জঙ্গিবাদ দেশে নতুন আতংক। যদি বৈশ্বিক চিন্তা করা হয় তাহলে পুরনো আতংক। তবে উদ্বেগ আরও বাড়ে যখন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ও সমাজ দৃষ্টিকোণে প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তানরাও এই জঙ্গিবাদে জড়িত। আগে ভাবা হতো মাদ্রাসা পড়ুয়া অভাবগ্রস্থ পরিবারের সন্তানরাই কেবল জঙ্গিবাদের পথ বেঁচে নিচ্ছে। সেই সাথে এই ধারণাও পোষণ করা হত, এই শ্রেণীর মানুষদের খুব সহজে ভুল বুঝিয়ে কিংবা অর্থের লোভ দেখিয়ে জঙ্গিবাদে ধাবিত করা যায়। অথচ সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে এখন প্রকৃত ধারনাটি পরিস্কার। যে শ্রেণীর মানুষরা জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার কথা নয়, তাঁরাই যখন জড়িয়ে পড়ছে সকলের চোখ তখন কপালে।
সরকারের পক্ষ থেকেও জঙ্গি দমনে এতোদিন নানা উদ্যোগ নিয়েছিল মাদ্রাসা পড়ুয়া শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে; অপ্রিয় সত্য কথা, নজর ছিল না এলিট শ্রেণীর এই শিক্ষার্থীদের প্রতি; আর সেই সুযোগে জঙ্গি হোতারা এদের টার্গেট করে শিকড় গজিয়েছে। তাই চাইলেই এখন উপড়ে ফেলা যাচ্ছে না। সে জন্য প্রয়োজন গভীরে প্রবেশ করা।
সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি হামলা ঘটনাগুলোর কারণে প্রতিনিয়ত অস্বস্তিতে সময় পার করছে জনগণ। স্বস্তিতে নেই সরকার, দারুণ চাপে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। বিশ্ব নেতারাও বাংলাদেশ নিয়ে দোড়-ঝাঁপ করছে; উদ্বিগ্ন কূটনৈতিকমহল। সংকট যখন ঘনীভূত, তা থেকে উত্তরণের তড়িৎ এবং স্থায়ী সমাধান দুটো পথই খোঁজা হচ্ছে। সমাধান সন্ধানে এটা স্পষ্ট হয়েছে জঙ্গিবাদের এই সমস্যা হয়তো সাময়িক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে, আদতে জঙ্গিবাদ নির্মূলে দরকার স্থায়ী সমাধানের পথে হাঁটা। তাহলে কি হতে পারে স্থায়ী সমাধানের পথ?
সরল দৃষ্টিতে বেরিয়েছে জঙ্গিবাদের উত্তম ওষুধ হতে পারে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। রাজধানী ছাড়িয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে বইপড়া কর্মসূচি, গান, নাচ, আবৃত্তি এবং দেশীয় সংস্কৃতির নানান উৎসবগুলো দেশব্যাপী ঘটা করে আয়োজন করা ইত্যাদি। উদ্যোগগুলো হতে হবে রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা, প্রণোদনায় ও পৃষ্ঠপোষকতায়। শিক্ষা ব্যবস্থায় সাজিয়ে তুলতে হবে সাংস্কৃতিক আবহ। মানুষের কর্মে চিন্তায় দেশীয় সংস্কৃতি প্রাধান্য পায় এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠা একজন মানুষ কখনো জঙ্গিবাদে ধাবিত হতে পারে না। কারণ সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তির মনে লালিত হয় দেশাত্মবোধ চেতনা। শুধু তাই নয়, সাংস্কৃতিক এই আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হলে দেশে অন্যায় অপরাধ দুর্নীতি অনেক কমে আসবে। সাংস্কৃতিক চেতনায় বেড়ে উঠা মানুষ কোনো অপরাধ করতে গিয়ে অন্তত একবার হলেও ভাবেন; কারণ তার মস্তিষ্ক গড়ে উঠে দেশাত্মবোধ এবং মানবিক চেতনায়।
সরকারের কোনো কোনো মহলও এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন। কিছুদিন আগে ঢাকা পুলিশ কমিশনারও মিডিয়ায় বলেছেন, জঙ্গিবাদ দমনে দেশে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার। অর্থের লোভ দেখিয়ে কাউকে জঙ্গিবাদ থেকে ফেরানো সম্ভব নয়। কারণ, গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনায় যে জঙ্গিগুলো মারা গেল তাঁদের পরিবারের অবস্থা দেখে বোঝা গেছে অর্থের লোভে কেউ জঙ্গি হচ্ছে না, জঙ্গিবাদের সমস্যাটি মনস্ততাত্ত্বিক। যারা ভাবেন মানুষ মেরে বেহেশতে যাওয়া শতভাগ নিশ্চিত তাঁরা মানসিকভাবে কতোটা দৃঢ় অবস্থায় তা বোঝার কিছু বাকী থাকে না। এখানে এটাই প্রমাণ হয়, এই মনস্ততাত্ত্বিক অসুখ সারতে আরেকটি মনস্ততাত্ত্বিক উদ্যোগই যথার্থ পন্থা। সেই পদক্ষেপটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
এই সংকট উত্তরণে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ডাক উঠেছে যখন, ঠিক তখনই গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই সংবাদে চোখ আটকে যায়- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকে এদেশের মানুষের স্মৃতিতে চিরঅম্লান রাখার লক্ষ্যে তার স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিধান করে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ আইন ২০১৬’ সংসদে পাস হয়েছে। সরকারি এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও দর্শন, সাহিত্য ও সংগীত এবং বিশ্বসংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা করা হবে। এই সংবাদে ব্যক্তিগতভাবে আমি ভীষণ উচ্ছ্বসিত।
কিছুটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও স্বীকার করতেই হবে, এই উদ্যোগ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই নেয়া সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ।
আর কোন কালক্ষেপণ নয়, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উদ্যোগটি ধারাবাহিকভাবে এভাবে শুরু হোক।
লেখক- আইনজীবী ও সম্পাদক, ল`ইয়ার্সক্লাব বাংলাদেশ ডট কম।
বিবার্তা/মৌসুমী