জাহিদ হাসান তুষারের জন্ম টাঙ্গাইলে। বাবা মো. সামছুল হক। মা রওশন আরা আক্তার রেখা। বড় ভাই মেহেদী হাসান। তার বেড়ে ওঠাটা আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই। বর্তমানে পড়াশুনা করছেন টাঙ্গাইলের হাজী আবুল হোসেন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজিতে; কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।
বিবার্তা’র আয়োজনে গত সপ্তাহে ৭১পিক্স 'ফটো অব দ্যা উইক' প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সেরা হয়েছেন জাহিদ হাসান তুষার। তরুণ এই ফটোসাংবাদিক সম্প্রতি মুখোমুখি হন বিবার্তার। জানান নিজের জীবনের গল্প। সেই গল্প পাঠকদের জানাচ্ছেন বিবার্তা২৪ডটনেটের প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
বিবার্তা : আপনার ফটোগ্রাফির শুরুর কথা বলুন।
জাহিদ হাসান : যখন ক্লাস নাইনে, তখন পত্রিকায় (এই মহূর্তে পত্রিকার নামটা মনে আসছে না) ‘ফটো এলবাম’ নামে একটা ফিচার প্রকাশিত হতো। বিভিন্ন ধরনের ছবি থাকত সেখানে। ওই ফটো অ্যালবাম দেখেই আমার মাঝে প্রথমে ছবি তোলার অনুপ্রেরণা আসে। মনে মনে ভাবতাম, এমন সুন্দর ছবি আমি কবে তুলতে পারব। আদৌ কি কোনদিন পত্রিকায় আমার তোলা ছবি স্থান পাবে? তখন আমি পত্রিকা থেকে ছবিগুলো কেটে আমার ডায়েরির পাতায় লাগিয়ে রাখতাম, আর বাবাকে দেখাতাম। আমার বাবাও ফটোগ্রাফি করতে পছন্দ করেন। সেখান থেকেই ছবির প্রতি ভালোলাগা শুরু। তারপর কারো ডিজিটাল ক্যামেরা পেলেই টুকিটাকি ছবি তুলতাম। এরপরে স্মার্টফোনে পুরোদমে ফটোগ্রাফি শুরু। ২০১৬ সালে আমার বড় ভাই আমাকে একটি ডিএসএলআর ক্যামেরা গিফট করে। এখন মোবাইল ও ক্যামেরা দুটো দিয়েই ফটোগ্রাফি করি।
রাশেদ মামুন নামে এক বড় ভাই আমাকে ছবি তোলায় প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত অনেক সাহায্য করেছেন। এখনো আমার সহযোগি খালাত ভাই রুমন, তানভির অনিক ভাই, অরণ্য ভাই, জিয়ান ভাই উনারা সাহস ও অনুপ্রেরণা দুটোই দিয়ে যাচ্ছেন।
বিবার্তা : আপনার ছবির বিষয়গুলো কি? কেন এসব ছবি তোলেন?
জাহিদ হাসান : সব ধরনের ছবিই তোলা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি লাইফস্টাইল ক্যাটাগরির ছবি তুলতে। লাইফস্টাইলে মানুষের জীবনধারার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা যায়। এখানে সৃজনশীলতা প্রকাশের রয়েছে অনেক সুযোগ। এই ছবিগুলো যেন বেশি জীবন্ত মনে হয়। প্রতিদিনকার জীবনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোই আমার ফটোগ্রাফির বিষয়।
বিবার্তা : ‘হাজারো শব্দের চেয়ে এটা ছবিই বেশি শক্তিশালী’। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
জাহিদ হাসান : আমি এ সম্পূর্ণ একমত। হাজারো শব্দের মাধ্যমে একটা গল্প দাঁড় করানো যায়, যে গল্পের শেষে আমরা একটা জিনিস বুঝতে পারি। কিন্তু একটা ছবিই পারে একটা মানুষের মাথায় হাজারো শব্দের চিন্তাভাবনা আনতে। এটাই ছবির ক্ষমতা। কথায় আছে, ‘ছবি নিজেই কথা বলে’। আসলেই এমন কিছু ছবি আছে যা দেখলে মনে হবে ছবিগুলো কথা বলছে।
বিবার্তা : একজন সাধারণ মানুষ আর ফটোগ্রাফারের মধ্যে পার্থক্য কি?
জাহিদ হাসান : একজন সাধারণ মানুষই তার ইচ্ছেশক্তি ও কাজের মাধ্যমে ফটোগ্রাফার হয়ে ওঠে। সব ফটোগ্রাফারই ফটোগ্রাফার হয়ে ওঠার আগে সাধারণ মানুষই থাকেন। তবে হ্যাঁ, একজন ফটোগ্রাফারের চোখ যা দেখে ও মন যা ভাবে তা একজন সাধারণ মানুষের চোখ তা দেখেও না, ভাবেও না। একজন ফটোগ্রাফারের থাকে সব কিছুকে অন্যভাবে দেখার মতো মনের তৃতীয় নয়ন। সাধারণ মানুষ আশপাশের পৃথিবীকে যেভাবে দেখেন, ফটোগ্রাফার কিন্তু দেখেন একটু অন্যভাবে, ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। এখানেই ফটোগ্রাফার আর একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্যটা।
বিবার্তা : একটা অর্থপূর্ণ ছবি চিনবো কীভাবে?
জাহিদ হাসান : একটি অর্থপূর্ণ ছবিতে কিছু উপাদান থাকে। যেমন, লাইট, কম্পোজিশন, পয়েন্ট অব ভিউ, মোমেন্ট, ছবির প্রকারভেদে ছবি ফ্রেমিং এসব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। রুলস অব থার্ড, লিডিং লাইনস এসব বিষয় একটা ছবিকে অর্থপূর্ণ ও চমকপ্রদ করে তোলে।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফি করতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে কি?
জাহিদ হাসান : একটা অর্থপূর্ণ ছবি তুলতে ফটোগ্রাফির কিছু মৌলিক বিষয় জানতে হয়। প্রথমে যেটা না জানলেই নয় সেটা হলো ক্যামেরা চালানো। একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে শুধু ছবি তুললেই সেটা ছবি হয়ে যায় না। যেমন, ছবির কম্পোজিশন, লাইট, মোমেন্ট, পয়েন্ট অব ভিউ এসব বিষয়ে জানা খুবই জরুরি। এসব জ্ঞান থাকলেই একজন ক্যামেরাম্যান তার কাঙ্ক্ষিত ছবিটি তুলতে সক্ষম হবেন। ছবির এই কারিগরি বিষয়গুলো অন্তত জানার ও বোঝার জন্য অবশ্যই বেসিক প্রশিক্ষণ নেয়াটা দরকার। তাহলেই একজন ফটোগ্রাফার বুঝতে পারবে কিভাবে একটা ভালো মানের ছবি তোলা যায়। তাই আমি মনে করি, ফটোগ্রাফি করতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে নানা ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন। যে কোনো একটা ঘটনার কথা কি বলবেন?
জাহিদ হাসান : একটা ঘটনার কথা আমার খুব মনে পড়ে। হয়তো জীবনে কোনদিনও ভুলবো না। গত রোজার ঈদে মামাবাড়ি বেড়াতে যাই। বিকেলে ছবি তোলার জন্যে বের হই। একসময় চোখে পড়ে দুইটা পিচ্চি ছেলে মাছ ধরার জাল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ধপাস করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি ছবি তোলার জন্যে। এদিকে হয়েছি কি, আশপাশে গ্রামের কিছু লোক ছিলো। তাদের মাঝে দুএকজনের কথা আমার কানে আসে। একজন তো বলেই উঠে, ‘পাগল নাকি?’, আরেকজন বলে, ‘কি করে রে উডা দিয়া? গুলি করে নাহি রে?’ একজন বলছিল, ‘দেখ দেখ কেম্বা কইরা ছবি উডায়, বেডায় পুরাই পাগল।’ ছবি তোলা শেষে আমি যখন উঠে দাঁড়াই তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছিলো, মনে পড়লে এখনো হাসি পায়।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফি জীবনে কোন প্রাপ্তি যদি থাকে. . .
জাহিদ হাসান : বিভিন্ন অনলাইন ছবি প্রতিযোগিতা ও ছবি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করছি। ছবি প্রতিযোগিতায় কয়েকবার বিজয়ী হয়েছি। রাজউক কলেজ ফটোগ্রাফি ক্লাবের উদ্যোগে National Photography Competition & Exhibition-এ গত ১-৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আমার ছবি প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে ইউনিভার্সিটি লেভেলে প্রথম স্থান অধিকার করি আমি। বিচারক ছিলেন হাসান চন্দন স্যার, এস এ কিরণ স্যার ও সাঈদ লতিফ হোসেন স্যার। প্রদর্শনীতে প্রথম হওয়া আমার ফটোগ্রাফি জীবনে অনেক বড় একটা পাওয়া।
বিবার্তা : আপনার প্রিয় ফটোগ্রাফার ব্যক্তিত্ব কে?
জাহিদ হাসান : তালিকায় প্রিয় ফটোগ্রাফার অনেকেই আছেন। তবে যাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তাদের মধ্যে রয়েছেন ফটোগ্রাফার প্রণব ঘোষ, জিএমবি আকাশ, প্রিতো রেজা, আনোয়ার হোসেন স্যার, স্টিভ এমসি ক্যারি প্রমুখ।
বিবার্তা : অবসরে কি করতে পছন্দ করেন?
জাহিদ হাসান : গান শুনতে, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও নিউজপেপার পড়তে পছন্দ করি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া তো আছেই...। এছাড়া ইন্টারনেটে বড় বড় ফটোগ্রাফারদের তোলা ছবিগুলো দেখি। আর সময় সুযোগ হলেই ক্যামেরাটা নিয়ে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়ি ছবি তোলার জন্যে।
বিবার্তা : ফটোগ্রাফিকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন. . .
জাহিদ হাসান : আমার অনেক ইচ্ছে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ঘুরে দেখার। প্রত্যেক জেলার একটা করে সেরা ছবি তোলার। ৬৪টা বেস্ট ছবি নিয়ে একটা ফটোবুক করব। তারপর ৬৪টা ছবি নিয়ে একটা ছবি প্রদর্শনী করার ইচ্ছেও আচ্ছে। এই ইচ্ছেটা পূরণ করার জন্যে আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছি।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/হুমায়ুন/মৌসুমী