রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত নাম ছিলো মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। কথা ও অঙ্গ-ভঙ্গির জন্য বেশ আলোচিত ছিলেন। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যও ছিলেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কথা শুনে হাসেননি দেশে এমন কোনো ব্যক্তি নেই। তিনি বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে সব সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন। এ কারণে দেশ-বিদেশে এক নামে সবাই তাকে চেনেন।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক ছিলেন এই যুদ্ধাপরাধী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর নামে ঢাকার ধানমন্ডির ১০/এ রোডের ২৮ নম্বরে একটি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাড়ি ও ফ্লাট রয়েছে। চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জের গুডসহিল, রাউজানের গহিরায় তিনটি বাড়ি রয়েছে তার। গ্রুপ অফ কোম্পানির মালিক ছিলেন তিনি।
তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কিউসি কনটেইনার লাইন লিমিটেড, কিউসি ফিডারস লিমিটেড, কিউসি প্রোপার্টিজ লিমিটেড, কিউসি স্টেট লিমিটেড, কিউসি হোল্ডিং লিমিটেড, কিউসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, কিউসি ট্রেডিং লিমিটেড, কিউসি শিপিং লিমিটেড, বারউইন কিউসি এজেন্সিস লিমিটেড, কিউসি নেভিগেশন লিমিটেড, শেয়ার মানি ডিপোজিট, ফোকাস মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড, ঢাকা ডাইং এমএফজি কোম্পানি লিমিডের মালিক ছিলেন সাকা।
এছাড়াও সিএসবি চ্যানেল নামে একটি টিভি চ্যানেলও ছিল তার। ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ১/১১ সরকারের আমলে বিটিআরসি বন্ধ করে দেয় ওই চ্যানেলটি। এ কোম্পানিগুলো পরিচালনা করতো সাকার পরিবারের সদস্যরা। আর সাকা চৌধুরী কিউসি হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান ও কিউসি নেভিগেশন ও মার্কারি এয়ার বিডির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি আনুমানিক হাজার কোটির টাকার বেশি মালিক ছিলেন।
চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরায় কয়েক’শ একর জমি রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সুদ ও জামানতমুক্ত ঋণ ছিল ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। যা তিনি পরিশোধ করেছেন। সাকা চৌধুরীর ২ কোটি টাকার বেশি দামের প্যারাডোসহ তিনটি গাড়ি আছে। সাকা চৌধুরী কর দিতেন। তার টিন নম্বর হলো- ৩০৫ ১০০ ১৭০১।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সাকা চৌধুরীর ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হোসেন বিবার্তাকে বলেন, সকল যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। তাদের এ সম্পদ মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হবে।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সিনিয়র সিটিজেনশিপ দেয়া হবে। অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যেককে ফ্ল্যাট দেয়া হবে। প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার কবর একই রকম করে সরকারি খরচে তৈরি করে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামের রাউজানে ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ছিলেন। এছাড়া কয়েক দফায় পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা ৩ ভাই। অপর দুই ভাই হলেন- গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রীর নাম ফারহাত কাদের চৌধুরী। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এরা হলেন- ফয়জুল কাদের চৌধুরী, হুম্মাম কাদের চৌধুরী। মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী।
সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন পাকিস্তানের সাদিক পাবলিক স্কুলে। পরবর্তীতে সেখান থেকে এনে চট্টগ্রামের সেন্ট প্লাসিড স্কুলে ভর্তি করানো হয়, সেখান থেকেই মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সম্মান ডিগ্রি অর্জন করেন। যদিও ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালে তার এ সার্টিফিকেটকে ভুয়া ঘোষণা দেয়া হয়।
সাকা চৌধুরী সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে নির্বাচনী এলাকা রাউজান থেকে নির্বাচিত হন তিনি।
২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিএনপির ডাকা হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় তাকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে তাকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযোগ গঠন করে।
তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের অভিযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৯৭১ সালের ৪-৫ এপ্রিল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের ৭ জনকে অপহরণ ও এর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের মধ্য গহিরা হিন্দু পাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে গণহত্যা। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নতুন চন্দ্র সিংহকে হত্যা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে ৩২ জনকে হত্যা, বাড়িতে আগুন দেয়া ও ধর্ষণের অভিযোগ।
১৪ এপ্রিল সতিশ চন্দ্র পালিত হত্যা, তার বাড়িতে আগুন ও পরিবারের সদস্যদের ধর্মান্তরে বাধ্য করা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে মিলে বোয়ালখালির শাখাপুর হিন্দু অধ্যুষ্যিত অঞ্চলে হামলা ও ৭৬ জনকে হত্যা।
২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীকে ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টিতে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তবে বিএনপির অভিযোগ এই বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে তার পক্ষ থেকে আপিল করা হলে আপিলের রায়ে ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর একটি অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হলেও অন্য অপরাধের জন্য ফাঁসির সাজা বহাল থাকে। ২১ নভেম্বর সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নিকট প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন করেন কিন্তু রাষ্ট্রপতি তার আবেদন নাকচ করে দেন। গত ২২ নভেম্বর ২০১৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাত ১২টা ৪৫ মিনিটে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বিবার্তা/আসাদুজজামান ও বশির/জাহিদ