়ে না দেয়া হয় তবে গরীবের জাগরণ, শ্রমিকের আন্দোলনে চুরমার হয়ে যাবে রক্তচোষার অট্টালিকা, নড়বড়ে হবে রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা।
দারিদ্র্যতা রাষ্ট্রের জন্য ততটা ভয়ংকর নয়, যতটা ভয়ংকর মানুষে মানুষে বিশাল বৈষম্য। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য যত প্রকট হবে সংঘাতও তত নিকটবর্তী হবে। দেড়শ বছর পূর্বে ঘোষিত ৮ ঘন্টা কাজের অধিকার আজও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি মানছেন না। শ্রমিকদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে ১০-১২ ঘন্টা কাজ করতে।
এবার যখন জাগরণ হবে তখন প্রভূদের অবস্থান মিলিয়ে যাবে ধূলোর সাথে। কাজেই বুদ্ধিমানদের সাবধান হতে হয় পূর্ব লক্ষণে দেখে। শ্রমিকের ক্ষোভ দিন দিন প্রকট হচ্ছে। প্রতিদিনই রাষ্ট্রের কোথাও না কোথাও তাদের দ্বারা ধর্মঘট আহুত হচ্ছে এবং পালন হচ্ছে জোরালোভাবে। এগুলো ভালো লক্ষণ নয়।
শ্রমিককে তার ন্যায্য অধিকার দিতে হবে অনতিবিলম্বের। কর্মস্থলে নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার সাথে সাথে নিশ্চিত করতে হবে সময়ের সাথে সাযূজ্য সম্মানী। ভালো থাকুক, আমাদের সকল শ্রমজীবীরা, বোধোদয় হোক মালিক পক্ষের। দূর হোক, মালিক শ্রমিকের ব্যবধান।
রাজু আহমেদ । কলামিস্ট ।