সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে ব্যক্তিসচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ

সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে ব্যক্তিসচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০১৬, ২০:৪৮:৩৫
সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ দমনে ব্যক্তিসচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ
এস.এম.শওকত হাফিজ
প্রিন্ট অ-অ+
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় সন্ত্রাস, সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শব্দগুলো বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত। সন্ত্রাস বলতে মূলত আমরা বুঝি যা জনসাধারণের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি করে।
 
বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে কিছু না কিছু বিচ্ছিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে মধ্যোপ্রাচ্যভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস তথাকথিত ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার নামে বিশ্বব্যাপী যে ধরনের হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে যাচ্ছে, তা শান্তির ধর্ম ইসলাম কেন, কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। 
 
আইএস আসলে ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নতুন ফর্মুলা মাত্র। যেটা আগে ছিল তালেবান কেন্দ্রিক। ইসরাইলের মোসাদ এবং আমেরিকার সিআইএ’র সৃষ্টি এই আইএস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে সব জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আছে, তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করা আর তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার মদতের মাধ্যমে অশান্ত করে তোলাই তাদের মূল লক্ষ্য। 
 
গল্পের বাকি অংশ সবার জানা। মূলত আইএস টিকে আছে আমেরিকা, সৌদি আরব, ইসরায়েল আর তুরস্কের মদতে। যদিও এই রাষ্ট্রগুলো সেটা স্বীকার করে না এবং করার কথাও না। কারণ সেটা স্বীকার করতে গেলে তাদের সাম্রাজ্যবাদ ফর্মুলা অচল হয়ে যায়। 
 
অন্য দিকে আইএসের বিপক্ষে লড়ে যাচ্ছে রাশিয়া, সিরিয়া এবং ইরান। সম্প্রতি আমাদের অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে এই ধরনের হামলার শিকার হতে দেখেছি। এই হামলাগুলোর সাথে যে দেশীয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, হিজবুত তাহরির জড়িত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব জঙ্গি সংগঠনের সাথে দেশের বাইরের কোনো সংগঠন বা গোষ্ঠীর যে যোগাযোগ নেই তার নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
 
গতমাসের ২০ তারিখ পবিত্র রমজান মাসে এশার নামাজের সময়ে গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে কতিপয় যুবক ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে হামলা করে। তারা রেস্টুরেন্টে থাকা ১৭ জন বিদেশীসহ ২০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগে তারা বলতে থাকে যে তারা বিধর্মীদের মারতে এসেছে এবং নিজেরাও মরতে এসেছে (সূত্রমতে)। 
 
তারা সেখানে থাকা জাপানের নগরিক যারা জাইকার হয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কাজের জন্য এসেছিলেন, চীনা নাগরিক যারা ব্যবসার কজে এদেশে এসেছিলেন এবং ভারতীয় যারা এসেছিলেন অসাম্প্রদায়িক শস্য- শ্যামলা অপরূপ এদেশের সৌন্দার্য উপভোগ করতে। এসব বিদেশীসহ তারা আমাদের নিজ দেশের লোকদেরকে মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও হত্যা করেছে। আর এটা করেছে শুধু তাদের পোশাক ও চিন্তাধারা পছন্দ না হওয়ার করণে। 
 
পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামাতে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর উদ্দেশ্যে হামলার ছক কষে সেখানে উপস্থিত হয়েছিল জঙ্গিরা। কিন্তু আমাদের নির্ভীক পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা জীবন দিয়ে সেই হামলা রুখে দেয়। কিন্তু এই রুখে দেয়াতেই কি শেষ?
 
সারা বিশ্ব অবাক দৃষ্টিতে বাংলাদেশকে দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে যেতে দেখছে। এই উন্নয়ন দেশ এবং দেশের বাইরে সবার কাছে একইভাবে পজেটিভ হতে পারে না। হতে পারে না বলেই ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে এদেশের কিছু কুলাঙ্গার স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। শুধু তাই নয়, জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য ১৪ ডিসেম্বর বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
 
আজ যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪৭ বছরে সবচেয়ে ভালো সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, শিল্পসসহ সব ক্ষেত্রে যখন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এক অদম্য গতিতে। ঠিক তখনই দেশী-বিদেশি অপশক্তি আবার নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। বিশ্বের কছে কলুষিত করছে আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে।রক্তাক্ত করছে এদেশের পবিত্র মাটিকে। যে মাটির প্রত্যেকটা ইঞ্চি পবিত্র ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত।
 
সবচেয়ে দুঃখ এবং কষ্টের বিষয় হলো এটা করার জন্য তারা যেটাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে সেটা শান্তির ধর্ম ইসলাম। পবিত্র রমজান মাসে ইফতারের সময় পবিত্র মদিনা শরীফের মসজিদে নববীর প্রবেশ পথে বোমা হামলা করে। তুরস্কের আতাতুর্ক বিমান বন্দরে আত্মঘাতি হামলা চলিয়ে, ফ্রান্সে নির্বিচারে ট্রাকচাপা দিয়ে হামলার মাধ্যমে তারা কোন ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে?
 
যে ইসলামকে কিছুদিন আগে ইউনেস্কো শান্তি ও মানবতার ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেছে? না তা নয়, ইসলাম শন্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম। এখানে কোনো হত্যা, বোমাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের স্থান নেই।
 
মহানবী (সা.) তার বিদায় হজে যে কয়টি গূরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো "যার যার ধর্ম পালন এবং অন্য ধর্মের প্রতি সহনুভূতিশীল এমনকি কাউকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত না করা।" তবে তারা কি আসলেই ইসলামের পথে আছে? না তা কোনো দিন নয়।
 
মূলত তাদের নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিরীহ, শান্তশিষ্ট, শিক্ষিত তরুণদেরকে কুরআন হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিপথগামী করে তুলছে। আর এই জন্য তারা টার্গেট করছে বিভিন্ন ইংরেজি মাধ্যম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণদের। 
 
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রথমে আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার মধ্য দিয়ে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার ৬ জনই ছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের।
 
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে নাশকতার চেষ্টায় গ্রেফতার হাসান নাফিসও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায় জড়িতদের দুইজন নিহত জঙ্গি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের। গুলশান হামলায় আটক হাসনাত করিম নর্থ সাউথের সাবেক শিক্ষক।
 
সূত্রমতে গুলশান হামলার সময় জঙ্গিরা যে মোবাইলটি ব্যাবহার করে রক্তাক্ত বীভৎস ছবি থ্রিমা অ্যাপসের মধ্যমে বাইরে পাঠায় সেটা ছিল ওই শিক্ষকের। এমনকি রেস্টুরেন্টের পাশের বাড়ি হতে ধারন করা ভিডিওতে ওই শিক্ষককে জঙ্গিদের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে দেখা যায়।
 
এছাড়াও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন গুলশান হামলার ঘটনায় অাটক। প্রো ভিসির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই -ব্ললকের ৬ নং সড়কের ৩ নং বাড়ির এ/৬ ফ্লাটে বসে ওই হামলার ছক করে জঙ্গিরা। যে ফ্লাটটির মালিক নর্থ সাউথের ভারপ্রাপ্ত প্রো-ভিসি। তাই অনেকটা মজার সুরে বলা "মাম্মি- ড্যাডির স্যান্ডুইচ, বার্গার মার্কা পোলাপান উত্তর দক্ষিণ মার্কা বিশ্ববিদ্যালয় হতে উচ্চশিক্ষার সনদের পরিবর্তে জান্নাতের টিকিট কেনা শুরু করছে নাকি?" 
 
ইংরেজি মাধ্যম ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের কেন টার্গেট করা হচ্ছে এবং কেন সহজে তাদের পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন করে মগজ ধোলাই করে সহজে বিপথগামী করে তুলছে? এই প্রশ্নের আমার কছে সহজ জবাব হলো, "এসব তরুণ অন্য মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে ইসলাম, কুরআন, হাদিস এবং আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির বিষয়ে অজ্ঞ। এই তরুণদের মধ্যে অনেকে আবার চরম বিষন্নতায় ভোগে। এর ফলে খুব সহজে ইসলাম, কুরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করে হাতে কথিত জান্নাতের সনদ (একে ৪৭, বোমা, গোলাবারুদ) ধরিয়ে দেয়া যায় অতি সহজে।
 
সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, এসব তরুণ হঠাৎ পরিবার থেকে নিখোঁজ বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সহজ-সরল তরুণদেরকে যে পরিমান হিংস্র ও পাশবিক করা হচ্ছে এবং অস্ত্র গোলবারুদ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তা দুই এক দিনে সম্ভব নয়। তাই আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীকে খুব সচেতনতার সাথে এদের আস্তারা খুঁজে বের করতে হবে। 
 
আমাদের মিডিয়াগুলো সব সময় অইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা ফলাও করে প্রচার করে। এক্ষেত্রে জঙ্গিরা খুব সহজেই সতর্কতা অবলম্বন ও দ্রুত স্থান পরিবর্ত করতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে সতর্কতা অবলম্ব করতে হবে।
দেখা যাচ্ছে যেখানে তারা হামলা চালিয়েছে, সেখানে আগে থেকে তারা বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করছে। এসব বিষয় মাথায় নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
 
বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয়, সমাজিক সচেনতার সাথে সাথে ব্যক্তি সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব জঙ্গিরা গোপনে মিলেমিশে থাকছে আপনার, আমার মতো ব্যক্তির সাথে।
 
কোনো তরুণ যদি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, তবে ভয় না পেয়ে সচেতন পিতা-মাতা হিসেবে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে।
 
 হামলার ধরন অনুসারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সিনেমা হল, শপিং মল, বার, ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে হবে। 
 
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন- মসজিদ, মন্দির, গির্জা ইত্যাদিতে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
 
সরকারি অফিস, অদালত, সচিবালয়, সংসদ ভবন, ন্যাম ভবনে নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন।
 
বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, বিশেষ করে ঢাবির আন্তর্জাতিক ও জগন্নাথ হলে নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
 
আমরা দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এক আপাসহীন জাতি। জঙ্গিদের শেকড় যতোই গভীর হোক না কেন, তাদের দেশী-বিদেশি দোসররা ষড়যন্ত্রের জাল যতোই বুনুক না কেন আমরা বীরের জাতি, সব কিছুকে পদপৃষ্ঠ করে এগিয়ে যাবো দূর্বার গতিতে।
 
বিবার্তা/কাফী
 
এস.এম.শওকত হাফিজ
বি.এস.এস (অনার্স),এম.এস.এস,রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com