লালন ফকির শতাধিক বছর আগে লিখে গেছেন ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না। আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা।’ প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, নিজেকে জান (know thyself)। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য এমন একটি পথ খুঁজে বের করতে হবে যা অন্যদের জন্যও ভাল হবে।
সক্রেটিস মনে করতেন, ভাল জীবনযাপনের জন্য আমাদেরকে নৈতিক উৎকর্ষ এবং মহত্ব বলতে কি বুঝায় তা বুঝতে হবে। তাঁর মতে, নৈতিক উৎকর্ষই জ্ঞান (virtue is knowledge)। তিনি আত্মজ্ঞানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
আমরা প্রত্যেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তবে নিজেকে চিনি না। আমরা শুধু অন্যের ভুল ধরি বা ছিদ্রান্বেষণ করি। খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে আমরা নিজেকেই চিনছি না। অপরকে নিয়ে ভাববার সময় নেই। নিজে নানা দোষে দুষ্ট অথচ অপরের সমালোচনা করে তিক্ততার সৃষ্টি করে সমাজে অশান্তি বাড়াচ্ছি।
প্রতিটি ধর্মে ও রাজনৈতিক দর্শনে মানব সেবার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আমরা সেটাও করছি না। অপর মানবের ভালমন্দ নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আমি শুধুই আমার চিন্তায় মশগুল। আমি ধর্মের কথা বলি কিন্তু তা মানি না। ধর্মের অনুসারী হয়েও ধর্মের বিধিবিধান মানি না। আমি রাজনীতি করি কিন্তু সেই দলের যে রাজনৈতিক আদর্শ সেগুলোর কোন কিছুই মানি না।
একইভাবে ব্যবসায়ী অতিমুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মিশ্রণের মতো জঘন্য কাজ করে। চিকিৎসক চিকিৎসার নামে মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করে। শিক্ষক শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে টাকা কামায়। প্রকৌশলী দুর্নীতি করে অর্থবিত্ত বানিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করে। রাষ্ট্রের টাকা চুরি করে অফিসার বিত্তবান হয়।
নৈতিক উৎকর্ষ ও মহত্ব ক্রমান্বয়ে নয় দ্রুত বিদায় নিচ্ছে। আত্মজ্ঞান অনুপস্থিত। ভাল জীবনযাপন বলতে আমরা এখন বুঝি, নিজে বা নিজের পরিবারের সদস্যরা আরাম আয়েশে থাকা। দূরাত্মীয় ও প্রতিবেশীরা কেমন আছে সেসব ভাবার সময় বা প্রয়োজন নেই।
আমাদের মধ্যে আরও একটি খারাপ বিষয় ক্রমান্বয়ে বাসা বাঁধছে, তা হলো: আমি সব কিছু জানি এবং বুঝি। অন্যরা বোকা। তারা কিছু জানে না এবং বোঝে না। অথচ সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন ভুল করা হলো অজ্ঞতার পরিণতি। যিনি এ ভুল করেন তার চেয়ে অন্য কেউ বেশী জানে না। তিনি বলেছেন, ‘শুধু আমিই জানি না, আমি কিছুই জানি না’ (I only know that I know nothing)। তাঁর মতে, ‘জ্ঞান হলো ভালবাসা নির্ভর একটি শিল্প কৌশল- যাকে সাধারণভাবে বলা যায় জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা।
আমি কি করছি? তা কি বৈধ বা আইনসিদ্ধ? আমি যা করছি তাতে কি অন্যের ক্ষতি হচ্ছে? আমি যা করছি তা কি দেশের জন্য মঙ্গলকর? আমার বিবেক কি বলে?
বিবেক বা মন যদি আমার কাজকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয় তা হলে আমার কাজ সঠিক বলে ধরে নিতে পারি। আর যদি বিবেক বলে কিছু না থাকে তা হলে আমি কি মানুষ? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাকেই খুঁজতে হবে। এভাবে নিজেকে নিজে চিনে নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে দু’টি উদাহরণ দিয়ে আমি আমার লেখা শেষ করছি। আমার মহল্লার মসজিদের ইমাম সাহেবকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। একজন কৃষকের দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। কৃষক রেখে গেছেন প্রায় ১১ একর জমি। তার মৃত্যুর পর মেয়েটি মুসলিম সম্পদ বন্টনানুযায়ী জমির হিস্যা পাননি বা বোনটির ভাই দুটি তাকে ঠকিয়েছে। বোনের যা প্রাপ্য সেই পরিমাণ জমি তাকে দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে দুই ভাই তাদের বোনের ‘হক’ নষ্ট করেছে।
ইমাম সাহেব উত্তরে বললেন, অপরের হক বিনষ্টকারীর ইবাদত-বন্দেগী কোন কাজে আসবে না। আমি ইমাম সাহেবকে বললাম ওই হক নষ্টকারী ভাই দু’জন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা (সত্য ঘটনা)। যে দলটি সৎ লোকের শাসন কায়েম করতে চায়। তারা চায় ইসলামী আইন বা শরিয়া আইন!
একজন স্কুল শিক্ষক স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ করে বাড়িজমি করেছেন। তিনিও স্বাধীনতার কথা বলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে বক্তৃতাবাজি করেন! আমাদের নৈতিক উৎকর্ষের জ্ঞানের শিক্ষা নিতে হবে। অন্যথায় সকলকে আশান্তির অনলে পুড়তে হবে।
বিবার্তা/জিয়া