সাত বছর পর গত ১৯ মার্চ হয়ে গেলো বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল। এর আগে সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর হয়েছিলো পঞ্চম কাউন্সিল। কাউন্সিলে দলের নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করেন কাউন্সিলররা। ইতোমধ্যে মহাসচিব, যুগ্ম-মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের নাম ঘোষণা করা হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই স্থায়ী কমিটি চূড়ান্ত করেছেন খালেদা জিয়া। যে কোনো সময় এই কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করা হবে।
কাউন্সিলের প্রায় এক মাস পর দুই দফায় বিএনপির মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ পদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এখনো স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। জানা গেছে, এক সপ্তাহের মধ্যে স্থায়ী কমিটি এবং চলতি মাসের শেষদিকে ভাইস চেয়ারম্যানদের ও তৃতীয় ধাপে বিএনপির নতুন জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হবে। দলের একাধিক সূত্র থেকে এমন আভাস পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। চলছে শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। একটি সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচন করতে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বিপাকে পড়েছেন। কষছেন নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ। প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে নবীনদের সমন্বয় করবেন নাকি প্রবীণদের বাদ দিয়ে স্থায়ী কমিটি ঢেলে সাজাবেন এমন নানা প্রশ্নের হিসাব মেলাতে হচ্ছে তাকে।
কাউন্সিলের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর প্রায় দশদিন পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারমুক্ত করে মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই দিনে দফতরে দায়িত্বরত যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমদকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তখন থেকে আলোচনা শুরু হয় কারা আসছেন স্থায়ী কমিটিতে।
নেতা কর্মীরা যখন স্থায়ী কমিটি নিয়ে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দৃষ্টি রাখছিলো তখনই দলের সাতজন যুগ্ম মহাসচিবের নাম ঘোষণা করা হলো। একই সাথে ঘোষণা করা হয় আট জন সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম। এদিকে খালেদা জিয়া নতুন নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে নতুন বার্তা দিয়েছেন। দলের দূর্দিনে যারা ভূমিকা রেখেছেন সেসকল নেতাদেরই মুল্যায়ন করা হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির তো-কর্মীরা।
যুগ্মমহাসচিব সাতজনের মধ্যে ছয়জন নতুন। একজন পুরনো। সাংগঠনিক সম্পাদকদের আটজনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, এরমধ্যে দুইজন নারীও রয়েছেন। ফজলুল হক মিলন (ঢাকা), নজরুল ইসলাম মঞ্জু (খুলনা), রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু (রাজশাহী), আসাদুল হাবিব দুলু (রংপুর), শাহাদাত হোসেন (চট্টগ্রাম), সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স (ময়মনসিংহ), বিলকিস শিরীন (বরিশাল) ও শামা ওবায়েদ (ঢাকা/ফরিদপুর)। সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে কেবল মিলন ও দুলু পুরাতন। সিলেট বিভাগে প্রথমদিন নাম ঘোষণা না করলেও পরের দিন ডা. শাখায়াত হোসেন জীবনের নাম ঘোষণা করা হয়। সেখানে এর আগে ইলিয়াস আলী দায়িত্বে ছিলেন। সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো যুগ্ম মহাসচিবের পদেও নতুন মুখ এনেছেন। তারা আগে যদিও অন্য দায়িত্বে ছিলেন। সাতজন যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে এ এম মাহবুবউদ্দিন খোকন পুরাতন। বাকি নতুন। নতুন যুগ্ম মহাসচিবরা হলেন মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবীর খোকন, হাবিবউন-নবী খান সোহেল, হারুন অর রশীদ ও আসলাম চৌধুরী। আগের কমিটিতেও মঞ্জু, দুলু প্রিন্স ছিলেন, তবে তাদের এবার গুরুত্বপূর্ণ পদে আনা হয়েছে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটি এক প্রকার চুড়ান্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। এ ক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটিতে নতুন কারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, তা নিয়ে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনাও অব্যাহত আছে। দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লবিং চালানোর পাশাপাশি সাম্প্রতিক দুঃসময়ে যারা বিএনপির পাশে দাঁড়িয়েছেন, এমন নেতাদের নামই এ আলোচনায় আসছে। বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৯। ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১১ থেকে বাড়িয়ে ১৯ করা হয়।
১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির তিনজন মারা গেছেন। এরা হলেন খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, ড. আর এ গনি এবং যুদ্ধাপরাধীর মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। এ ছাড়া দলের প্রবীণ নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য এম শামসুল ইসলাম বয়োজ্যেষ্ঠের কারণে নিজেই এ পদে না থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। আরেক সদস্য সারোয়ারী রহমান না থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও বেগম জিয়া শেষ পর্যন্ত তাকে স্থায়ী কমিটিতে রাখছেন বলে জানা গেছে।
পদাধিকার বলে ইতিমধ্যে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল স্থায়ী কমিটির সদস্য। স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে আসীন হওয়ার জন্য যারা দৌড়-ঝাপ করছেন তারা হলেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আব্দুল আওয়াল মিন্টু, অ্যাড. খন্দকার মাহবুব হোসেন, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ শাহজাহান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, মেজর অব. হাফিজউদ্দিন আহমেদ, শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাদেক হোসেন খোকা, ড. ওসমান ফারুক, চৌধরী কামাল ইবনে ইউসুফ, সেলিমা রহমান এবং প্রফেসর তাসমেরী এস ইসলাম। এই পদ প্রত্যাশীদের মাঝে অনেকে এই পদের আশায় লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের কাছে গিয়ে ধর্ণা দিয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমেদ এবং মোহাম্মদ শাহজাহান স্থায়ী কমিটির সদস্য হচ্ছেন তা অনেকটা নিশ্চিত। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেনকে স্থায়ী কমিটির সদস্য করার বিষয়ে প্রথমে বেগম জিয়া এবং তারেক রহমান এক মত হলেও বিএনপির একাধিক স্থায়ী কমিটির সদস্যের বিরোধীতার মুখে ছিটকে পড়েছেন তিনি।
কবে নাগাদ বিএনপির স্থায়ী কমিটি ঘোষণা হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবার্তাকে বলেন, স্থায়ী কমিটিতে কারা থাকছেন এ বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। কাউন্সিলের পর আমার সাথে নেত্রীর ( খালেদা জিয়া) দেখা হয়নি। কাউন্সিলের আগে পরে শরীরে অনেক ধকল গেছে তাই আমি শারীরিকভাবে অনেকটা অসুস্থ। গয়েশ্বর বলেন, দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ৩৩/৩৪ বছর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, কষ্ট করে আজকে দেশনেত্রী হয়েছেন। উনি যে বিবেচনায় কমিটি দেবেন তা অবশ্যই দলের মঙ্গলের জন্য দেবেন। উনার (খালেদা) প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। স্থায়ী কমিটি ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা যত দ্রুত করা যাবে তত বেটার।
বিবার্তা/বিপ্লব/মহসিন