সংকট উত্তরণে বিকল্প প্রস্তাব

সংকট উত্তরণে বিকল্প প্রস্তাব
প্রকাশ : ২৩ জুন ২০১৬, ১৯:৫৮:৩৩
সংকট উত্তরণে বিকল্প প্রস্তাব
সুনীল শুভরায়
প্রিন্ট অ-অ+
বসিরউদ্দিনের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায়। বর্তমান ঠিকানা - ঢাকার ফুটপাত। বাসস্থান - পলিথিনের ছাপড়া। চার সন্তানসহ পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছয়। 
 
বসির রিকশা চালায়। তার বউ ঝি-এর কাজ করে। ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় দুটি কাগজ কুড়ায়, কখনো কখনো ভুট্টার খইয়ের প্যাকেট বিক্রি করে। ছোট বাচ্চা দুটিকে ভিখারী মহিলাদের কাছে ভাড়া দেয়। এরা বাচ্চা দুটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কাঁধের ওপর ঘুম পাড়িয়ে রেখে ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষা করে। দুই বাচ্চা ভাড়া দিয়ে বসির গড়ে প্রতিদিন এক শ’ টাকার মতো পায়। বড় দু’টার চেয়ে ছোট দু’টার আয় বেশি।
 
বসিরউদ্দিন ঢাকায় আসতে বাধ্য হয়েছে। গঙ্গাচড়ায় থাকলে না খেয়ে মরে যেতে হতো। নিজের চাষের জমি নেই। বছরে তিন মাস কাজ করতে পারতো, বাকি সময় বেকার। বেকারত্বের সময় সে কী খাবে, পরিবার-পরিজনকেই বা কী খাওয়াবে? 
 
রংপুরে কাজের সুযোগ তেমন নেই। বাঁচার তাগিদে যখন ঢাকা এসেছিলো তখন ছিলো তার দুই বাচ্চা। সে সময় ছোটটাকে ভিক্ষার জন্য ভাড়া দিয়ে লোভে ধরেছে। আরো যদি বাচ্চা থাকে তাহলে আয় বেশি। সেই হিসাবে বসিরের আরো দুই বাচ্চা। এখনো বউয়ের বয়স আছে। আরো বাচ্চা হতে পারে। 
 
বসির যেখানে থাকে সেখানে সে শুধু একা নয়, তার মতো আরো পরিবার আছে। সবাই লাইন দিয়ে ফুটপাতে থাকে।
 
এভাবেই পরিত্যক্ত অনাবাদী জমিতে  জন্মানো আগাছার মতো ঢাকা শহরে মানুষ জন্মাচ্ছে। প্রতিদিন ঢাকা শহরে মানুষ বাড়ছে। নিপোর্টের হিসাব অনুসারে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ১৩৬ জন মানুষ ঢাকা শহরে এসে বসবাস করতে থেকে যাচ্ছে। 
 
থাকবে না কেন? দেশের যা কিছু ভালো তার সবই তো ঢাকায়। ভালো স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি, হাসপাতাল, ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবী, এমনকি ভালো কোচিং সেন্টারগুলোও ঢাকায় অবস্থিত। ৮২টি সরকারি- বেসরকারি ভার্সিটির মধ্যে ৬০টি ঢাকায়। ৩৮টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৩২টি ঢাকায়। এখানে যারা পড়তে আসে তারা পাস করে কোথায় যাবে ? ঢাকাতেই থেকে যায়। যারা চাকরি নিয়ে একবার ঢাকা আসেন, তারাও যে কোনো প্রকারে ঢাকাতেই স্থায়ী হয়ে যান। এভাবেই ঢাকায় লোকসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৪০ শতাংশ হলেও ঢাকায় এই বৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ।
 
দুই বছর আগে নিপোর্টের হিসাব অনুসারে ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। এখন ঢাকায় যে হারে লোক বাড়ছে, এটা চলতে থাকলে ১০ বছর পর লোকসংখ্যা হবে আড়াই কোটি। এই রাজধানী শহরের যে আয়তন তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ লোক স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারে। সেখানে এখনই এক কোটি অতিরিক্ত মানুষ বাস করছে। দশ বছর পর আরও এক কোটি যোগ হলে কোথায় দাঁড়াবে তারা ?
 
আমাদের দেশ তো প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। হঠাৎ হয়তো একটা ভয়ঙ্কর ঝড় উঠলো। সে সময় ফুটপাতে বাসকারী বসিরউদ্দিনরা কি ফুটপাতে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে, নাকি দেয়াল টপকাতে বাঁচার জন্য অট্টালিকায় ঢুকে পড়বে ? ঢুকে তো দেখবে অন্তত দুই হাজার স্কয়ার ফুট ফ্ল্যাটে তিন/চার জন বাসিন্দা স্বর্গসুখ ভোগ করছে। তখন বসিরউদ্দিনরা যদি বলে বসে, একই দেশের নাগরিক আমরা, তোমরা চার জন থাকবে দুই হাজার স্কয়ার ফুটের মধ্যে, আর আমরা দাঁড়ানোর জন্য দুই ফুট জায়গাও পাবো না - তা তো হবে না। ঝড়ের তাড়ায় একবার যখন ঘরে ঢুকে পড়েছি, আর বের হবো না। তখন কি করা যাবে? দারোয়ান ডেকে বের করে দেবে? এক দারোয়ান কয় হাজার বসিরউদ্দিনকে তাড়াতে পারবে? কি করবে তখন? পুলিশ ডাকবে? পুলিশ ক’জনকে আটকাবে?
 
অপেক্ষা করুন, ঢাকার অবস্থা সেদিকেই যাচ্ছে। বাড়িওয়ালারা ভাবছেন, যত লোক বাড়বে তত ভাড়া বাড়বে। কিন্তু অর্থনীতির কলেবর তো বাড়ছে না। ভাড়াটিয়ারা যদি কখনো বলতে বাধ্য হয়, আর ভাড়া দিতে পারবো না। পারো তো বাড়ি থেকে বের করে দাও। ঢাকা শহরের সব ভাড়াটিয়াকে কি আইন দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া যাবে? মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যাবে, তখন সামনে অগ্রসর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। 
 
এই ঢাকা শহরে যখন বের হতে হয়, তখন কেমন আরামবোধ করেন? দশ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে দুই-আড়াই ঘণ্টাও কেটে যায়। গাড়ির চাকা ঘুরতে পারে না। বর্তমানে ঢাকা শহরের মধ্যে রাস্তাঘাটে যতটুকু জায়গা আছে, তাতে শহরের মোট যানবাহনের অর্ধেকও একসাথে নামতে পারবে না। তারপরেও প্রতিদিন গড়ে ১৮০টি গাড়ির নতুন রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। এগুলো শহরের যানবাহনের সাথে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে। তার মধ্যেই মানুষকে ঢাকায় আসতে হয়। কারণ অফিস, আদালত, এমনকি বড় বড় গার্মেন্টসগুলোও ঢাকা শহরের মধ্যে। একটা টিউবওয়েলের বরাদ্দ নিতে কিংবা একজন পিওনের বদলির জন্যেও ঢাকা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একটা সার্টিফিকেট সত্যায়িত করতেও সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নির্ধারিত অফিসারের কাছে যেতে হয়।
 
কেন ঢাকা শহরে এতো মানুষ ? সামান্য একটা হিসেবেও বোঝা যাবে। এই যেমন রিকশাচালক বসিরউদ্দিনের কথা। অনুমান করা হয়, ঢাকা শহরে কমপক্ষে পাঁচ লাখ রিকশা চলে। যারা এসব নিয়ে হিসাব-নিকাশ করতে চান তাদের ধারণা, রিকশার সংখ্যা ছয় লাখেরও উপরে। ধরে নিলাম পাঁচ লাখ। তাহলে দুই শিফটে রিকশাচালকের সংখ্যা ১০ লাখ। এই ১০ লাখ রিকশাচালকের পরিবারে যদি গড়ে তিন জন সদস্যও থাকে তাহলে শুধু রিকশার কারণে  ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা শহরে থাকছে। এই দশ লাখ রিকশাচালককে কিন্তু শ্রমিকের সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না। তাদের শ্রম কোনো উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয় না। শহরের স্বল্প আয়ের মানুষকে সামান্য আরাম দেয়ার বিনিময়ে এরা কিছু আয় করে নিচ্ছে। একজন রিকশাচালক যদি দিনে ২০০ টাকাও আয় করে তাহলে এই শহরে বসবাসরত সাধারণ বাসিন্দাদের ২০ কোটি টাকা প্রতিদিন শুধু সামান্য আয়েশের খাতে ব্যয় হয়।
 
এই ১০ লাখ রিকশাচালক যদি শ্রমিক হিসেবে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা আয় করতে পারতো তাহলে দেশ লাভবান না হলেও ২০ কোটি টাকার আউটপুট প্রতিদিন জাতীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হতো। কারণ তাদের শ্রমটা উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হতো। যদিও দেশে রিকশা বা ভ্যানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে ঢাকাকে তো জনসংখ্যা চাপের কবল থেকে মুক্ত করতে রিকশামুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সেটা পারা খুব কঠিন। ওয়ান ইলেভেনের পর গোটা দেশের রাজনীতিকদের রাজনীতিমুক্ত করা গেলেও ফুটপাতকে হকারমুক্ত করা যায়নি।
 
বর্তমান ঢাকা শহর এক ভয়াবহ যন্ত্রণার শহরে পরিণত হয়েছে।  বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি-পয়ঃনিষ্কাশন যানজট, ইত্যাদি সংকটে নাগরিকজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। অথচ অযাচিত জনসংখ্যার চাপ যদি না থাকতো, তাহলে এসব কোনো সমস্যাই থাকতো না। 
 
এই শহরের আবাসিক এলাকায় এক সময় হয়তো ১০ কাঠা জায়গার উপর একটি পরিবারের একটি বাড়ি ছিলো। সেখানে চার/পাঁচজন লোক বাস করতো, তাদের হয়তো একটি গাড়ি থাকতো। বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি সরবরাহের সেরকমই ব্যবস্থা ছিলো। সেই ১০ কাঠা জায়গার ওপর এখন ৮০টি পরিবারের ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে, যা একটি গ্রামের সমান। এখন এই ৮০ পরিবারের ৮০টি গাড়িও আছে। ফলে যে রাস্তা দিয়ে একটি গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা ছিলো সেখানে ৮০টি গাড়ি চলছে। এসব সমস্যা এখানেই থেমে থাকবে, তা নয়। সমাধানের চেষ্টা করা না হলে আরো বাড়তে থাকবে। তারপর হয়তো এক সময় সুবিধাবঞ্চিতদের বিস্ফোরণে সুবিধাভোগীদের সিংহাসন চুরমার হয়ে যাবে। 
 
তাহলে এখন সমাধানের উপায় কি? 
 
একটি প্রস্তাব এসেছে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের পক্ষ থেকে। তিনি ঢাকায় কেন্দ্রীভূত দেশকে ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকার মধ্যে সুষমভাবে ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। তার প্রস্তাব, প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তন। দেশকে আটটি প্রদেশে বিভক্ত করে সেখানে হাইকোর্ট বেঞ্চ, অফিস-আদালত স্থাপন করা, যাতে মানুষকে আর সামান্য একটা কাজের জন্যও ঢাকায় যেতে না হয়। 
 
বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এই ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশে এটা কীভাবে কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। এটাই যে শেষ ব্যবস্থা, তা নাও হতে পারে। যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং যেটা আরো প্রকট হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাবের চেয়ে আরো উত্তম প্রস্তাব যদি থাকে, তাও আসুক। না হলে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাবের পক্ষে সবাই একমত হতে পারেন। 
 
লেখক : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক সচিব
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com