স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও দেশের একটি শক্তি সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, যুদ্ধাপরাধ এবং পাকিস্তানি আদর্শের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। আর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিএনপি এই শক্তিটির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও পাকিস্তানি প্রবণতা কেন ঠেকানো যাচ্ছে না? অনেকের প্রশ্ন?
এর উত্তর, আমরা আজও একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে পারিনি। যার কারণেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় সেই পাকিস্তানি প্রবণতা!
মাও সেতুং ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট চীন প্রতিষ্ঠার পর পরই তীব্রভাবে অনুভব করেন একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। যার ফলে মাও সেতুং ১৯৬৬ সালে ডাক দেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের, যার স্থায়িত্ব হয় ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। মাও সেতুং এর বিপ্লবকে অনেক পণ্ডিত অনেকভাবে দেখলেও আজকে চীনের বাস্তবতা প্রমাণ করে সেটার একটা বিরাট প্রভাব আজও বিদ্যামান চীনা রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে, যার কারণেই চীন আজ বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রয় ক্ষমতা(পিপিপি) এর ভিত্তিতে এক নাম্বার পজিশন দখল করে আছে।
বঙ্গবন্ধুরও দূরদৃষ্টি ছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ব্যাপারে। শুনেছি স্বাধীনতা উত্তর-পূর্বে বঙ্গবন্ধুর অনেক সমাবেশে দেশত্ববোধক গান পরিবেশন হতো এবং বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে ১১ টা যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয়েছিল। কোথায় সেগুলো আজ?
বঙ্গবন্ধু যখন ৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন, সংবিধানের অঙ্গসজ্জার কার্যক্রমের মূল তত্ত্বাবধায়ক রাখেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে। সংবিধানের অঙ্গসজ্জার সাথে যুক্ত করেন শিল্পী হাশেম খানকে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে। বঙ্গবন্ধু এখানেই থেমে থাকেননি, তিনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একডেমি, শিল্পকলা একাডেমির জাল ছড়িয়ে দেন ঢাকা ব্যতীত দেশের ৬৩ টি জেলায়। কি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন জাতির পিতা।
কারণ বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ করেছেন, মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয় পূর্ব-পশ্চিম দুই অংশ নিয়ে। দুই পাকিস্তানের ভয়াবহ সংকটগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সংকট। পূর্ববাংলা বা বাঙালির সংস্কৃতির সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির কখনই মিল ছিল না। এরসাথে আরও অসংখ্য সংকট যুক্ত হয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় জন্ম হয় বাংলাদেশের। ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালের এই পরিবর্তন দুটিই ছিল বিশাল বিপ্লবের ফসল এবং যার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সংস্কৃতি।
আজকে জননেত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, চীনও এভাবেই উন্নয়নের পথে এগিয়েছে, বিশ্বে উন্নত সমৃদ্ধশালী হয়েছে। শুধু পার্থক্য একটাই আমরা সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর ৬৩ জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া শিল্পকলা একাডেমির মত উদ্যোগ এগিয়ে নিতে পারিনি। অনেক শিল্পীই চিকিৎসার টাকার অভাবে ক্যাম্পেইনের দারস্থ হয়, কোথায় আমাদের সেই ৪০ বছর পূর্বে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্টি শিল্পকলার ভূমিকা। শুধু রুটিন করে রবি ঠাকুর আর নজরুলের জন্ম, মৃত্যু পালনই শিল্পকলার কাজ...? না,আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে লালন, হাসনের মত অসংখ্য গুণীদের সৃষ্টি, যে সৃষ্টি মোহিত করতে সক্ষম হাজার হাজার প্রাণের স্পন্দনকে...এবং তখনই আমরা স্থায়ীভাবে ঠেকাতে পারবো পাকিস্তানি প্রবণতাকে, জঙ্গিবাদকে... বুঝাতে সক্ষম হব আমাদের সাংস্কৃতিক কারো কাছ থেকে ধার করা নয়।
বাঙালির স্বাধীন সত্তায় সবচেয়ে বেশি অবদান ভাষা আন্দোলনের। সে ভাষা আন্দোলনের মত একটা বিরাট গণআন্দোলন পুরো সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করেছে, কিন্তু আজ সেই দেশে বছরে কয়টি বই প্রকাশ হয়? আজকে বাংলা একাডেমির দিকে তাকালে দেখি সেখানে বই মেলায় কয়টি বই প্রকাশ হয়? বড় জোর সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার বই। এর বাইরে আরও এক-দুই হাজার বই প্রকাশিত হয়। বছরে ছয় হাজারের মত বই প্রকাশিত হয়। অনেক নবীন লেখকই টাকার অভবে প্রকাশনায় যেতে না ঝরে পড়ে, একাডেমির পেট্রোনাইজ নেই, বাজেট থাকে না এর জন্য...
অপরদিকে ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে চীনে বছরে সাড়ে চার লাখ বই প্রকাশিত হয়, তাদের জ্ঞান ভাণ্ডারের তুলনায় আমরা কত পিছিয়ে পড়ছি! চিন্তা করা যায়? এভাবেই সমাজের একটা শ্রেণীর মননশীলতা খুব সহজে মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে পাকিস্তানি প্রবণতার পথে হাঁটছে,হাটছে জঙ্গধরা সমাজের দিকে...!!!
এটা ঠেকাতে প্রয়োজন এবং জরুরি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, না হলে যে এসব মগজ ধোলাই হতেই থাকবে।
লেখক: সাবেক উপ-সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ