মাথায় ছিল সিনেমা ফটোগ্রাফি। বিটিভির শিশুতোষ অনুষ্ঠান সিসিমপুরে প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক হিসেবে কাজ করেন তিন বছর। তিনটা প্রামাণ্যচিত্রও বিটিভিতে সম্প্রচারিত হয়। কিন্তু হয়ে গেল উল্টোটা। ফটোগ্রাফির প্রতি তৈরি হয়ে গেল আলাদা ভালবাসা। এভাবে ফটোগ্রাফিতে পথ চলা শুরু তার।
সুনামগঞ্জের দোয়ারা থানার গোপালপুরে জন্ম এস এম আব্দু্ল্লাহ আল মামুনের। শৈশবের দিনগুলি কাটে তার ওখানেই। বাবা সরকারি চাকুরে, মা গৃহিনী। তিন ভাই ও এক বোন। ক্লাশ থ্রি পর্যন্ত পড়ালেখা করার পর বাবার চাকুরি বদল হলে চলে যান ছাতক উপজেলায়। ছাতকেই এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপরে চলে যান সিলেট। সিলেট মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি পাস করেন। বর্তমানে তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসনে স্নাতোকোত্তর করছেন।
বিবার্তা’র আয়োজনে গত সপ্তাহে ৭১পিক্স 'ফটো অব দ্যা উইক' প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সেরা হয়েছেন আব্দু্ল্লাহ আল মামুন। এরপর তিনি মুখোমুখি হন বিবার্তার। জানান নিজের জীবনের গল্প। সেই গল্প পাঠকদের জানাচ্ছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
বিবার্তা : আপনার ফটোগ্রাফির শুরুর গল্পটা বলুন...
আব্দু্ল্লাহ আল মামুন : শুরু করি ২০১৩ সালে। এক প্রকার শখ থেকেই ছবি তোলা। ভালোলাগে ছবি তুলতে। ভাললাগাটা এক সময়ে ভালবাসায় পরিণত হয়ে যায়। পেছনে অবশ্য একটা ছোট গল্প আছে। আমি ২০০৭-১০ সাল পর্যন্ত বিটিভির শিশুতোষ অনুষ্ঠান সিসিমপুরে প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। ওখান থেকেই মূলত ফটোগ্রাফির প্রতি ভাললাগা শুরু হয়। আমার পরিচালিত তিনটা প্রামাণ্যচিত্রও বিটিভিতে সম্প্রচারিত হয়। আমাদের ছয় জনের একটা গ্রুপ ছিল, যারা নয়নতারা কমিউনিকেশনে কাজ করতাম। সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় মাথায় ছিল সিনেমা নিয়ে কাজ করার পোকা। এসময় চোখ ফিল্ম সোসাইটি নামের একটা সংগঠনও খুঁজে পাই। যোগ দেই তাদের সাথে। তখনও আমার ক্যামেরা ছিল না। ভাড়া করা ক্যামেরা দিয়ে কাজ করতাম। ২০১৩ সালে দিকে কিনি ক্যানন ৬০০ডি মডেলের ক্যামেরা। মাথায় ছিল সিনেমা ফটোগ্রাফি করবো। আর মাঝে মধ্যে ফটোগ্রাফি করবো। কিন্তু হয়ে গেল উল্টোটা। ফটোগ্রাফির সঙ্গে তৈরি হয়ে গেল প্রেম। এভাবে আমার ফটোগ্রাফি জগতে আসা।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কোথায় ?
আল মামুন : আমার ফটোগ্রাফি শিক্ষা শুরু হয় সাস্ট্রের অন্যতম বিখ্যাত সংগঠন সুপার বেসিক ফটোগ্রাফি কোর্সের মাধ্যমে। ২০১৩ সালে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হই। আমি ১৮তম কমিটিতে চীফ ইন্সট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম এবং বর্তমানে সাধারণ মেম্বার হিসেবে আছি। শাহজালাল ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফারস এসোসিয়েশনও (এসইউএফএ) আমাকে ফটোগ্রাফি বিষয়ে অনেক শিক্ষা দিয়েছে, যা আমর জীবনের স্মরণীয় হয় থাকবে।
বিবার্তা : কোন বিষয়ের ওপরে বেশি ছবি তুলতে পছন্দ করেন? এসব ছবি কেন তোলেন ?
আল মামুন : আমি সাধারণত স্ট্রিট পোর্ট্রেট, ল্যান্ডস্ক্যাপ ছবি তুলতে বেশি পছন্দ করি। তবে স্ট্রিটের ছবিই তুলতে বেশি ভাল লাগে। প্রকৃতির ভালবাসার টানেই ল্যান্ডস্ক্যাপ ছবি তোলা। আমার অধিকাংশ ল্যান্ডস্ক্যাপ ছবি সুনামগঞ্জে তোলা। ছবি ভিন্ন ভিন্ন মানসিক অভিব্যক্তি ও ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে। আর সেই জিনিসগুলোকে ছবিতে ধরে রাখার জন্যই করি পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফি। আমার মতে পাবলিক জায়গায় অনস্পট অবস্থায় কোনো কিছুর ছবি তোলাই হচ্ছে স্ট্রিট ফটোগ্রাফি। আমি রাস্তায় বের হলেই পোর্ট্রেট ছবি তুলতে বেশি ভাল লাগে।
বিবার্তা : নির্বাচিত ছবিটির পেছনের কথা জানতে চাই।
আল মামুন : ছবিটি সিলেটের দরগা থেকে তোলা। একদিন খুব সকালে আমরা দুই বন্ধু ফটোগ্রাফি করতে বের হই। গন্তব্য ছিল সিলেট হযরত শাহজালাল মাজার দরগা গেইট। দরগায় যাওয়ার পরে কোন ছবিই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। প্রায় এক ঘন্টা আশপাশে ঘোরাফেরা করার পর হঠাৎ চোখ পড়লো দরগার কবুতরগুলোর দিকে। এগুলো মনের আনন্দে ছোটাছুটি করছে। সকালের আলোতে কবুতরগুলোর ছায়া দেয়ালে পড়ছে। তখনই লক্ষ্য করলাম, যে দেয়ালে ছায়া পড়ছে সেখানেই একজন শুয়ে আছে। আর দেরি না করে শুরু করলাম ছবি তোলা। একটা পারফেক্ট মোমেন্ট পাওয়ার জন্য আধা ঘন্টা ধরে শুধু ক্লিক করেই গেলাম। পরে যখন ছবিগুলো দেখছিলাম তখন মাথায় এলো ছবি ক্যাপশন হবে Free Soul (ফ্রি সৌল)।
বিবার্তা : বিবার্তার৭১পিক্স ফটো অব দ্য উইক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার খবর শুনে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল?
আল মামুন : কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়া আসলেই অনেক আনন্দের এবং ভাগ্যের বিষয়। আমি যখন বিবার্তার৭১পিক্স প্রতিযোগিতার জন্য ছবিগুলো জমা দেই তখন আমি চিন্তাও করিনি যে আমার ছবিটাই বিজয়ী হবে। তবে মজার বিষয় হলো, যে রাতে ছবি পোস্ট করি, পরের দিন সকালেই ৭১পিক্স থেকে আমার কাছে কল আসে। এটা ছিল বিস্ময় ও আনন্দের মিশ্র অনুভূতির। কীভাবে এটাকে প্রকাশ করবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফার হওয়ার জন্য আসলে কী দরকার – দামি ক্যামেরা নাকি অন্যকিছু?
আল মামুন : দেখুন ক্যামেরা নিজে ছবি তোলে না। ক্যামেরা তো শুধু একটা যন্ত্র। এটাকে দিয়ে ছবি তোলাতে হয়। আমার দৃষ্টিতে ফটোগ্রাফার হতে দামি ক্যামেরা লাগে না, দরকার দেখার মতো মনের তৃতীয় চোখ। আপনি আশপাশের পৃথিবীকে কিভাবে দেখছেন, একটু অন্যভাবে শৈল্পিক দৃষ্টিতে দেখা বা নিজের মতো করে দেখা। এই বিষয়গুলো একজন ফটোগ্রাফারের মধ্যে থাকা জরুরি। সাধারণ মানুষ যেভাবে একটা বিষয়কে দেখে, একজন ফটোগ্রাফার দেখে একটু ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে। এই ভিন্নভাবে দেখার তৃতীয় চোখই ফটোগ্রাফার হওয়ার জন্য বেশি দরকার।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফি করতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে কি?
আল মামুন : একটা ছবির মূল উপাদন হচ্ছে সাবজেক্ট, মোমেন্ট, কম্পোজিশন এবং আলো। ছবির কম্পোজিশন ভাল না হলে, ঠিক জায়গায় ঠিকমতো আলো না থাকলে, মোমেন্ট, সাবজেক্ট না বুঝলে ছবি তোলাটা অনেক কঠিন কাজ। ছবির এই কারিগরি বিষয়গুলো অন্তত জানার ও বোঝার জন্য ফটোগ্রাফির বেসিক প্রশিক্ষণটা নেয়া খুবই জরুরি।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফিকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎপরিকল্পনা কি?
আল মামুন : ফটোগ্রাফিটা আমার কোনো পেশা না, এটা আমার ভালবাসা। ভাললাগা থেকে ছবি তোলার প্রতি ভালবাসা। সেই টানেই টেলিফিল্ম, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছি। এখনও করে যাচ্ছি। যতদিন ভাললাগা কাজ করবে ততদিনই আমি ফটোগ্রাফি করে যেতে চাই।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/মৌসুমী/হুমায়ুন