মধুমাস শব্দের অর্থ ‘চৈত্র মাস’। কিন্তু বাংলাদেশি মিডিয়ায় আশির দশক থেকে ‘জ্যৈষ্ঠ মাস’ অর্থে শব্দটির ঢালাও ব্যবহার শুরু হয়েছে। এ কারণে শব্দটি তার মূল অর্থ ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে। ধারণা করা হয়, জ্যৈষ্ঠ মাসে আম, জাম, কাঁঠালসহ একাধিক মিষ্টি ফল পাকে বলেই প্রয়োগকারীরা ভুলবশত ধরে নিয়েছেন, মধুমাস মানেই জ্যৈষ্ঠ মাস।
অথচ মধুমাস আসলে চৈত্র মাস। দৌলত উজির বাহরাম খানের কাব্যে তার সাক্ষ্য মেলে: ‘মধুমাসে উতলা বাতাস, কুহরে পিক; যদি সে কমল শিশিরে দহল কি করিব মধুমাসে।’ এখানে তিনি চৈত্র মাসের কথাই বলেছেন। কারণ জ্যৈষ্ঠ মাসে তো আর কোকিল ডাকে না। অভিধানগুলোতেও কোথাও মধুমাস বলতে জ্যৈষ্ঠ মাস বোঝানো হয়নি। কিন্তু মিডিয়ার দাপটে অভিধানগুলো অসহায়।
প্রাচীন কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্তীও চৈত্র মাস অর্থেই মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘মধুমাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ। মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।’
কবিকঙ্কণচণ্ডীও চৈত্র মাস বা বসন্তকাল অর্থে মধুমাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন ‘মধুমাস আপায় মাধব পরশে।’ আপায় মানে ‘গত হয়’।
খনার বচনেও মধুমাস বলতে চৈত্র মাসকেই বোঝানো হয়েছে:
‘মধুমাসে প্রথম দিনে হয় যেই বার
রবি শোষে মঙ্গল বর্ষে, দুর্ভিক্ষ বুধবার।
সোম শুক্র শুরু আর
পৃথ্বী সয় না শস্যের ভার ॥
পাঁচ শনি পায় মীনে
শকুনি মাংস না খায় ঘুণে।’
অর্থাৎ চৈত্র মাসের প্রথমদিন রবিবার হলে অনাবৃষ্টি, মঙ্গলবার হলে বৃষ্টি, বুধবার হলে দুর্ভিক্ষ হয়। সোম, শুক্র আর বৃহস্পতিবার হলে প্রচুর শস্য এবং চৈত্র মাসে পাঁচ শনিবার হলে মড়ক হয়। শনির অবস্থাভেদে চৈত্র মাসের ফল সম্পর্কে খনা আরো বলেছেন:
‘মধুমাসের ত্রয়োদশ দিনে যদি রয় শনি।
খনা বলে সে বৎসর হবে শস্যহানি ॥’
একাধিক সিনিয়র সাংবাদিক বলেছেন, সর্বপ্রথম দৈনিক বাংলাই জ্যৈষ্ঠ মাস অর্থে মধুমাস শব্দটি চালু করেছে। বর্তমানে দেশের পত্রপত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ মাস নিয়ে কোনো কিছু লিখতে গিয়ে লেখা হয় ‘মিষ্টি ফলের রসে ভরা মধুমাস’। এভাবেই জ্যৈষ্ঠ মাসের সঙ্গে মধুমাস বিশেষণটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
মধু শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে বসন্ত বা বসন্তকাল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে তার সাক্ষ্য পাওয়া যায়: ‘আজি মধু সমীরণে নিশীথে কুসুম বনে তাহারে পড়িছে মনে বকুল তলে।’ অথবা ‘আজি উন্মাদ মধুনিশি ওগো চৈত্রনিশীথশশী। তুমি এ বিপুল ধরণীর পানে কী দেখিছ একা বসি চৈত্রনিশীথশশী।’
মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ বসন্ত অর্থেই ‘মধু’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন: ‘নাদিল দানব-বালা হুহুঙ্কার রবে, মাতঙ্গিনী-যূথ যথা মত্ত মধুকালে।’
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ আর ও জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে’ মধুমাস বলতে চৈত্র মাস বলা হয়েছে। একই মতের সপক্ষে বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে অজস্র প্রমাণ। যেমন:
‘কত মধুমাস আসি গেল হাসি হাসি কলিকার মুখ চাহিয়া’- বিজয় মজুমদার।
‘সখা, সেই অতিদূর সদ্যোজাত আদি মধুমাসে তরুণ ধরায় এনেছিলে যে কুসুম ডুবাইয়া তপ্ত কিরণের স্বর্ণমদিরায়’- বসন্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘কী জ্যোৎস্নাপাশ, কী পুষ্পসৌরভের ডোর, কী মুকুলিত মধুমাসের মধুর মলয়ানিলের বন্ধন’- আশ্রমপীড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘এমত নহে যে, একেবারে বায়ু বহিতেছিল না, মধুমাসের দেহস্নিগ্ধকর বায়ু অতি মন্দ- একান্ত নিঃশব্দ বায়ু মাত্র, তাহাতে কেবলমাত্র বৃক্ষের সর্বাগ্রভাগারূঢ় পত্রগুলি হেলিতেছিল, কেবলমাত্র আভূমিপ্রণত শ্যামা লতা দুলিতেছিল; কেবলমাত্র নীলাম্বরসঞ্চারী ক্ষুদ্র শ্বেতাম্বুদখণ্ডগুলি ধীরে ধীরে চলিতেছিল’-কপালকুণ্ডলা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর ‘বঙ্গীয় সমার্থকোষ অভিধানে’ বলা হয়েছে, ‘চৈত্র মাসকে কেন মধুমাস বলা হয়, তার কারণ জানা যায় ‘বসন্ত’ শব্দ থেকে। দুধের থেকে সর, সর থেকে ঘোল-মাখন হয়ে ঘি-এ পৌঁছানো যায়। সেই সুবাদে মধু হলো ঘি। ঠিক সেইরূপ বৈশাখ থেকে বসবাস ও বর্ষের শুরু এবং তার চূড়ান্ত হয় বসন্তে। সেই বসন্তের শেষ মাস হলো চৈত্র মাস। গ্রহণ-বর্জন-পুনরুৎপাদনের নীতিতে চলা মানবজীবনের জৈবিক সার্থকতা পুনরুৎপাদনে। বসন্তের অন্তে বা চৈত্র মাসে মানুষের প্রতিপালন প্রাচীন শব্দবিদগণের অখণ্ড চিন্তাশৃঙ্খলার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সেই কারণে তারা চৈত্র মাসকে মধুমাস নাম দিয়েছিলেন।’
হিন্দিতে ‘বাহারী’ মানে মধুকাল বা মধুমাস। আবার ‘বাহারকে দিন’ মানে বসন্তকাল। অন্যদিকে ফারসিতে ‘বহার’ মানে বসন্তকাল, ‘বহারী’ অর্থ বাসন্তী বা বসন্তকাল সম্বন্ধীয়।
কবি ও প্রাবন্ধিক সাযযাদ কাদির তাঁর ‘ভুলে-ভুলে নির্ভুল’ প্রবন্ধে বড়ই আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘ফাল্গুন এসেছে, এরপর আসবে চৈত্র। চৈত্র মাসকে জানি মধুমাস নামেও। বরাবরই জানি। অভিধানেও লেখা আছে তা-ই। সেই পঞ্চাশের দশকে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ও গেয়েছেন ‘ভ্রমরা গুন-গুন গুঞ্জরি আসে... কেঁদো না কেঁদো না এই মধুমাসে...।’ তবুও জ্যৈষ্ঠ মাস এলে আমাদের দু-তিনটি পত্রিকা মেতে ওঠে মধুমাসের বন্দনায়। বড় বড় শিরোনাম করে ‘মধুমাস জ্যৈষ্ঠ মাস এসেছে...।’ এ অবস্থায় এখন মোটামুটি সবাই জেনে গেছেন জ্যৈষ্ঠ মাসই মধুমাস। যদি বলি, ‘না, চৈত্র মাস মধুমাস... তাহলে আমার সীমাহীন মূর্খতায় অনেকে হাসাহাসি করেন, অনেকে অগ্রাহ্য করেন, অনেককে অভিধান খুলে দেখালেও তা উপেক্ষা করেন বিরক্তির সঙ্গে।’
কবি সাযযাদ কাদিরের মতো বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন অনেকেই। কারণ অধিকাংশ সাংবাদিক এখন মানতেই চান না, মধুমাস মানেই চৈত্র মাস। এতে আর যাই হোক, অভিধানের সত্যও হারিয়ে গেছে। হালের লেখক আর সাংবাদিকের মনভূমিতে যে সত্যের উদয় হয়েছে তাকেই সবাই মেনে নিয়েছেন অথবা বলা যায়, মানতে বাধ্য হচ্ছেন। পুরো ব্যাপারটি ভুল জেনেও শীর্ষ পত্রিকাগুলোও এখন আর বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হয় না।
তাই অভিধানের মধুমাস অভিধানে কালো অক্ষরে শোভা পায়। আর লোকমুখে জ্যৈষ্ঠই এখন আসল মধুমাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও গৃহীত হয়ে গেছে। অথচ এটা কারোরই অজানা নয় যে মধু থাকে ফুলে, ফলে নয়।
বাংলা ঋতুতে ফাল্গুন-চৈত্র মাসই বসন্তকাল। এ সময় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় বাংলার প্রকৃতি। চারদিকে চোখে পড়ে সবুজের বিশাল ক্যানভাস। শীতের জড়তা কাটিয়ে প্রকৃতি নতুন করে জেগে ওঠে। আর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হচ্ছে গ্রীষ্মকাল। বলা যায়, বসন্তের ফুল ফলে পরিণত হয় গ্রীষ্মে এসে।
অভিধান মতে, ফাল্গুন ও চৈত্র মাস মিলে হয় বসন্তকাল। আবার মধু বলতেও এই বসন্তকালকেই বোঝায়। অন্যদিকে বসন্তের সখা কোকিলের আরেক নাম হচ্ছে ‘মধুসখ’।
সাংবাদিক আমির খসরু সেলিম ‘মধুমাস জ্যৈষ্ঠ’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ভরদুপুরেও সূর্যের চারদিকে মেঘের দল উড়ছিল। একটু বৃষ্টিও হয়েছিল। ক্ষণিকের দমকা বাতাসের ঝাপটায় সেই মেঘেরা কোথায় পালাল! তারপর সূর্য ছড়াতে লাগল উত্তাপ। ভেজা মাটি থেকে উঠে আসা জলীয় বাষ্প সেই উত্তাপকে আরও উষ্ণ করে তোলে। সেই উত্তাপ কারো জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনছে। নতুন বছরের নতুন ধান কেটে, শুকিয়ে গোলায় তুলছে বাংলার কৃষক। সোনালি ধান কাটার পর গ্রামের পথগুলোতে এখন খড় শুকানোর পালা। গবাদিপশুর খাবার হিসেবে সেই খড় বিশেষ কায়দায় ‘পালা’ বেঁধে রাখা হবে যেন দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যায়। দরদর করে ঘামঝরা ক্লান্তি দূর হয়ে যায় গাছের পুরুষ্টু কাঁঠালের দিকে তাকালেই। গাঢ় সবুজ আমের শরীরে সিঁদুরের ছোপ লাগতে শুরু করেছে। পেকে ওঠা লিচুগাছ ঘিরে দিনের বেলা পাখি আর রাতের বেলা বাদুড়ের কোলাহল বেড়ে ওঠে। সবকিছু যেন মনে করিয়ে দেয়, এটি মধুমাস। বাংলা বছরের দ্বিতীয় মাস জ্যৈষ্ঠ। বাহারি আর পুষ্টিকর সব ফলের প্রাচুর্য এই সময়টিকে দিয়েছে মধুমাসের মহিমা। আম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুল, তরমুজ, পেয়ারাসহ আরও নানান বাহারি ফলের স্বাদ আর রঙের ছোঁয়ায় বাঙালির রসনা তৃপ্ত হয় এ মাসে।’
সাবলীল কাব্যিক বর্ণনা। তবে বাংলা অভিধানগুলো মধুমাস হিসেবে জ্যৈষ্ঠ মাসকে কবে যে ঠাঁই দেবে, সেটা জানার সুযোগ এখনও আমার হয়নি।
সাংবাদিক-গবেষক আবদুশ শাকুর তাঁর ‘তোর ওই কুহুতান’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদের মনের নির্জ্ঞান স্তরেও ফুল আর ফাগুন একাকার হয়ে বিরাজ করে। পঞ্জিকার বারো মাসের রানী ফাগুন মাস যেন ফুল ফোটাতেই আসে। আসেই তো। মধুমাস চৈত্র হয়ে মধুমাধব বৈশাখ মাসের বৃক্ষচূড়ায় আগুন ধরানো কৃষ্ণচূড়া পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যে-পুষ্পোৎসব, তার উদ্বোধন তো ফাল্গুনের শিমুল-কিংশুকরাই করে থাকে।’
অন্যদিকে কবি সুভাষ মুখোপ্যাধ্যায় জ্যৈষ্ঠ মাস স্মরণে ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’ লিখেছিলেন, এটা কেউ কি দাবি করতে পারবেন? বরং এটা বলা যাবে তিনি বসন্তকাল বা মধুমাস স্মরণে এটা লিখেছেন।
তারপরও স্রেফ মিডিয়ার কারণে মধুমাস বলতে আগামী প্রজন্ম জ্যৈষ্ঠ মাসকেই চিনবে, চৈত্র মাসকে চিনবে না। অবশ্য শব্দ আর সরকারের একটি অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘অবনমন’। সময়ের ব্যবধানে শব্দের অর্থের অবনতি হতেই পারে। বাংলার আধুনিক ‘মধুমাস’ তারই প্রমাণ। তাই এখন আর মধুমাসের আভিধানিক অর্থ মনে করিয়ে দিয়ে লাভ নেই। ওটা যে এখন গবেষকদের কাজ! আমরা যারা ম্যাঙ্গো-পাবলিকের কাতারে, তারা যৌক্তিকভাবেই দাবি করব, ‘শব্দের ব্যুৎপত্তি দেখে শব্দের অর্থ নির্ধারণ করার সুযোগ কোথায় হে পণ্ডিতপ্রবর? ভুল ধারণার কারণে শব্দের মানে পাল্টে যাবার একমাত্র নমুনা কি শুধু মধুমাসেই?’
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক