জঙ্গিবাদ এ মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় একটি সমস্যা। সমস্যাটি নিয়ে রাজনীতিও চলছে। বিষয়টির সাথে জাতীয় অস্তিত্ব, জাতীয় সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। জড়িত রয়েছে লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ।
জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য গড়ার ডাক দিয়েছে বিএনপি। জবাবে সরকার বলছে, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
নিঃসন্দেহে এটি একটি জাতীয় সমস্যা এবং এ নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে । কিন্ত কিভাবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা হবে? সকল রাজনৈতিক দল এককাতারে দাঁড়ানোর পরও এদেশে সামরিক স্বৈরাচার নয় বছর ক্ষমতায় ছিল। সকল দল এককাতারে দাঁড়ালে বা একটি জাতীয় কনভেনশন করলেই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে না। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন, বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ফায়দা হাসিলের মতলব থেকে বের হয়ে আসা।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের ক্রমধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে ২০০১-০৬ সময়ে। এর আগে জঙ্গিতৎপরতা তেমন লক্ষ্য করা যায় না। এ সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে জমিয়াতুল মোজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)'র তৎপরতায় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাংলাভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানেরা দেশের এক বিশাল অংশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। জেএমবি'র এ তৎপরতা বন্ধ করার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং ধর্মের নামে জেএমবির বীভৎস হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সেসময় সরকার থেকেও সাফাই গাওয়া হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তি সম্পর্কে কুৎসা রটিয়ে সেসব হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। মনে হয়েছে যেন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বা আদালতের চেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে জেএমবিকে সরকারের তরফ থেকে গড়ে তোলা হয়েছে।
সে সময়ের জোট সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, জামায়াতে ইসলামীর আমীর (যুদ্ধাপরাধী) মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল, সরকারের আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রী (যুদ্ধাপরাধী) আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ বলেছিলেন, 'দেশে বাংলাভাই বা জেএমবি বলে কিছু নেই। এসবই মিডিয়ার তৈরি।'
কিন্তু মিডিয়ার অব্যাহত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ফলে জনমত গঠন হয়। জনমতের চাপে পড়ে খুব সীমিত পরিসরে জঙ্গিবিরোধী তৎপরতা শুরু করে সরকার। অপরদিকে জঙ্গিদের তৎপরতা হয়তো জোট সরকারের কেউ কেউ ইতিবাচকভাবে দেখেননি। এ সময়ে পুলিশ বিভিন্ন জেলা থেকে জেএমবির কর্মীদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়া জেএমবি সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, তারা সবাই সাবেক শিবির কর্মী।
বিষয়টি জানা ছিল বলেই নিজামী-মুজাহিদরা জেএমবি নিয়ে বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা বলেছিলেন।
এ সময়েই আরো কিছু ইসলাম নামধারী গোপন সংগঠনের তৎপরতা শুরু হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হরকাতুল জেহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরীর ইত্যাদি।
জামায়াত বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায় জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। জিয়া নিজ রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের দল গঠন করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তাদের খুশি করতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের মূলনীতি- ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র পরিবর্তন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসের উদ্যোগে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালে জিয়াউর রহমান দেশপ্রেম থেকে, নাকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএস-এর এজেন্ট হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন?
মেজর রফিকের লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বই পড়লেও মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এ বইটি জিয়ার জীবদ্দশায় লিখেছিলেন মেজর রফিক। সে সময় বইয়ের কোনো তথ্য নিয়ে প্রতিবাদ করা হয়নি।
জিয়ার শাসনামল থেকে জামায়াত স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে। ২০০১-০৬ ছিল জামায়াতের রাজনীতির স্বর্ণযুগ। সে সময় সরকারের মন্ত্রিত্ব নিয়ে দেশ পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই জামায়াত মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি গিয়ে এককভাবে ক্ষমতা দখলের মোহ বেড়ে যায় জামায়াতের। তার প্রস্তুতি হিসেবে তাই জামায়াত ভিন্ন পরিচয়ে জেএমবি, হরকাতুল জেহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ বিভিন্ন নামে গুপ্ত সামরিক সংগঠন গড়ে তুলেছিল। এসব সংগঠনের প্রতিটির পেছনেই কাছ থেকে বা দূর থেকে জামায়াত সহায়তা দিয়েছে। জামায়াতের প্ররোচনায়ই ২০০৩ সালের ১৭ আগস্ট দেশের পাঁচ শতাধিক স্থানে একই সময়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
কিন্তু জনগণের মনোভাব বুঝে ওই সময় ক্ষমতা দখলের খেলায় নামার সাহস পায়নি জামায়াত। এসময় অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসায় জামায়াত গুটিয়ে যায় এবং পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করায় জামায়াত বেকায়দায় পড়ে। ফলে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সমমনা ধর্মীয় ও স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে অঘোষিত ঐক্য গড়ে ওঠে। ইসলাম নামধারী ওসব সংগঠনের কর্মকাণ্ড ইসলামসম্মত কি না সে বিষয়ে জামায়াত খুব বেশি কিছু বলে না। অপরদিকে ওসব সংগঠনও জামায়াতের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয় না।
জামায়াতের রাজনীতি সবচেয়ে সংকটে পড়ে, যখন সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখী করে। দলটির শীর্ষ নেতাদের বিচারের কাঠগডায় দাঁড় করায়। এ সময় ধর্ম, রাষ্ট্র, দেশ ইত্যাদি বিষয়ে জামায়তের আসল চেহারা ফুটে ওঠে। জামায়াতের নৃশংসতা ও সহিংসতা রাজনীতির ঐতিহ্যকে ম্লান করে দেয়। তখনই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এতদিন তারা নমনীয়তা প্রদর্শন করেছে মেকি রূপ নিয়ে। চাঁদের বুকে দেলু রাজাকারের (দেলোয়ার হোসেন সাঈদী) ছবি দেখার বিষয়টি কোনোভাবেই ইসলামসম্মত নয়। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এ বিষয়েও কোনো জোরালো বক্তব্য দেয়নি। সরকারের কঠোর অবস্থান ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সুদৃঢ ঐক্যের কারণে সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।
সম্প্রতি আইএস-এর নামে দেশে নতুন করে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হয়েছে। গুলশানের আর্টিজান বেকারি ও শোলাকিয়া ঈদের জামায়াতে জঙ্গি হামলার পর জঙ্গিদের নতুন নামকরণ করা হয়েছে আইএস। বাংলাদেশে আইএসআইএল-এর তৎপরতা থাকার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আইএস নিজেই কোনো আদর্শিক সংগঠন নয়। ওই সংগঠনের তৎপরতা মধ্যপ্রাচ্যের ২/৩টি দেশভিত্তিক। ওই দেশগুলোও প্রতিবেশি ।
বিশ্বের প্রায় সকল মুসলিম জানেন যে, ইসলাম টিকে থাকার জন্য জঙ্গি তৎপরতার প্রয়োজন নেই। তারপরও আইএস সৃষ্টি মূলত ইসরাইলের আর্থিক বিনিয়োগ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন রয়েছ। একটি ঘটনা থেকে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। আইএস-এর প্রধান আবু আল বাগদাদি মার্কিন সৈন্যদের হাতে গ্রফতার হয়েছিলেন এক সময়। কোনো শর্ত ছাড়াই তাকে মুক্তি দেয়া হয়। বিষয়টি একেবারেই অস্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে তাকে ছেড়ে দেয়ার অঘোষিত শর্ত ছিল আইএস-এর দায়িত্বগ্রহণ। কারণ, আবু আল বাগদাদির জীবন পর্যালাচনা করলে দেখা যাবে তার মতো লোকের পক্ষে একটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতৃত্বে আসা সম্ভব নয়।
আইএস নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত সমালোচনা থাকলেও আমাদের দেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলো এ বিষয়ে কোনো জোরালো বক্তব্য দেয় না। এর প্রধান কারণে হলো, আইএস হোক আর হরকাতুল জেহাদ হোক, তারা তো সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে।
লক্ষ্যণীয় হচ্ছে সরকারের কোনো কোনো নীতি বা উদ্যোগ নিয়ে আমাদের দেশের ধর্মব্যবসায়ীরা (মওলানা শফি, বাবুনগরী, চরমোনাই, খেলাফত মজলিশ ইত্যাদি) ‘ধর্ম গেল’ বলে মাতম তুলে থাকে। কিন্তু আজ আইএস-এর নামে যখন প্রকৃতপক্ষেই ইসলাম বিপদের সম্মুখীন, তখন কিন্তু মওলানা শফি, বাবুনগরী, চরমোনাইদের কোনো কথা নেই। তার পরিবর্তে জুমার নামাজের খুতবার প্রথম অংশ নিয়ে তাদের চিৎকার শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। অথচ খুতবার এ অংশে সংশ্লিষ্ট মসজিদের ইমাম ইচ্ছেমতো বক্তব্য দেন।
দেশের প্রয়োজনে, জাতির প্রয়োজনে, সর্বোপরি ধর্মের প্রয়োজনেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন যখন একটি গাইডলাইন দিয়েছে, তখন ওইসব ধর্মব্যবসায়ীর মুখে আবার শুনতে হচ্ছে ‘ধর্ম গেল, ধর্ম গেল’।
আইএস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তাই জামায়াত সরকারকে বিব্রত করতে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে আইএস-এর নাম ব্যবহার করে জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
আইএস-এর নাম ব্যবহার করে তারা প্রধানত দু'টি সুবিধা পাচ্ছে। প্রথমত, সন্দেহের তীর থেকে মুক্ত থাকছে, দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বা জঙ্গি সংগঠনের নাম ব্যবহার করায় জনগণের মধ্যে বেশিমাত্রায় আতঙ্ক সৃষ্টি করা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক জঙ্গি ঘটনায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের জড়িত হওয়ায় অনেকেই আশ্চর্য হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমাদের দেশে মোটা দাগে কোন ছেলেকে ভাল বলা হয়? যে ছেলেটা নিয়মিত পড়াশুনা করে, নামাজ পড়ে, ভালো ফলাফল করে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও আরাম-আয়েশের পথ করে নেয়। সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি, পরিবারের জন্য কতটা দায়িত্বশীল তা বিচার করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে ওসব ভালো ছেলেরা প্রচণ্ড স্বার্থপর হয়। এরা নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন ছাত্রের সংখ্যা কম নয়। এদের মধ্যেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রশিবির বেশি কাজ করে থাকে। দেশে যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, তখনও শিবির ছিল, গড়ে তোলা হয়েছিল রগকাটা বাহিনী, হাতের কব্জিকাটা বাহিনী। তখনও মসজিদ ছিল তাদের কর্মী সংগ্রহের উত্তম স্থান। এখনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছেলেদের চিহ্নিত করে জামায়াত জঙ্গি বানাচ্ছে। বাংলাদেশের আইএস মূলত জামায়াতের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নবসংস্করণ।
তাই জামায়াতের বিরুদ্ধে জোরালো জনমত গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে যুদ্ধাপরাধীদের পরিবার ও জামায়াত-শিবিরকে দূরে রাখতে হবে, আইন করে।
লেখক : রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন