অটিজম সম্পর্কে বাংলাদেশে সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী অনেকাংশে নেতিবাচক। অনেকে বিষয়টিকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলেও মনে করে। অটিজম শব্দটি গ্রিক শব্দ অটোস থেকে এসেছে এর অর্থ স্বয়ং বা স্বীয় বা নিজ। আর ইংরেজি অটিজম এর বাংলা অর্থ আত্মসংবৃতি বা মানসিক রোগবিশেষ। এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিজেদেরকে গুটিয়ে রাখে। এজন্য এটিকে অটিজম নামকরণ করা হয়েছে।
অনেকেই অটিজমকে সিজোফ্রেনিয়া বলে ভুল করেন। ১৯৪৩ সালে আমেরিকার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লিও ক্যানার সর্বপ্রথম মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে রোগটি শনাক্ত করেন এবং অটিজম শব্দটি ব্যবহার করেন। দ্য আমেরিকান হেরিটেজ ডিকশনারি অব দ্য ইংলিশ ল্যাগুয়েজ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী অটিজম হলো শিশুর বিকাশজনিত অসমর্থতা, যার বৈশিষ্ট্য হলো সামাজিক মিথস্ত্রিয়া ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রবল ঘাটতি এবং ক্রিয়াকলাপ ও মনোযোগের চরম সীমাবদ্ধতা এবং পুনরাবৃত্তি নির্দিষ্ট কিছু আচরণ। অটিজম নামক এই ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডারটি সাধারণত জন্মের প্রথম তিন বছরে প্রকাশ পায়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ, সামাজিক আচরণ, সামাজিক কল্পনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশ সমস্যা লক্ষণীয়।
নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ এ অটিজম সম্বন্ধে বলা আছে- যার মধ্যে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর মধ্যে এক বা একাধিক লক্ষণ পরিলক্ষিত হবে, তারা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি বলে বিবেচিত হবেন, যথা- (ক) মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা (খ) সামাজিক ও পারস্পরিক আচার-আচরণ, ভাব বিনিময় ও কল্পনাযুক্ত কাজ-কর্মের সীমাবদ্ধতা (গ) একই ধরনের বা সীমাবদ্ধ কিছু কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি (ঘ) শ্রবণ, দর্শন, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ, ব্যথা, ভারসাম্য ও চলনে অন্যদের তুলনায় বেশি বা কম সংবেদনশীলতা (ঙ) বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধীতা বা খিঁচুনি (চ) এক বা একাধিক নির্দিষ্ট বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা এবং একই ব্যক্তির মধ্যে বিকাশের অসমতা (ছ) চোখে চোখ না রাখা বা কম রাখা (জ) অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা উত্তেজনা অসংগতিপূর্ণ হাসি-কান্না (ঝ) অস্বাভাবিক শারীরিক অঙ্গভঙ্গি এবং (ঞ) একই রুটিনে চলার প্রচণ্ড প্রবণতা।’
বর্তমানে সারা বিশ্বে অটিজম নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। এ সমস্যার প্রকৃত কারণ এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করতে পারেননি। কেউ কেউ মনে করেন, অটিজমের পিছনে দু'টি কারণ রয়েছে, ১. জিনগত সমস্যা ও ২. পরিবেশের বিষাক্ত উপকরণ। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ডিএনএ জিনে কপি নম্বর অব ভেরিয়েন্ট নামক ত্রুটি বহন করে। পরিবেশের বিষাক্ত উপকরণ জিনের ওপর কাজ করে স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে। যেসব রাসায়নিক দ্রব্য অটিজমের জন্য দায়ী তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মার্কারি, লেড, পেস্টিসাইড; গর্ভাবস্থায় মা ধুমপান করলে, এলকোহল বা ক্ষতিকর ঔষধ খেলে অটিস্টিক শিশুর জন্ম হতে পারে।
বাংলাদেশে অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য পূর্ণাঙ্গ কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ২০১০ সালে ঢাকার মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অটিজম রিসোর্স সেন্টার এবং ২০১১ সালে অটিস্টিক স্কুল খোলা হয়েছে। ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর নিউরোডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিল্ড্রেন’ খোলা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে শিশু বিকাশকেন্দ্র এবং দেশের সব জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি করে অটিজম কর্নার খোলা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অটিজম রোগীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। অটিস্টিক শিশুদের উন্নয়নে সোসাইটি ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব অটিস্টিক চিলড্রেন (ঝঙডঅঈ) এর কার্যক্রম প্রশংসিত হলেও এখানে শিক্ষা ব্যয় খুবই বেশি যা নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে বহন করা অসম্ভব। সুইড বাংলাদেশের ৪৮টি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুলেও অটিস্টিক শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে অটিজমসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে বিভিন্ন সেবা ও সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এগুলোর সংখ্যা খুবই কম।
গবেষকদের গবেষণায় এটা নিশ্চিত যে, অটিজম নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুকে শৈশবে যথাযথ যতœ দেওয়া গেলে প্রাপ্তবয়সে তার যথেষ্ট উন্নতি হয়। জন্মের ১৮ থেকে ৩৬ মাস বয়সের মধ্যে অটিজম শনাক্তকরণ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুকে সঠিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিতে শিক্ষাদান করা গেলে অনেকাংশে সুস্থ করা যায়। অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসার নির্দিষ্ট ঔষধ নেই। অটিজমের প্রধান চিকিৎসা নিওরোবিহেভিওরাল থেরাপি। শিশুর সাথে এমন আচরণে ব্রেনের উন্নতি হয় এবং শিশুর অটিস্টিক উপসর্গগুলো লোপ পায়। যেমন: ১. অটিস্টিক শিশুকে সামাজিক করতে হবে; ওদের নিজের জগত থেকে বাইরে আনতে হবে; একা থাকতে দেওয়া যাবে না। শিশুকে বাসার বাইরে পরিবেশের সাথে ধীরে ধীরে খাপ খাওয়াতে শেখালে তার মধ্যে একটু একটু করে পরিবর্তন আসবে। বাইরে এসে শিশু অস্থিরতা দেখাবে, বিরক্ত হবে, উত্তেজিত হবে, রাগারাগি করবে কিন্তু এগুলোতে নজর দেওয়া যাবে না। ২. অটিস্টিক শিশুরা কথা বলে না, আবার কেউ কেউ দু'বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলে, তারপর ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়। এর চিকিৎসা হলো শিশুকে একটা একটা করে শব্দ শেখানো। অনেক ধৈর্য ধরে চেষ্টা করতে হবে। যেমন- শিশুর হাতে একটা খেলনা 'বল' দিয়ে নাম ধরে বলতে হবে। এভাবে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে চেষ্টা করলে সে একটা একটা করে কথা বুঝতে শিখবে। ৩. অটিস্টিক শিশুরা তাদের হাত দিয়ে একটা নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে খেলতে পছন্দ করে। এটা করতে না দিয়ে বরং তার দু'টো হাত দিয়ে পিকচার পাজল খেলা খেলতে দিতে হবে। সিদ্ধ ডিমের খোসা ছিলতে দেওয়া বা শিশুদের হাত দিয়ে যেসব মজার খেলা আছে ঐগুলো খেলতে দেওয়া বা ছড়া বলার সাথে সাথে হাত দিয়ে অভিনয় করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাহলে তার হাত দু'টো কার্যকর হাতে পরিণত হবে। এটাকেই বলে অকুপেশনাল থেরাপি। এই চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা এবং অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজএবিলিটি বাংলাদেশের উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এশীয় দেশগুলোতে অটিজম নিয়ন্ত্রণে পাশ্চাত্যের মডিউল ও থেরাপির ওপর নির্ভরশীলতার পরিবর্তে নিজস্ব পদ্ধতি উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অটিজম বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।
২০১১ সালের ২৫ জুলাই বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অটিজম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’ বিষয়ক ‘ঢাকা ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে অটিজম ও শিশুর অন্যান্য বিকাশজনিত সমস্যা সমাধানে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ২০১৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি South Asian Autism Network দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া, ২০১৩ সালের ৩০ মে WHO -এর নির্বাহী পরিষদে অটিস্টিক শিশুর জন্য "সর্বাত্মক ও সমন্বিত উদ্যোগ" নামে একটি প্রস্তাবের অনুমোদন দেওয়া হয়। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও সৌদি আরবসহ ৫০টি দেশ সমর্থন দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সায়মা ওয়াজেদ এর আন্তরিকতার কারণে অটিজম বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এমনকি কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন।
আমাদের দেশে অটিজমের ভয়াবহ খারাপ দিক হলো- সচেতনতার অভাব, চিকিৎসা বিভ্রাট ও অপচিকিৎসা। অটিজম সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবে চিকিৎসকরা একে জটিল মানসিক ব্যাধি মনে করে থাকেন। ফলে চিকিৎসার পরিণতি অটিস্টিক শিশুর স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। গ্রামের, অশিক্ষিত দরিদ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগোষ্ঠী অপচিকিৎসা ও প্রতারণার শিকার হয়। প্রতারকরা অটিজমকে জিন-ভুতের আক্রমণ বলে ঝাড়ফুঁক ইত্যাদির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়। শিক্ষিত ও সচেতন পরিবারের পিতামাতা অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসায় অনেক ব্যয় করে এক সময় হতাশায় ভোগেন। এসব শিশুর চাহিদা পূরণের জন্য জাতীয়ভাবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। অটিস্টিক শিশুকে যদি ঠিকভাবে পরিচালনা করা যায় তবে শিশুটি সমাজের অন্য শিশুদের মতো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে না পারলেও স্বাবলম্বী হতে পারবে। এখন প্রয়োজন অটিস্টিক শিশুদের জাতীয় মূলধারায় সম্পৃক্ত করা ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভালোবাসা-সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসা, পাশাপশি প্রয়োজন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।