ক্লাস এইটে পড়ার সময়ও নিজের ক্যামেরা ছিল না তার। চাচাতো ভাইয়ের ক্যামেরা হাতে পেলেই ছবি তুলতেন। ক্লাস নাইনে পড়াকালে বাবার নোকিয়া ৬৬০০ মোবাইল নিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি তুলতেন। ক্লাস টেনে উঠে হাতে পান ছোট চাচার হ্যান্ডিক্যাম। সেটি দিয়ে তুলতেন মাছ ধরা, মাঠে গরু চরানো এবং ঢেঁকিতে ধান ভানার ছবি তুলতেন আর বাবা-মা, ছোট বোনকে দেখাতেন। এভাবেই এহসানুল সিদ্দিক অরন্যর ফটোগ্রাফিতে আসা।
তার ছবি প্রথম প্রদর্শনীতে স্থান পায় ২০১৪ সালে দৃক গ্যালারীতে। প্রদর্শনীতে তার ছিল দু’টি ছবি। গত ২৮ আগস্ট ছিলো তার ২৪তম ছবি প্রদর্শনী। এর মধ্যে ২৩ টিই হয় ঢাকায়। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই দৃকে এবং বাকি কিছু বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র এবং ঢাকা আর্ট গ্যালারীতে।
বিবার্তা’র আয়োজনে গত সপ্তাহে ৭১পিক্স 'ফটো অব দ্যা উইক' প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সেরা হয়েছেন এহসানুল সিদ্দিক অরন্য। এরপর তিনি মুখোমুখি হন বিবার্তার। জানান নিজের জীবনের গল্প। সেই গল্প পাঠকদের জানাচ্ছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
বিবার্তা : আপনার পরিবার, বেড়ে ওঠা এবং পড়ালেখা বিষয়ে জানতে চাই।
এহসানুল সিদ্দিক : আমার জন্ম খুলনায়। বাবা মো. সিদ্দিকুর রহমান, মা নাসিমা আক্তার। ছোট বোন চৈতি। সেখানেই আমার শৈশব কাটে। এরপরে বাবার চাকরীর সুবাদে খুলনার পাইকগাছায় দু’এক বছর থাকতে হয়। ওখানেই প্রাইমারি স্কুলজীবনের শুরু হয়। পরে বাবা ব্যবসা শুরু করেন যশোরে। ভর্তি হই যশোর জেলা স্কুলে। কলেজ জীবন কাটে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে। বর্তমানে রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করছি।
বিবার্তা : আপনার ফটোগ্রাফির শুরুর গল্পটা জানতে চাই।
এহসানুল সিদ্দিক : স্কুলে ভর্তির আগে থেকেই আমার ছবি আঁকতে অনেক ভালো লাগতো! এতে বাবা-মায়ের অনেক সাপোর্ট পেতাম। তারা হাতে ধরে আঁকতে শেখাতেন।
ক্লাস এইট-নাইনে পড়ার সময় থেকে ছবি তোলার ঝোঁক আসে। মোবাইল ক্যামেরা দিয়ে নানা ধরণের ছবি তুলতাম।আমার আগ্রহ দেখে বাবা আমাকে বলেন ভালো রেজাল্ট করলে একটি কমপ্যাক্ট ক্যামেরা কিনে দেবেন।
কলেজে থাকতে বাবা একটি চায়না মাল্টিমিডিয়া ফোন গিফট করেন। ওটা দিয়ে আমি সারাদিন ছবি তুলতাম। ছবি তুলে তুলে কলেজের ফ্রেন্ডদেরকে বিরক্ত করে তুলতাম। তখনও আমি জানতাম না যে, এর একটা প্লাটফর্ম আছে। কলেজ থেকে বেরিয়ে যাবার পর জানতে পারি যে এটাকে ফটোগ্রাফি বলে। ভার্সিটিতে উঠে দেখতাম অনেককে ফটোগ্রাফি করতে।
একদিন ঢাকায় একটি ফটো এক্সিবিশনে যাই। ওখানে বাংলাদেশের লেজেন্ডারি ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসাইন স্যারের সাথে দেখা হয়। স্যার জিজ্ঞেস করেন এক্সিবিশনে আমার ছবি আছে কি না। আমি বললাম যে নেই। কিন্তু আমি তার সাথে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুলতে চাই, স্যার আমাকে তার পাশের চেয়ারে বসালেন এবং আমার সাথে ছবি তুললেন। সেই এক্সিবিশনের গ্যালারীটি ছিলো দৃক এবং এক্সিবিশন টি ছিলো ফটো অ্যান্ড ফান এর ফ্রিজিং মোমেন্ট।
বিবার্তা : ৭১পিক্স ফটো অব দ্য উইক প্রতিযোগিতায় আপনি বিজয়ী হয়েছেন। খবরটা শুনে কেমন অনুভূতি হয়েছিল?
এহসানুল সিদ্দিক : যেদিন আমি ৭১পিক্স এ বিজয়ী হওয়ার খবরটা শুনি সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা আমার ক্লাস ও পরীক্ষা ছিল। যার জন্য আমি সারাদিনে খাওয়ার সময় পর্যন্ত না পেয়ে অনেক ক্লান্ত ছিলাম। সন্ধ্যায় এসে নাস্তা করতে বসবো তখন হঠাত ইনবক্সে আমার পরিচিত এক সহ-ফটোগ্রাফার তানভির অনিক ভাইয়ের অভিনন্দন পেলাম। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু ৭১ পিক্সের গ্রুপে ঢুকে দেখি সত্যিই আমি বিজয়ী হয়েছি। অবশ্যই অনেক আনন্দের অনুভুতি ছিলো।
বিবার্তা : নির্বাচিত ছবিটির পেছনের কথা জানতে চাই।
এহসানুল সিদ্দিক : ছবিটি তোলা মানিকগঞ্জ থেকে। আমি আমার খুব কাছের কয়েকজন সহ-ফটোগ্রাফারের সাথে গিয়েছিলাম ছবি তুলতে। সেখানে ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ দু’টি বাচ্চাকে নদী পার হতে দেখি। সেই মুহূর্তটি আমি আমার ক্যামেরায় ধারণ করি। এটা এখন থেকে আট মাস আগের তোলা ছবি।
বিবার্তা : ২৪ টি প্রদর্শনীতে আপনার ছবি স্থান পেয়েছে। তরুণ ফটোগ্রাফার হিসেবে আপনার এই অর্জনকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
এহসানুল সিদ্দিক : আমার ছবিগুলো ২৪টি প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে, এটা আমার জন্য অনেক বড় অর্জন। সেই সাথে পেয়েছি কিছু পুরস্করও। প্রথম পুরস্কার পাই থার্ড আই নামক একটি সোসাইটি থেকে। আমাকে ওই সোসাইটিতে মেম্বারশিপও দেয়া হয়। আবীর আবদুল্লাহ স্যারের জাজমেন্টে একটি ন্যাশনাল এক্সিবিশনে দ্বিতীয় পুরস্কার পাই যেটা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। আনোয়ার হোসাইন স্যারের হাত থেকে চতুর্থ পুরস্কার পাই একটি ন্যাশনাল মোবাইল এক্সিবিশনে, যেটা দৃকে অনুষ্ঠিত হয়।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কোথায়? ফটোগ্রাফি করতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে কি?
এহসানুল সিদ্দিক : আসলে সেভাবে আমার কখনো প্রশিক্ষণ নেওয়া অথবা কোর্স করা হয়নি। অন্য ফটোগ্রাফারদের ছবি দেখে এবং বিদেশের কিছু ফটোগ্রাফারের লেখা কিছু বই পড়ে কিছু কিছু বিষয়ে জেনেছি। তবে আমি মনে করি, ফটোগ্রাফি করতে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। আজকাল অনেকেই চান ফটোগ্রাফি করতে, কিন্তু তারা জানেন না যে আসলে কী তুলতে হবে, কীভাবে তুলতে হবে। একটা ভালো ছবি তুলতে হলে মুহূর্ত, কম্পোজিশন, পয়েন্ট অব ভিউ, লাইট এসব কারিগরি বিষয় অন্তত জানার ও বোঝার জন্য ফটোগ্রাফির বেসিক প্রশিক্ষণটা নেয়া খুবই জরুরি।
সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, ফটোগ্রাফি করতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে।
বিবার্তা : সবার মুখেই শোনা যায় ফটোগ্রাফি একটা চ্যালেঞ্জিং পেশা। আপনি কী বলেন?
এহসানুল সিদ্দিক : হ্যাঁ। আমি নিজেও মনে করি ফটোগ্রাফি অনেক চ্যালেঞ্জিং। অনেক কথা শুনতে হয় আশপাশের মানুষের কাছে, অনেক দামী একুইপমেন্টের দরকার হয়। প্রতি পদে পদে থাকে ঝুঁকি। কিন্তু আমি মনে করি, নিজের মনের স্রোত যেদিকে যায় সেই স্রোতে চলাটাই জরুরী। এ ক্ষেত্রে আত্নতৃপ্তিটাই প্রধান। এসবের কাছে নিন্দা-প্রশংসা কিছুই না। জীবনটা আমার, তাদের না। তারা নিশ্চয়ই বুঝবে না আমার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে আমার জীবনটা কেমন।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে নিশ্চয়ই অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। তেমন মজার কোনো ঘটনার কথা কি বলবেন?
এহসানুল সিদ্দিক : হ্যাঁ, মজার ঘটনা তো অনেক আছে। তার মধ্যে একটি ঘটনা মনে রাখার মতো। আমি সাধারণত শিডিউল করে কখনো ছবি তুলতে বের হই না। বৃষ্টির ছবি তোলার খুব শখ ছিলো। বৃষ্টির মৌসুম আসবে আসবে। আমি সেই মৌসুম আসার অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। আবহাওয়ার সংবাদ দেখে একদিন বের হলাম শহরের বৃষ্টির ছবি তুলতে। ঘরের পোশাক পরে, একটা ভাঙ্গা ছাতা নিয়ে কোনো প্রকার ক্যামেরা প্রটেকশন ছাড়াই। সেদিন সন্ধ্যায় বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছিলো। ধানমন্ডির ২৭ নাম্বার ডুবে গিয়েছিলো। আমি ভাঙ্গা ছাতা মাথায় নিয়ে ছবির সাবজেক্ট খুঁজছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। আশপাশের ভিজে যাওয়া মানুষগুলো, যারা বৃষ্টিতে ভিজে ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছে তারা আমাকে এমনভাবে দেখছিলো যেনো আমি সদ্য পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে আসা কেউ। আমি সেসবের তোয়াক্কা না করে ছবি তুলছিলাম এবং আমার ক্যামেরা ভিজে গিয়েছিলো। আমি কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। ওইদিন একটাই ছবি পেয়েছিলাম যেটা বাংলাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও পেইজে ছাপা হয়। ক্যামেরার অবস্থা ওইদিন বেশ খারাপ হয়ে যায়। মজার বললে ভুল হবে, এটা ছিলো একটা মিশ্র অনুভুতির একটা ঘটনা।
বিবার্তা : ছবি নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে কি?
এহসানুল সিদ্দিক : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলা ঠিক হবে কি না জানি না। আমার সেরা ছবিগুলো নিয়ে দূর ভবিষ্যতে একটা সলো এক্সিবিশন করার ইচ্ছা আছে, যেখানে গ্যালারিভর্তি শুধু আমার ১০০ ছবি থাকবে।
আর কিছু টপিকের উপর প্রোজেক্ট করার ইচ্ছা আছে। এখন পর্যন্ত হয়তো দু’একটা ভালো ছবি তুলতে পেরেছি, এরকম আর দশ হাজার ছবি তুলে নিজের পোর্টফোলিও ভারী করার ইচ্ছা আছে।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী