ইদানিং একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, প্রিন্ট মিডিয়ার দিন নাকি ফুরিয়ে আসছে। মুদ্রিত সংবাদপত্র বলে নাকি আর কিছু থাকবে না।
আমি মুদ্রিত সংবাদপত্রের কর্মী, কাগজের মানুষ। তাই ‘খবরের কাগজ বলে আর কিছু থাকবে না’- এ ধরনের ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ শুনে আতঙ্কিত না-হয়ে পারি না। আমি নিশ্চিত জানি, তেমন দিন আসার আগেই এই পৃথিবী ছেড়ে আমাকে অনন্তের পথে যাত্রা করতে হবে। কিন্তু তবুও এক অজানা অস্বস্তিতে মন ছেয়ে যায়। কাগজবিহীন, বই ও সংবাদপত্রবিহীন পৃথিবী ! মনে হয় যেন মানুষ ফিরে যাবে আদিম প্রস্তর যুগে।
আমার আতঙ্কের কথা জেনে ‘ভবিষ্যদ্বক্তারা’ আমাকে অভয় দেন : আরে না, না! বই, খবরের কাগজ সবই থাকবে। তবে তা কাগজে ছাপা হবে না। থাকবে ডিজিটাল বই, অনলাইন নিউজপেপার। সেই সংবাদপত্রে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর আপডেট হবে। এক দিনের ‘পুরনো’ সংবাদপত্রের বদলে প্রত্যেক ঘণ্টায় নতুন সংবাদপত্র। ভালো না!
ভালো তো বটেই। পুরনোর বদলে নতুনকে খারাপ বলে কার সাধ্য? ঘণ্টায় ঘণ্টায় ‘নতুন’ সংবাদপত্র পাওয়া তো ভাগ্যেরই ব্যাপার। তবে ...
তবে, আমার মনে পড়ে আরব্য রজনীর রূপকথার আলাদীনকে। পুরনো চেরাগের দৈত্যকে দিয়ে তিনি দীনহীন অবস্থা থেকে ক্রোড়পতি হয়েছিলেন। বিয়ে করেছিলেন রাজকন্যাকে। দিনও কাটাচ্ছিলেন সুখেই। কিন্তু আলাদীন সুখে থাকলে কি হবে, সেই যাদুকর ছিলেন ভীষণ দুঃখে। পুরনো চেরাগটা তার চাই-ই চাই। তাই আলাদীনের অনুপস্থিতিতে এক দিন ফেরিওয়ালার বেশে যাদুকর হাজির রাজপ্রাসাদের সামনে। মুখে হাঁক : পুরনো চেরাগের বদলে নতুন চেরাগ ...। আলাদীনের রাজকন্যা-স্ত্রী ভাবলেন, ওই যে পুরনো চেরাগ, ওটা দিয়ে নতুন একটা পেলে তো বেশ হয়। যেই ভাবা সেই কাজ। আর পুরনো চেরাগ যাদুকরের হাতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাশার দান উল্টে গেল। কোথায় গেল আলাদীনের প্রাসাদ, কোথায় রাজকন্যা স্ত্রী! সবই উধাও।
কিন্তু আমি ডিজিটাল যুগের সঙ্গে রূপকথা মেলাচ্ছি কেন? ডিজিটাল যুগে রূপকথার ভাত নেই। তবে এই রূপকথাটির শিক্ষাটি সব যুগে সত্য। তা হলো পুরনো হলেই অচল হয় না (রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, পুরনো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে)। আবার এটাও সত্য, নতুনের জন্য পুরনোকে চিরকালই জায়গা ছেড়ে দিতে হয়।
তাহলে কি আমি মেনে নিচ্ছি যে, মুদ্রিত সংবাদপত্রের দিন শেষ! এবার চলবে ডিজিটাল সংবাদপত্র ? জবাব দেয়ার আগে একটা ব্যক্তিগত ঘটনা বলে নিই।
অল্প কিছুদিন আগে ঢাকার একটি অনলাইন সংবাদপত্র থেকে অনুজপ্রতিম এক সাংবাদিক এসেছিলেন আমার কাছে। তারা বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। আমাকেও একটি সাক্ষাৎকার দিতে হবে। শুনে আমি মনে-মনে চমকে যাই। সাক্ষাৎকার দেয়ার মতো ‘মহাজন’ ব্যক্তি আমি-যে কখনও নই, এই সাধারণ জ্ঞানটি অন্তত আমার আছে। তাই অপারগতার কথা জানাই। কিন্তু কাজ হয় না।
আমাকে এখানেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যত কি। আমার মনে দ্রুত কতগুলো ছবি ভেসে ওঠে। বিশ্বের অনেক প্রাচীন ও নামী-দামী সংবাদপত্র প্রিন্ট ভার্সন চিরকালের জন্য বন্ধ করে দিয়ে অনলাইনে চলে গেছে। তাহলে প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যত তো সত্যিই অন্ধকার। পর মুহূর্তেই আমার মনে হয়, ভবিষ্যত অন্ধকার বটে, তবে সেটা ভবিষ্যতেরই বিষয়। বর্তমানের নয়, নিকট-ভবিষ্যতেরও নয়। আমি প্রশ্নকর্তাকে বলি, এক সময় পৃথিবীতে রাজত্ব করতো বিশালদেহী প্রচণ্ড শক্তিধর ডাইনোসর! তারা আজ নেই। হয়তো এক দিন মুদ্রিত সংবাদপত্রও থাকবে না। তবে সেই দুর্দিন অত্যাসন্ন নয়, হনুজ দূর অস্ত - অনেক দূরে। এতো দূরে যে, ‘ভবিষ্যত’ বলতে আমরা মনে মনে সময়ের যে দূরত্বটা এঁকে নিই, তারও পরে।
কেন এতো দূরে ভাবছি, সেটার ব্যাখ্যা আমি দিইনি। কিন্তু আমি জানি, মানুষের পাঠস্পৃহা যতদিন থাকবে, মুদ্রিত সংবাদপত্র, সংখ্যায় কম হলেও, থাকবেই। অনলাইন সংবাদপত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্ঞাতি ভাই। তা ‘পড়তে’ হয় চেয়ার টেবিলে বসে, কম্পিউটার অন করে। মুদ্রিত সংবাদপত্র বা খবরের কাগজ পড়া যায় বিছানা বা সোফায় শুয়ে বা আধশোয়া হয়ে। পড়া যায় রিকশায় যেতে-যেতেও। অল্প কদ্দুর পড়ে ভাঁজ করে হাতে কিংবা প্যান্টের পকেটে গুটিয়েও নেয়া যায়। এসবই প্রায় চোখে না-পড়ার মতো বটে, কিন্তু অসামান্য সুবিধা, যেগুলো অনলাইন এখন পর্যন্ত দিতে পারছে না।
‘শুয়ে বসে হাঁটতে হাঁটতে পড়ার সুবিধা’র যুক্তিগুলো তুচ্ছ-হাস্যকর ও খেলো শোনাচ্ছে বটে, তবে শারীরবৃত্তীয় কারণেই মানুষ নিজের অজান্তেই এসবে অভ্যস্ত। যতক্ষণ সুবিধাটি তারা পাচ্ছে ততক্ষণ তারা এর উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন নয়। সুবিধাটি অপসৃত হলেই কেবল বোঝা যায় যে এই একটি সুবিধা ছিল।
আমার বিশ্বাস, সংবাদপত্রের ভবিষ্যত বিপণ্ন হয় যদি, তবে তা হবে মূলত মানুষের পাঠাভ্যাস অন্তর্হিত হওয়ার কারণে। দিনের পর দিন টেলিভিশনের পর্দার দিকে জন্মান্ধ মাতালের মতো হা করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমাদের পাঠাভ্যাস যে হারিয়ে গেছে, তা-ই মূলত মুদ্রিত সংবাদপত্রের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। মুদ্রিত সংবাদপত্র একজন মানুষ পড়ে, না-পড়তে চাইলে ভাঁজ করে পাশে রেখে দেয়, কিন্তু না-পড়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাবার মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে না। এই অর্থহীন তাকিয়ে থাকার সুবিধাটি কিন্তু অনলাইনে পূরো মাত্রায়ই আছে। আমি অনেককে দেখেছি, তারা অনলাইন সংবাদপত্রগুলো দেখে, কিন্তু পড়ে মুদ্রিত কাগজগুলো।
মানুষ শুধু-যে জানার জন্য পড়ে, এমন নয়। পড়ারও একটা আনন্দ আছে। সেই আনন্দের জন্যও পড়তে চায় মানুষ। সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের বর্ণিল দৃশ্য দেখার যে ‘অর্থহীন’ অথচ পবিত্র অনুভূতি, সেই অনুভূতি থেকেও পড়ে মানুষ। ডিজিটাল সংবাদপত্রও পড়তেই হয়, তবে কাগজে ছাপা সংবাদপত্র বা বই পড়ার যে আনন্দ মানুষ গত কয়েক শ’ বছর ধরে পেয়ে আসছে, যা তাদের মননে-মজ্জায় মিশে গেছে, সেটা এতো দ্রুত, এতো সহজে বদ্লে যাবে, এমনটা এই মুহূর্তে অন্তত ভাবাটা বোধহয় ঠিক হবে না।
আমার মতো যারা মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভক্ত, তাদের ভরসার জায়গা এটুকুই। যতদিন পড়ার আনন্দ থাকবে, সত্যিকার পাঠক থাকবে, মুদ্রিত সংবাদপত্র ততোদিন থাকবেই, সংখ্যায় যতো কমই হোক না কেন। কারণ মুদ্রিত সংবাদপত্র শুধু পাঠকের জন্য, আর অনলাইন সংবাদপত্র পাঠক ও দর্শকের জন্য।
অতএব সংবাদপত্র, অর্থাৎ মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যত নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আবার এক শ’ বছর পর কী হবে, সেটা নিয়েও এখনই মাথার চুল ছেঁড়ার প্রয়োজন নেই। ওমর খৈয়াম তো কয়েক শ’ বছর আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন : দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক!
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক