সন্দেহ হলেই গ্রেফতারের বিধান রেখে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে। বিদেশী নাগরিকদের কেউ সাইবার অপরাধ করলে তাকেও এই আইনের আওতায় সাজা দেয়া যাবে। এতে জামিন অযোগ্য ৮টি ধারা রাখা হয়েছে। এই আইন প্রয়োগের সঙ্গে জড়িতদের দেয়া হয়েছে দায়মুক্তি।
তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ ও সাইবার অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তির আওতায় আনতেই নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। এর আওতায় জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের কাউন্সিল সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন থাকার পরও কেন নতুন আইন হচ্ছে, তা জানতে চাইলে আইসিটি বিভাগের সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু নেই। সেখানে সাধারণ কিছু অপরাধের বিষয়ে বর্ণনা ও শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে। ফলে সব ধরনের সাইবার অপরাধ দমন ও এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা যায় না। এজন্যই মূলত সাইবার নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, খসড়া এ আইনে যুগোপযোগী সব কিছুর বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আইনে ফরেনসিক ল্যাব, সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট ও সাইবার সিকিউরিটি কাউন্সিলের কথা বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত খসড়া অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। সেখান থেকে সংসদে যাবে। দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অনেক বিষয় সংযোজন বিয়োজন হতে পারে।
জানা গেছে, সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় বেশ কিছু বিষয়কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুক, টুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম, ট্যাঙ্গো, ভাইবার, ইমোসহ যে কোনো অ্যাপস বা ওয়েবসাইটে গোপনীয়তা লংঘন করে ছবি প্রকাশ, প্রেরণ, পর্নোগ্রাফি, কোম্পানি অপরাধ, ভাইরাস ছড়িয়ে কারও ক্ষতিসাধন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি, ক্ষতির চেষ্টা করা বা প্ররোচনা দেয়া।
এসবের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত করে নতুন আইনে বিচারের আওতায় আনা যাবে। এই আইনের অধীনে কেউ অপরাধ করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরোয়ানা ছাড়াই তাকে গ্রেফতার করতে পারবেন। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশিও করতে পারবেন। এই আইনে অপরাধের তদন্তভার পাবে ডিজি নির্ধারিত প্রতিনিধি ও পুলিশ।
তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০১৫ এর খসড়া তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি, অটোমেটেড টেলার মেশিন (এটিএম) ও পয়েন্ট অব সেল (পস) মেশিন জালিয়াতি শনাক্তের পর সাইবার অপরাধ দমনের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। এছাড়া আগে থেকেই সাইবার অপরাধীরা ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার, ই-মেইলসহ ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন অপরাধ করে আসছিল। তাদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যায় না। ফলে নতুন করে একটি যুগোপযোগী আইন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আইসিটি অনুবিভাগ) মো. হারুন অর রশীদ বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন খসড়া তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। এর সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারদের (অংশীজন) মতামত নেয়া হয়েছে। এ আইনে সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছ।
সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হলে এর অধীনে ‘সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা’ বা ‘সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট’ নামে নতুন একটি সংস্থা গঠন করা হবে। যার প্রধান হবে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার মহাপরিচালক (ডিজি)। এই সংস্থা দেশীয় সাইবার সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের অধীনে বাংলাদেশ সাইবার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (বিডিসিইআরটি) নামে আরও একটি টিম গঠন করা হবে। যারা বাংলাদেশে কোনো ধরনের সাইবার হামলা হলে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলার অভিযোগ গঠনের (চার্জ গঠন) দিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। আইনের ৯ থেকে ১৬ ধারা পর্যন্ত ৮টি ধারার অপরাধ হবে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করা হয়েছে।
খসড়া আইন অনুযায়ী জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা হবে। এর সভাপতি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। এ কাউন্সিলে সদস্য থাকবেন অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা বা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত মন্ত্রী সমমর্যাদার একজন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী মনোনীত দু’জন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ সচিব। সাইবার সিকিউরিটি সংস্থার ডিজি হবেন এই কাউন্সিলের সদস্য সচিব।
এই আইনটি সারাদেশে প্রয়োগ হবে। আইনের প্রয়োগ (ধারা-৪) বলা হয়েছে-কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে তার জাতীয়তা বা নাগরিকত্ব যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের বাইরে ও বাংলাদেশের মধ্যে এই আইনের বিধানগুলো প্রযোজ্য হবে। কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের বাইরে এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করলে তারও সাজা হবে।
ধারা-১০ ও ১১-এ কম্পিউটারসংক্রান্ত জালিয়াতি ও প্রতারণা সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি অনুমতি ছাড়া কারও কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্কে অপর কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে কোনো তথ্য পরিবর্তন, মুছে ফেলা বা নতুন তথ্য সংযুক্ত বা বিকৃতি ঘটানোর মাধ্যমে নিজে বা অন্য কারও আর্থিক সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করেন তা হলে এই কাজ অপরাধ হবে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি প্রতারণার অভিপ্রায়ে প্রেরকের বরাবরে এমন কোনো ইলেকট্রনিক মেসেজ প্রেরণ করেন যা বস্তুগতভাবে ভুল তথ্য দেয়ায় অপর কোনো ব্যক্তির লোকসান বা ক্ষতি সংঘটিত করে তাহা হইলে তাহার এই কাজ হইবে একটি অপরাধ।-এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
আইনের ধারা-১২ এই পরিচয় প্রতারণা এবং ছদ্মবেশে প্রতারণা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অপর কোনো ব্যক্তির পরিচয় ধারণ করে বা অন্য কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য নিজের বলে দেখায় বা উদ্দেশ্যমূলক জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা নিজের বলে এই উদ্দেশ্যে ধারণ করে যে, তার নিজের বা অপর কোনো ব্যক্তির সুবিধা লাভ করা বা করানো, কোনো সম্পত্তি বা কোনো সম্পত্তির স্বার্থ প্রাপ্তি, অপর কারও ক্ষতি করা হলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
আইনের ১৩ নম্বর ধারার ৪টি উপধারা এবং বেশ কিছু উপ-উপধারার মাধ্যমে সাইবার সন্ত্রাসী কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সাজার বিষয়ে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
গোপনীয়তা লংঘনের বিষয়ে ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কারও অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা, প্রকাশ ও প্রেরণ গোপনীয়তা লংঘনের ক্ষেত্রে অপরাধ হবে। হ্যাকিং অপরাধ করলে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
পর্নোগ্রাফি, শিশু পর্নোগ্রাফি এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য (ধারা-১৫) অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। এক্ষেত্রে কম্পিউটারে, পেন ড্রাইভ, মেমোরি কার্ডে পর্নোগ্রাফি সংরক্ষণ, এমন কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে যাতে বিজ্ঞাপনদাতা কর্তৃক পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল উপাদানগুলো বিতরণ বা প্রদর্শনের সম্ভাবনা থাকে, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেমের মধ্যে শিশু পর্নোগ্রাফি বা শিশু সম্মন্ধীয় অশ্লীল উপাদান প্রকাশ করলে কম্পিউটার সিস্টেমের মধ্যে প্রকাশের উদ্দেশ্যে শিশু পর্নোগ্রাফি উপাদান উৎপাদন করলে, এমন কোনো বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলে যা শিশু পর্নোগ্রাফি বা শিশু সম্মন্ধীয় অশ্লীল উপাদান বিতরণ বা প্রদর্শনের সম্ভাবনা থাকে তবে তিনি এই অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে।
এই আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, দণ্ডযোগ্য কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেয়া যাবে না।
অপরাধের তদন্ত প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ডিজির কাছ থেকে ক্ষমতা প্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা বা সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) এই আইনের অধীনে অপরাধ বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে তদন্ত করতে পারবেন। অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে যে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন এই আইনের অধীনেও একই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন। ধারা-২৪ এ বলা হয়েছে-কোনো ব্যক্তি বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তদন্তের স্বার্থে কোনো প্রকাশ বা তদন্ত কর্মকর্তাকে সহায়তা করতে বাধ্য থাকবেন।
বিবার্তা/এম হায়দার